২৫ জানুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৫:৩৪

ডলারের দামে উল্লম্ফন আমদানিকারকরা বিপাকে

বিশ্লেষকদের মত : নির্বাচনের বছরে অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ায় ডলারের দামে লাগাম টানা কঠিন হয়ে পড়েছে

হঠাৎ হু হু করে বাড়ছে ডলারের চাহিদা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডলারের দামও। বেড়ে যাচ্ছে আমদানি ব্যয়। ফলে কাঁচামালসহ মেশিনারিজের জন্য আমদানিনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিপাকে পড়তে হচ্ছে। উৎপাদন ব্যয়ও বাড়ছে। ডলারের এ উল্লম্ফন সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রশ্ন হল, এমনটি কেন হচ্ছে। উত্তরে বিশ্লেষকদের অনেকে জানিয়েছেন, যখন অর্থ পাচার বেড়ে যায় তখন ডলারের দাম বাড়ে। দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখা দিলেও এমনটি হতে পারে। অসাধু ব্যক্তিদের অনেকে দেশ থেকে অর্থ সরিয়ে নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। সর্বোপরি তারা মনে করেন, নির্বাচনের বছর হওয়ায় অর্থ পাচার বেড়ে গেছে। অতীতেও এ রকম নজির রয়েছে। তবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণে এবার বেশি বলে মনে হচ্ছে।

সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ১২৫ কোটি ডলার বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করেছে। এর মধ্যে গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবারই বিক্রি করা হয় ৪ কোটি ডলার। এতেও লাভ খুব বেশি হচ্ছে না। মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করেছে ৮২ টাকা ৯০ পয়সা দরে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো ওই দরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনেছে। আর তারা গ্রাহকের কাছে বিক্রি করার সময় নিচ্ছে আরও বেশি। কোনো কোনো ব্যাংক ৮৪ টাকার বেশি দামেও ডলার বিক্রি করেছে। এ পরিস্থিতিতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান গত এক বছরে ক্রমাগত কমছে। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এবং রফতানি আয়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কিন্তু বাস্তবতা হল, হিসাব কষলে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ অনেকগুণ বেশি। কারণ বছরে আমদানিতে জোগান দিতে হয় ৪২ বিলিয়ন ডলার বা ৩ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা, যা রফতানি আয়ের বিপরীতে অনেক বেশি।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি বাড়ার পাশাপাশি প্রচুর অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। তবে এ কথা ঠিক যে, আমদানি বাড়ার কারণে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। আমদানি ব্যয় যেভাবে বাড়ছে; রফতানি আয় তার চেয়ে অনেক কম হারে বাড়ছে। রেমিটেন্স প্রবাহের গতিও খুব বেশি নয়। তিনি বলেন, অর্থনীতির নিয়মানুযায়ী চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় স্বাভাবিকভাবেই দর বাড়ছে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হল, অর্থের বিরাট একটা অংশ বিদেশে পাচার হচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

আহসান মনসুর বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই এটা হয়ে আসছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ কারণে পাচার আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সজাগ দৃষ্টি রাখা দরকার বলে মনে করেন তিনি।

পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালকের মতে, কোনো কারণে অনিশ্চয়তা বাড়লে অর্থ পাচারের প্রবণতাও বাড়ে। রাজনৈতিক দলের নেতারা যেমন পাচার করেন, তেমনি ব্যবসায়ী বা আমলারাও অর্থ বাইরে নিয়ে যান। আর এক শ্রেণীর লোক পারিবারিকভাবেই বিদেশে অবস্থানের জন্য অর্থ পাচার করেন।

আহসান মনসুর বলেন, বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে মূলত তিন ভাগে। প্রবাসীদের মাধ্যমে যে রেমিটেন্স দেশে আসার কথা সেটা না এসে তৃতীয় একটি পক্ষের মাধ্যমে তা কানাডা-আমেরিকায় চলে যাচ্ছে। যে রেমিটেন্স ব্যাংকিং চ্যানেলে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হওয়ার কথা, তা দেশে না এসে বাইরেই থেকে যাচ্ছে। দেশ থেকে অর্থ পাচারের একটি পথ হচ্ছে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েস দেখানো। অর্থাৎ যে দামে পণ্য কেনা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি দাম দেখিয়ে বাড়তি অর্থ বিদেশে পাচার হয়। আবার যে পণ্য আমদানি হওয়ার কথা, তার বদলে কম দামি পণ্য আনা অথবা খালি কনটেইনার আনার ঘটনাও ধরা পড়েছে কখনও কখনও। আবার পণ্য রফতানিতে আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হয়। যে পণ্যের দাম ১০০ ডলার, ক্রেতার সঙ্গে বোঝাপড়া করে তা ৭০ ডলার দেখিয়ে রফতানি করেন ব্যবসায়ীরা। বাকি ৩০ ডলার তিনি বিদেশে সেই ক্রেতার কাছ থেকে নিয়ে তা বিদেশেই রেখে দেন।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। বিশেষ করে নির্বাচনী বছর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থাকলে অর্থ পাচারের সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। তিনি বলেন, চাল, ডালসহ ভোগ্য পণ্যের নামে কি আসছে তা খতিয়ে দেখা খুব কঠিন কাজ নয়। শুধু সদিচ্ছা থাকলেই এটি সম্ভব।

অর্থ পাচার প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি সংস্থার বরাত দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন গত বছর এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ২০০৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। সূত্র জানায়, ২০১২ সালের প্রথম দিকে টাকার বিপরীতে ডলারের দর বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে ৮৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এরপর থেকে তা কমতে কমতে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ৮০ টাকার নিচে নেমে আসে।

২০১৭ সালের প্রথম দিকেও ডলারের দর ছিল ৮০ টাকার নিচে। বছরের মাঝামাঝি সময়ে তা ৮০ টাকা ছাড়ায়; এখনও তা অব্যাহত রয়েছে।

২০০৩ সালে দেশে ভাসমান মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা (ফ্লোটিং) চালু হয়। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। তার আগ পর্যন্ত টাকা-ডলারের বিনিময় হার বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিক করে দিত।

মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক ৮২ টাকা ৯০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করলেও বেসিক ব্যাংক ৮৪ টাকা, আইএফআইসি ব্যাংক ৮৪ টাকা ৪৫ পয়সা এবং এবি ব্যাংক ৮৪ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি করেছে ডলার।

এক বছর আগে এ এক ডলারের জন্য লাগত ৭৮ টাকা ৯০ পয়সা। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৫ শতাংশের বেশি। ছয় মাসের ব্যবধানে কমেছে প্রায় ৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ ও ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সাড়ে ৬ মাসে (২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি) পর্যন্ত ১২৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) আমদানি ব্যয় যেখানে ২৯ শতাংশ বেড়েছে, সেখানে রফতানি আয় ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং রেমিটেন্স ১২ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/10760