২৬ জানুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৩০

মহান পেশা চিকিৎসা প্রসঙ্গ

মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান : ছোটো বেলায় প্রবাদ প্রবচন পড়েছি ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেলো- এখন সময় পাল্টেছে। এখন ডাক্তার আসিবার পরে রোগী মারা যায়। ডাক্তারদের হাতের যশ এতোই বেশি যে, তারা সদ্য ভূমিষ্ট শিশু সন্তানের মাথা কাটতেও দিধা করে না। তারা কখনো মাকে মেরে ফেলে কখনো সন্তানকে হত্যা করে এমনই বেহাল আমাদের চিকিৎসা সেবার। চিকিৎসা ব্যবস্থায় এমন নৈরাজ্যের মধ্যেই আমাদের বসবাস। মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদাগুলো হচ্ছে : খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান; সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এর সাথে আরো একটি বিষয় যোগ করেছেন, তা হচ্ছে : জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা। অবশ্য প্রথমোক্ত পাঁচটি বিষয় নিশ্চিৎ করা গেলে ষষ্ঠ বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নিশ্চিৎ হয়ে যায়। এ চাহিদাগুলোর কোনো একটিকে বাদ দিয়ে মানব জীবন সামনে অগ্রসর হতে পারে না কিংবা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে না। এ চাহিদাগুলো পূরণের নিশ্চয়তা বিধান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। উন্নত রাষ্ট্রসমূহে এর প্রতিটি বিষয়ে রাষ্ট্র নাগরিকদের সুরক্ষা দান করে। ইউরোপের অনেকগুলো দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে তাঁর দেশের নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থান হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বেকার ভাতা এবং নাগরিকদের হেলথ কার্ড প্রদান করে ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কাতার এবং আরব আমিরাতে তাঁর দেশের নাগরিকদের জন্য শুধু শিক্ষা-চিকিৎসাই নয় এমনকি বিয়ে করার জন্য সরকারীভাবে অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদশের নাগরিকদের সকল চাহিদা পূরণ করা রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্ত কমপক্ষে সুচিকিৎসার নিশ্চয়তা বিধান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে চিকিৎসা সেবার যে অবস্থা তাকে কোনো সভ্য রাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে তুলনা করা যায় না। চরম অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, রোগী নিগৃহ, রোগীর প্রতি অযতœ-অবহেলা, ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু- স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। রোগীদের সাথে চিকিৎসক কর্তৃক অসদাচরণ, অবহেলা, দুর্ব্যবহার এবং পরবর্তীতে চিকিৎসক ধর্মঘটে বিনা চিকিৎসায় রোগীদের হাসপাতাল ত্যাগের ঘটনা অহরহ ঘটছে। অদক্ষতা, দুর্ব্যবহার, ভুল চিকিৎসার পেছেনে চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থায় দুর্নীতি, দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় চরম অবহেলার কারণে মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদার এ ক্ষেত্রে চলছে চরম বিশৃক্সক্ষলা। জ¦রের রোগীকে ক্যান্সারের ঔষধ দেয়া, হাপানী রোগীকে হার্টের ঔষধ প্রদান, অপারেশনের পর রোগীর পেটে গজ রেখে সেলাই করে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেই চলছে।
এ সম্পর্কিত মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে একটি গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই। এক পল্লী চিকিৎসক নিয়মিত গ্রামের লোকদের বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা করতেন। সাথে সহকারী হিসেবে নিজের ছেলেকে রাখতেন। একবার এক পেটের পীড়ার রোগীর ডাকে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখলেন রোগী পেটের ব্যথায় চিৎকার করছে। তিনি রোগীকে প্রশ্ন করলেন- দুধ এবং গুড় মুড়ি খেয়েছেন? রোগী হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়ার পর তিনি তাঁকে ঔষধ দিলেন- রোগী অল্প সময়ে সুস্থ হয়ে উঠলো। ঐ পল্লী চিকিৎসক রোগীর বাড়ি হতে নিজের বাড়ি যাওয়ার পথে ছেলে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, বাবা তুমি কিভাবে বুঝলে যে ঐ লোক গুড় মুড়ি এবং দুধ খাওয়ার কারণে তাঁর পেটের ব্যথা হয়েছে? পল্লী চিকিৎসকের সহজ জবাব- কেন, দেখোনি বিছানার পাশে বাটিতে দুধ গুড় মুড়ি ছিলো! পিতার মৃত্যুর পর ছেলে যথারীতি বাবার পেশায় নিয়োজিত হলো। একদিন এক পেটের পীড়ার রোগীর বাড়িতে গিয়ে দেখলেন বিছানার পাশে কাঠের গুড়ি পড়ে আছে। সেখানে কিছুক্ষণ আগে একজন কাঠ মিস্ত্রি কাজ করার কারণে কাঠের গুড়ি পড়েছিল। গ্রাম্য কোয়াক ডাক্তার রোগীকে ধমক দিয়ে বললো- কাঠের গুড়ি খেয়েছেন? গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তারের বিদ্যার সাথে বর্তমান সময়ের অনেক ডাক্তারের কাকতালীয় মিল হয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। পেট ব্যথার রোগীকে এ্যপেন্ডিসাইটিসের ব্যথার রোগী বানিয়ে তার অপারেশন করার ঘটনাও কিন্তু অনেক সময় সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। সামান্য ফোড়াকে টিউমার ঘোষণা দিয়ে তার অপারেশন করার ঘটনাও ঘটছে অনেক সময়।
বর্তমান সময়ে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা চরম দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর ন্যায়-নীতি বহির্ভূত অবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ে চিকিৎসকদের দ্বারা রোগীর সেবা দেয়ার চেয়ে সেখানে রাজনৈতিক কার্যক্রম এখন বেশি পরিচালিত হচ্ছে। পেশাদারিত্বের চেয়ে রাজনৈতিক অনুগত্যকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাস হচ্ছে। টাকার বিনিময়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তির সূযোগ অবারিত করে দেয়া হচ্ছে। মেধা এবং যোগ্যতার মূল্যায়ণ অপাঙতেয় হয়ে গেছে। সকল ক্ষেত্রে যোগ্যতা এবং পেশাদারিত্বকে অবমূল্যায়ণ করা হচ্ছে। যার কারণে মানুষ তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
বর্তমান সময়ের বেশ কয়েকটি ঘটনা সকলেরই নজর কেড়েছে। ২৮ ডিসেম্বর বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকেই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ শহরের খানপুর এলাকার ‘আমেনা জেনারেল হাসপাতাল’ এর ডাক্তারের বিরুদ্ধে রোগীর পেটের ভেতরে গজ রেখে সেলাই করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। স্বজনরা জানান, রোগীর শারীরিক অবনতি ঘটায় অন্যত্র চিকিৎসার জন্য নেয়া হলে গজের বিষয়টি ধরা পড়ে। ২৭ ডিসেম্বর বুধবার সন্ধ্যায় এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনায় রোগীর স্বজনরা হাসপাতাল ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন। রোগীর নাম লিপি আক্তার (৩১)। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। বাড়ি সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় মৌচাক এলাকায়। লিপির মা রোমেলা বেগম জানান, গত ৫ সেপ্টেম্বর আমেনা জেনারেল হাসপাতালে লিপি আক্তারের সিজার করা হয়। এরপর কয়েকদিন হাসপাতালে থেকে বাড়ি চলে গেলে কয়েকদিন পর পেটের ড্রেসিং করানো হলে অপারেশনের জায়গায় ইনফেকশন হয়ে যায়। এরপর ড্রেসিংয়ের জন্য এভাবে ১৫ বার হাসপাতালে আসা হয়। কিন্তু চিকিৎসকরা বরাবর একই কথা বলে। তবে এর মধ্যে রোগীর সিজারের সেলাই খুলে যায়। এতে রোগীর পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে যায়। সেলাই খোলা অবস্থায় প্রায় ৫ দিন হাসপাতালে পড়ে থেকে যান্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। তিনি আরো বলেন, ‘সবশেষে আমার মেয়ের অবস্থার অবনতি দেখে তাকে ফ্যামিলি ল্যাব হাসপাতালে চিকিৎসায় জন্য নিয়ে গেলে তার পেট থেকে গজ বের করা হয়।

