২৫ জানুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৭:৩০

অযত্ন অবহেলায় ডুবছে জাতীয় চিড়িয়াখানা

কিছুদিন আগেও বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখিতে ভরপুর ছিল চিড়িয়াখানার ছোট ছোট ঘরগুলো। দর্শনার্থীরা আনন্দ পেত। এখন বেশির ভাগ ঘরই খালি, কিছু ঘরে প্রাণী থাকলেও সংখ্যায় খুব কম। প্রাণীগুলোর মধ্যেও বেশির ভাগ অসুস্থ, নিস্তেজ ও মৃতপ্রায়। চিড়িয়াখানার সার্বিক পরিবেশও আগের মতো নেই, বলছিলেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে টাঙ্গাইল থেকে ঘুরতে আসা আব্দুল মজিদ খান।

অভিযোগ রয়েছে, কর্তৃপক্ষ সার্বিক পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে ময়লা আবর্জনার সাথে চিড়িয়াহীন করে ফেলেছে চিড়িয়াখানাকে। তবে চিড়িয়াখানার সার্বিক তদারকিতে যারা আছেন তারা কথা বলতে রাজি হননি এ ব্যাপারে।

কিউরেটর ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, প্রাণীর আয়ুষ্কাল অতিক্রান্ত হয়ে মারা গেছে অনেক প্রাণী। অন্য দিকে, গত ৭ বছরের অধিক সময় নতুন করে কোনো প্রাণী ক্রয় করা হয়নি চিড়িয়াখানার জন্য।

ঢাকার বিনোদন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে শীর্ষে থাকা জাতীয় চিড়িয়াখানা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিভিন্ন বয়েসী নারী-পুরুষ-শিশুদের অন্যতম আকর্ষণ। বছরে ৪০ লাখের বেশি দর্শক সমাগম হয় এখানে। কিন্তু দর্শকপ্রিয়তায় শীর্ষে থাকা বিনোদনের এ কেন্দ্রটির সার্বিক পরিবেশ, প্রাণিবৈচিত্র্য ও সুযোগ-সুবিধা দর্শকবান্ধব নয়। সে কারণেই এখন পর্যন্ত ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব জু অ্যান্ড অ্যাকুরিয়ামসের (ওয়াজা) সদস্য হতে পারেনি চিড়িয়াখানাটি।

তথ্য কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে ১৮৭ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত চিড়িয়খানায় ১১২ প্রজাতির ১ হাজার ৭৬৭টি প্রাণী ও পাখি রয়েছে। তবে খাঁচার বিন্যাস, প্রাণী সংরক্ষণ, দর্শনার্থীদের যথাযথ সুবিধার স্বল্পতাসহ কোনো কিছুই মান উপযোগী নয়। চিড়িয়াখানা অ্যাক্ট না থাকা, সার্বিক অবকাঠামোগত অবস্থা ও ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির কারণেই এখন পর্যন্ত ওয়াজার সদস্য হতে পারেনি বাংলাদেশ। ফলে আন্তর্জাতিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এ প্রতিষ্ঠানটি।

উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠার পর তত্কালীন ঢাকা জাতীয় চিড়িয়াখানা ও রংপুর চিড়িয়াখানাকে বিশ্বমানের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য ২০১২ সালে ৩৪৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। তবে তা নানা জটিলতায় পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কয়েকটি ঘরে নামমাত্র কিছু প্রাণী ছাড়া ১৩৭টির মধ্যে বেশ কিছু খাঁচা প্রাণিশূন্য হয়ে পড়েছে। পশু-পাখির কিছু কিছু শেড অকেজো হয়ে আছে। সেগুলো মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। অবশ্য পুরনো ও অকেজো হয়ে যাওয়ায় কিছু খাঁচা ব্যবহার করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন কর্মরত সংশ্লিষ্টরা। শেডের আশপাশ ঘিরে নানা স্থানে রয়েছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। কিছু খাঁচার বাইরে নির্দেশিকা বোর্ড থাকলেও অনেক খাঁচার বাইরে কোনো বোর্ড নেই। নির্দেশিকা বোর্ডে প্রাণী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ থাকার কথা তাকলেও কোনো কোনো বোর্ডের লেখা উঠে গেছে। প্রাণীর খাঁচার কাছাকাছি নিরাপত্তা প্রহরী বা দায়িত্বরতদের তেমন উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। দর্শকদের জন্য যে পাবলিক টয়লেট রয়েছে, তা নোংরা এবং ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ৫ টাকা প্রবেশমূল্যে চিড়িয়াখানার অভ্যন্তরীণ প্রাণী জাদুঘরে ঢুকে দেখা যায়, পর্যাপ্ত যত্নের অভাবে রয়েছে মাছের অ্যাকুরিয়ামগুলো। খালি পড়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি।

শিশুদের বিনোদনের জন্য স্থাপিত শিশু-পার্কে অকেজা কিছু বিনোদনসামগ্রী ব্যতীত ব্যবহারোপযোগী তেমন কোনো উপকরণ নেই। সেখানকার পরিবেশও অপরিচ্ছন্ন। পার্কের ভেতরে বসার জন্য নান স্থানে তৈরি করে রাখা বেঞ্চগুলো নোংরা ও ভাঙাচোরা। অন্য দিকে, চিড়িয়াখানার অভ্যন্তরে স্থায়ীভাবে রেস্টুরেন্টসহ যেখানে সেখানে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে বসেছে ভাসমান দোকান। চিড়িয়াখানার ভেতরে দর্শনার্থীদের নানাভাবে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে হয়রানি করছে সংঘবদ্ধ চক্র। পশুপাখির খাবারের টাকা কর্তৃপক্ষের পেটে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মচারী। এ বিষয়ের সত্যতা নিশ্চিত করে চিড়িয়াখানার প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. কামাল বলেন, এমন অভিযোগ বরাবরই ছিল।

প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ জনবল সংকট ও সঠিক সেবাযত্নের অভাবে অনেক প্রাণীকে অকালে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। অনেক প্রাণীই বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছে, হারিয়েছে চলাচলের সক্ষমতা। অনেক প্রাণির আয়ুষ্কাল অতিক্রান্ত হওয়ায় রয়েছে মৃত্যুঝুঁকিতে। এই দুর্বল প্রাণীগুলোকেই খাঁচায় রাখা হয়েছে প্রদর্শনীর জন্য, যা দেখে দর্শনার্থীরাও এক প্রকার বিরক্তই হচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, দরদাতা প্রতিষ্ঠানের সংকটের কারণে বিদেশ থেকে চাহিদা অনুযায়ী প্রাণী আনা যাচ্ছে না। প্রতিবছর প্রাণী মারা যাওয়ার বিপরীতে নতুন প্রাণী আনা না হলে চিড়িয়াখানায় চিড়িয়াশূন্য হয়ে যেতে পারে বলে সংশয় প্রকাশ করেন ঐ কর্মকর্তা।

চিড়িয়াখানায় এক কর্মকর্তা দৈনিক ইত্তেফাককে বলেন, ‘এখানে প্রাণীদের চিকিত্সা সেবার নামে কিছুই হচ্ছে না। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিত্সক ডা. নাজমুল হুদা বলেন, প্রাণী চিকিত্সকদের প্রশিক্ষণের অভাব এবং পশু-চিকিত্সকের স্বল্পতার কারণে চিকিত্সাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। আর এ কারণে প্রতিনিয়ত পশু-পাখি অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আর বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।

http://www.ittefaq.com.bd/capital/2018/01/24/144652.html