২৬ জানুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৪০

বেপরোয়া ছাত্রলীগ জড়াচ্ছে একের পর এক বিতর্কে

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় ঘটনার পুনরাবৃত্তি * ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে এ ধরনের সংঘর্ষ কমে আসবে -অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী * ছাত্রলীগের এ ধরনের কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগের অধঃপতিত অবস্থার পরিণতি -মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম * সব সময় ছাত্রলীগের অবস্থান মিডিয়ায় সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয় না : ছাত্রলীগ সভাপতি


দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ। বিতর্ক যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পাশাপাশি ভিন্নমতের ছাত্র সংগঠন ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এছাড়া একশ্রেণীর নেতাকর্মীর চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অপহরণ, ধর্ষণ, প্রশ্নফাঁসসহ নানা কার্যকলাপের কারণে নিয়মিতই আলোচনায় থাকছে ছাত্রলীগ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেয়ায় এ ধরনের ঘটনার পুুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এখনই লাগাম টেনে না ধরলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে সংগঠনটির এমন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা।
সর্বশেষ ২৩ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী ও কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগ। এতে গণমাধ্যমকর্মীসহ উভয়পক্ষের প্রায় ৫০ জন আহত হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেটের এমসি কলেজে প্রগতিশীল বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর ডাকা প্রতিবাদ কর্মসূচিতেও হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এসব হামলায় প্রায় ২৫ জন আহত হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক, শিক্ষাবিদ ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা মনে করছেন, সম্পদ উপার্জনে অধিক মনোযোগী হওয়াই ছাত্রলীগের বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার মূল কারণ। অর্থবিত্ত অর্জনের লক্ষ্য থেকেই বিভিন্ন সময় তারা বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যদিকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেয়া এবং ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে আইনানুযায়ী শাস্তি না হওয়ায় তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কমছে না। পাশাপাশি ক্যাম্পাসে বিরোধী সংগঠনের নিষ্ক্রিয়তা বা কার্যকর অবস্থান না থাকায় ছাত্রলীগের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড বাড়ছে। এছাড়া অনুপ্রবেশকারীরাও নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তারা।
ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়েই ২০০৯ সালের ৩ এপ্রিল সংগঠনটির সাংগঠনিক নেত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগ নেতাদের সতর্কও করেছেন বহুবার। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সর্বশেষ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ছাত্রলীগ যখন পত্রিকায় অপকর্মের শিরোনাম হয় তখন সরকারের সব অর্জন ম্লান হয়ে যায়। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হলের সিট ভাগাভাগি ও রুম ভাগাভাগি বন্ধ করতে হবে।’ এছাড়া সংগঠনটির বিভিন্ন কর্মসূচিতে গিয়েও ছাত্রলীগের এমন কর্মকাণ্ডের প্রকাশ্য সমালোচনা করেন তিনি।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হয়েছে ৮ জন। অন্য এক হিসাবে দেখা গেছে, গত ৮ বছরে সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রায় ৬৫ জন নিহত হয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি সিলেট নগরীতে এক ছাত্রলীগ কর্মী খুন হন। এছাড়া কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই গত বছর ছোট-বড় প্রায় অর্ধশত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালের শেষের দিকে এবং ২০১৭ সালের শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মনোনয়ন নিয়ে বিভিন্ন সময় ২০টির মতো সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগ। এছাড়া চলতি বছরের শুরুর দিকে এবং গত বছরের শেষদিকে ছাত্রলীগের হাতে একাধিক সাংবাদিক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। গত বছরের ১৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে কক্ষ দখল নিয়ে রাতভর তাণ্ডব চালায় ছাত্রলীগ। ১৪ জুন টেন্ডার দখল নিয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি) ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল হক ও সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ দাসের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এছাড়া গত বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, যার নেপথ্যে ৫১ কোটি টাকার টেন্ডার ছিল বলে ছাত্রলীগ সূত্র জানায়। এছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাব্বির হোসেন গুলিস্তানে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে সংবাদের শিরোনাম হন। এমন অবস্থায় আগামী ২৯ জানুয়ারি প্রগতিশীল ছাত্র জোটের ডাকা সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট কেন্দ্র করে বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এখনই ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরার পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের। সংগঠনটির বিদ্যমান সমস্যা নিরসনে বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান একাধিক ছাত্রনেতা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দুই বছর পরপর নিয়মিত সম্মেলন, জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা, সংগঠন পরিচালনায় নির্দিষ্ট আয়ের খাত তৈরি করা, ছাত্রলীগকে আওয়ামী লীগ ও অন্য সহযোগী সংগঠনের প্রভাবমুক্ত করা এবং শিক্ষক রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করা। পাশাপাশি ছাত্রনেতাদের অধ্যয়নমুখী করা এবং ছাত্র সম্পৃক্ততা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলোর কারণে অন্যদের মতপ্রকাশের সুযোগ থাকে না। আর যেহেতু ছাত্র সংসদ নির্বাচন নেই, তাই ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতারা সাধারণ ছাত্রদের কথা শুনতে আগ্রহ দেখায় না। এজন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন জরুরি। ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে সংগঠনগুলো ছাত্রদের দাবির প্রতি গুরুত্ব দেবে, ছাত্রদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াবে। আর এভাবে এক ধরনের জবাবদিহিতার মনোভাব তৈরি হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভয়েসও শোনা যাবে। তখন এ ধরনের সংঘর্ষ কমে আসবে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, এসব সংঘর্ষের ঘটনার পেছনে আর্থিক কারণ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আধিপত্য বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বস্তুগত স্বার্থ কাজ করে। এর পেছনে টাকা-পয়সার ব্যাপার থাকে। ছাত্র প্রতিনিধি থাকলে এ অবস্থাও কমে যাবে।

ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এসব বিষয়ে যুগান্তরকে বলেন, ছাত্রলীগের এ ধরনের কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগের অধঃপতিত অবস্থার পরিণতি। আওয়ামী লীগ এখন লুটেরা ও ধনিক শ্রেণীর দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাদ দিয়ে পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির পথ গ্রহণ করেছে। লুটপাটের জন্য ক্যাডার পালন করা হয়। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে যেমন এটা সত্য, বিএনপির ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি সত্য। এসবের পরিণতি হল ক্যাডারদের লোভের কাছে সবকিছু অনুগত করে তোলার ব্যবস্থা করা। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার উপায় হিসেবে তিনি বলেন, এর থেকে বের হয়ে আসতে হলে লুটেরা বুর্জোয়াদের হাত থেকে শাসন বের হয়ে আসতে হবে। বিকল্প প্রগতিশীল শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে হবে। দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় পরিচালিত করতে হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/11105