২৫ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জে অপারেশনের মাধ্যমে ক্লিনিকে প্রসবেব করানোর সময় নবজাতকের মাথার একটা অংশ কেটে ফেলেছেন চিকিৎসক। কেটে ফেলা স্থানে চারটি সেলাই করা হলেও স্বজনদের জানানো হয়নি বিষয়টি।। জন্মের পর থেকেই কাটা স্থানে তুলা ও তোয়ালে দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল। জন্মের ৭ ঘণ্টা পর শিশুটির মৃত্যু হয়। দাফনের জন্য গোসল করাতে গেলে মাথার ক্ষত ও সেলাইয়ের চিহ্ন দেখতে পান স্বজনরা। মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বালিরটেক একতা ক্লিনিকে এ ঘটনা ঘটে। ক্ষুব্ধ স্বজনরা নবজাতকের মরদেহ নিয়ে পরের দিন দুপুরে ক্লিনিক ঘেরাও করে। পরে পুলিশ উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। সংবাদ মাধমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়- সদর উপজেলার ভাড়ারিয়া ইউনিয়নের ভাড়ারিয়া গ্রামের মিশুক রানার স্ত্রী মাকসুদার প্রসব বেদনা উঠলে তাঁকে একতা ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। কিন্তু সন্তান প্রসব করাতে গিয়ে এ কান্ড ঘটান ডাক্তারগণ। শিশুটির বাবা মিশুক রানা বলেন, প্রসব করানোর সময় তার মেয়ের মাথায় আঘাতের কথা তাদের কাছে ডাক্তার, নার্স কেউ বলেননি। আঘাত লুকিয়ে রাখার জন্য তুলা এবং তোয়ালে দিয়ে ঢেকে রেখেছিলো। তিনি অভিযোগ করেন, ডাক্তারের অবহেলার কারণেই তার মেয়ের মৃত্যু হয়েছে।

