২৬ জানুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৩৬

নিয়মিত ঋণেও আদায় নেই

উদ্বেগ বাড়ছে অর্থনীতিতে

মামলা, মকদ্দমাসহ নানা কারণে খেলাপিঋণ আদায় হয় না। কিন্তু এখন ব্যাংকের খাতায় যেসব ঋণ নিয়মিত দেখানো হচ্ছে ওইসব ঋণও আদায় হচ্ছে না। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে এ প্রবণতা বেশি। সরকারি ছয় ব্যাংকের প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার নিয়মিত ঋণের মধ্যে তিন মাসে আদায় হয়েছে মাত্র সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। এটাকেই উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার অপসংস্কৃতি চালু হওয়ার কারণে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছেন তারাও আগ্রাহ হারিয়ে ফেলছেন। নিয়মিত ঋণ আদায় না হলে এসব ঋণ শিগগিরই অনিয়মিত হয়ে যাবে। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ আরো বেড়ে যাবে। ফলে ব্যাংকের ঋণ বিতরণের সক্ষমতা তলানিতে ঠেকবে। ব্যাংক ঋণের সুদহার আবারো বেড়ে যাবে। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করার মতো ঋণ পাবে না। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারিয়ে দেশী পণ্য মার খাবে বিদেশী পণ্যের কাছে। সবমিলে জাতীয় প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে যাবে।
জানা গেছে, নিয়মিত, অনিয়মতিসহ সব ধরনের ঋণ আদায়ের চিত্র নিয়ে প্রতি তিন মাস অন্তর প্রতিবেদন তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সংক্রান্ত সর্বশেষ পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে গত জুনভিত্তিক তথ্য নিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতে মোট নিয়মিত ঋণ রয়েছে ছয় লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এ থেকে সামগ্রিকভাবে আদায় দেখানো হয়েছে ১৯ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারি ও ও বিদেশী ব্যাংকগুলোর আদায়ের হার দুই অঙ্কের ঘরে অর্থাৎ ২০ শতাংশের মধ্যে থাকলেও সরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। যেমনÑ আলোচ্য সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে নিয়মিত ঋণ আদায়ের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অগ্রণী ব্যাংকের। ব্যাংকটির ১৭ হাজার ৪৭০ কোটি টাকার নিয়মিত ঋণের মধ্যে আদায় হয়েছে মাত্র ৫৬ কোটি টাকা। আদায়ের হার মাত্র শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ। সোনালী ব্যাংকের ২১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার মধ্যে তিন মাসে আদায় হয়েছে মাত্র এক হাজার ৮২৭ কোটি টাকা। আদায়ের হার মাত্র সাড়ে ৬ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকের ১৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে আদায় হয়েছে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা। আদায়ের হার মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ। আর নিয়মিত ঋণের বিপরীতে বেসিক ব্যাংকের সাড়ে ১২ শতাংশ এবং জনতা ব্যাংকের আদায় হয়েছে প্রায় ৮ শতাংশ।

শুধু সরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রেই নিয়মিত ঋণ আদায় কমে যায়নি, কিছু কিছু বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ আদায়ের হার খুবই কম। যেমনÑ ১৩টি ব্যাংকের নিয়মিত ঋণের এক টাকাও আদায় হয়নি আলোচ্য তিন মাসে। আর বাকি তিনটি ব্যাংকের আদায়ের হার ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে।
খেলাপিঋণের পাশাপাশি নিয়মিত ঋণ আদায়ের গতি শ্লথ হওয়ার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ না করার সংস্কৃতি চালু হওয়ায় যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তারাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। নিয়মিত ঋণ আদায় কমে যাওয়ার এটাই বড় প্রমাণ বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, নিয়মিত ঋণ আদায় কমে গেলে এসব ঋণ আবার খেলাপি হয়ে যাবে। তিনি মনে করেন, ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি সরকারেরও দিক থেকেও কোনো সদিচ্ছা নেই ব্যাংকিং খাত নিয়ে। তা-না হলে, যেখানে একই পরিবারের দুইজন পরিচালক ছিল সেখানে চারজন করা হয় কী করে। সাবেক এ গভর্নরের মতে, দেশের অর্থনীতির স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো কঠোর হাতে মনিটরিং করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা যথাথথ পরিপালনে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় খেলাপিঋণ আরো বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যে খেলাপিঋণের পাহাড় জমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে বেকায়দায় পড়বে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। আর মাঝারিরা উঠতে না পারলে বড় উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে না। সবমিলে দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিপর্যয় এড়ানো যাবে না। তিনি বলেন, পরিস্থিতি উন্নতি করতে, ব্যাংকারদের ঋণ আদায়ে সচেষ্ট থাকতে হবে। বিশেষ করে ভালো গ্রাহকদের পুরস্কার বা বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। এটা দেখে মন্দ গ্রাহকও ঋণ পরিশোধে এগিয়ে আসবেন।
এ বিষয়ে রূপালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: আতাউর রহমান প্রধান গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বিষয়টি ভালো করে দেখতে হবে।
আর স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন-উর-রশিদ এ বিষয়ে গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ঋণ আদায় জোরদার করতে হবে। যেসব ঋণ খেলাপি হওয়ার পথে ওইসব ঋণ আদায়ে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তিনি জানান, তার ব্যাংক এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছে।

তবে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ সুবিধা নিয়ে যেসব ঋণ পুনর্গঠন ও নবায়ন করা হয়েছে ওইসব ঋণ আদায় হচ্ছে না। তার ব্যাংকের এমন ১০ জন গ্রাহক রয়েছেন, যাদেরকে ব্যাংক থেকে ঋণ নবায়নে নিরুৎসাহিত করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। ওইসব গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করছেন না। আবার অন্য উপায়ে সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছেন। তাদের দেখে অন্য ভালো গ্রাহকও ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। ওই এমজি জানান, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক শক্ত অবস্থান নিয়েছে। এ অবস্থা ধরে রাখতে হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/288271