গত ১২ ডিসেম্বর রাজশাহীতে স্বাধীনা আকতার শিলা (২২) নামের এক প্রসূতির সিজারে সন্তান প্রসবের সময় পেটে গজ রেখে সেলাই করেন এক চিকিৎসক। সন্তান প্রসবের পর দীর্ঘদিন ধরে সুস্থ না হওয়ায় আরও দুই দফা অস্ত্রোপচার করা হয় তাঁকে। তবে শেষ দফা অস্ত্রোপচারে অপসারণ করা হয়েছে পেটের গজ। স্বাধীনা আকতার শিলা রাজশাহী জেলার চারঘাট উজেলার নন্দনগাছি ফকিরপাড়া এলাকার হাফিজুর রহমানের স্ত্রী। সংকটাপন্ন ঐ নারী দীর্ঘদিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের চিকিৎসাধীন ওই গৃহবধূ। তবে জন্মের তিন দিনের মাথায় মারা গেছে তাঁর নবজাতক। শিলা সাংবাদিকদের জানান, তার শরীরে প্রায়ই প্রচন্ড জ্বর থাকছে। কাটা জায়গায় ব্যথা হচ্ছে। কিছু খেলেই বমি হচ্ছে। তার এ অবস্থার জন্য ভুল চিকিৎসাকে দায়ী করেছেন তিনি।
সম্প্রতি পটুয়াখালীর বাউফলের একটি ক্লিনিকে মাকসুদা বেগম নামে এক প্রসূতির পেটে গজ রেখে সেলাই করেন এক চিকিৎসক। ওই ঘটনায় ভুল অস্ত্রোপচারের শিকার ওই গৃহবধূকে ৯ লাখ টাক ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়- ২০১৭ সালের ২২ জুলাই একটি জাতীয় দৈনিকে ‘সাড়ে তিন মাস পর পেট থেকে বের হলো গজ!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জনাব মোহাম্মদ শহিদ উল্লাহ আদালতের নজরে আনার পর রুলসহ হাইকোর্ট আদেশ দেন। ওই পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অস্ত্রোপচারের সাড়ে তিন মাস পর বরিশালের মাকসুদা বেগম (২৫) নামের এক নারীর পেট থেকে গজ বের করা হয়েছে। মুমূর্ষু অবস্থায় ওই নারীকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয় বেশ কয়েকদিন। চিকিৎসকরা বলেন, দীর্ঘদিন পেটের ভেতর গজ থাকায় খাদ্যনালীতে অনেকগুলো ছিদ্র হয়ে গেছে। মাকসুদা বেগমের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাঁকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। মাকসুদা পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বিলবিলাস গ্রামের মোহাম্মদ রাসেল সরদারের স্ত্রী। গত মার্চ মাসে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মাকসুদা বেগম একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। তখন তাঁর পেটে গজ রেখে সেলাই করে দেন চিকিৎসক।’ মাকসুদার মা রোকেয়া বেগম বলেন, ‘গত মার্চে সন্তান প্রসবের জন্য মাকসুদাকে বাউফলের নিরাময় ক্লিনিকে নেয়া হয়। অস্ত্রোপচার করে মাকসুদার একটি মেয়ে হয়। কয়েক দিন ক্লিনিকে থাকার পর তারা বাড়ি ফেরেন।

http://www.dailysangram.com/post/316686