খুলনায় পাটকল শ্রমিকদের ভুখা মিছিল
২৫ জানুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১:১৬

খুলনায় পাটকল শ্রমিকদের ভুখা মিছিল ॥ ট্রেনের গ্লাস ব্যাংক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর

পাটের তৈরি চটের জামা গায়ে ভিক্ষুকের বেশে খুলনায় খাবারের থালা-বাসন হাতে ভুখা মিছিল করেছে পাটকলের শ্রমিকরা। বকেয়া মজুরি ও মজুরি কমিশন গঠনসহ ১১ দফা দাবিতে রাষ্ট্রায়াত্ব ৮টি পাটকলের শ্রমিকরা এ মিছিল করেন। জুটমিল সিবিএ-ননসিবিএ ঐক্য পরিষদের উদ্যোগে মাসব্যাপী আন্দোলন কর্মসূচির অংশ হিসেবে কর্মবিরতির পাশাপাশি গতকাল বুধবার দুপুরে নগরীতে ভুখা মিছিল করে শ্রমিক-কর্মচারীরা।

প্লাটিনাম, ক্রিসেন্ট, খালিশপুর, দৌলতপুর ও স্টার জুট মিলের শ্রমিকরা হাতে থালা, বাসন ও ঘটিবাটি নিয়ে স্ব স্ব মিল থেকে ভুখা মিছিল বের করে। পরে মিছিলটি বিআইডিসি রোড, দৌলতপুর নতুন রাস্তা, বিএল কলেজ রোড, কাশিপুর ও লাল হাসপাতাল রোড ঘুরে ক্রিসেন্ট মিলের সামনে এসে শেষ হয়। এ সময় শ্রমিকদের বুকে ঝোলানো প্ল্যাকার্ডে দাবি আদায়ের নানা শ্লোগান লেখা দেখা যায়। অনাহারী এ সব শ্রমিকরা পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম ও বিজেএমসির চেয়ারম্যানকে অযোগ্য ঘোষণা করে তাদের পদত্যাগের দাবিতে শ্লোগান দেয়।

ভুখা মিছিল চলাকালে শ্রমিকরা নতুন রাস্তার মোড় রেল ক্রসিংয়ে খুলনা থেকে রাজশাহীগামী একটি ট্রেনে ব্যাপক ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং ট্রেনের গ্লাস ভাঙচুর করে। এছাড়া খালিশপুর লির্বাটি কমপ্লেক্সের উত্তরা ব্যাংকের জানালার গ্লাস ও পাওয়ার হাউজের সামনের রূপালী ব্যাংকের জানালার গ্লাস ভাঙচুর করা হয়। এ সময় উক্ত এলাকায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। মুহূর্তের মধ্যে এলাকার দোকান-পাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ দিকবিদিক ছোটাছুটি শুরু করে। পরে শ্রমিক নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

ভুখা মিছিল শেষে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তৃতা করেন-জুটমিল সিবিএ-ননসিবিএ ঐক্য পরিষদের কার্যকরী আহ্বায়ক সোহরাব হোসেন, সাবেক সিবিএ সভাপতি দীন মোহাম্মদ, প্লাটিনামের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমান, কওছার আলী, গাজী মাসুম. আবু হানিফ, জাফর আহমেদ, জাকির হোসেন, আব্দুর রশিদ, আবু হানিফসহ বিভিন্ন পাটকলের সিবিএ নেতারা।

শ্রমিক নেতারা জানান, ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি পাটকল শ্রমিকরা ৪৮ ঘণ্টার রাজপথ রেলপথ অবরোধের কর্মসূচি পালন করবেন। যাতে সব শ্রমিকদের উপস্থিত থাকার আহ্বান জানানো হয়।

খুলনা রেলওয়ে থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান জানান, মহানন্দা ট্রেনটি যাওয়ার সময় আন্দোলনকারী শ্রমিকরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে কিছু গ্লাস ভেঙ্গে যায়। তবে কোন হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

রাষ্ট্রায়ত্ত জুট মিল সিবিএ-ননসিবিএ পরিষদের কার্যকরী আহ্বায়ক মো. সোহরাব হোসেন বলেন, পরিষদ ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বুধবার সকালে ভুখা মিছিল বের করা হয়। আর মিলে টাকা আসলেও বিজেএমসি ও মিল কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করছে না। এতে শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ বাড়ছে।

পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক মো. খলিলুর রহমান বলেন, ‘শ্রমিকদের পাওনা মজুরি পরিশোধের দায়িত্ব মিল কর্তৃপক্ষের। মিল বন্ধ করেছে শ্রমিকরা। এখন টাকা না পেলে শ্রমিকরা মিল চালু করবে নাকি করবে না এটা তাদের ব্যাপার। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কোন আইনে নেই শ্রমিকদের মজুরি দীর্ঘদিন আটকে রাখা। অথচ আজ প্রায় ১১ থেকে ১২ সপ্তাহের মজুরি বিজেএমসি আটকে রেখেছে। আর শ্রমিকদের মজুরির টাকা আসলেও মিল কর্তৃপক্ষ সেটি পরিশোধ করছে না। পরিশোধতো করছে না, একই সাথে শ্রমিকদের সাথে আলোচনা করে মিল চালু করছে না। সুতরাং পেমেন্ট দেয়া এবং মিল চালু করা দু’টোই বিজেএমসি ও মিল কর্তৃপক্ষের দায়। তবে বিজেএমসির খুলনার আঞ্চলিক সমন্বয়কারী গাজী শাহাদাৎ হোসেন বলেন, শ্রমিকরা মিল চালু করছে না। মিল চালু না হলে মজুরি পরিশোধ করা হবে না এটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত।

এদিকে কঠোর অবস্থানে বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশন। বন্ধ পাটকল চালু না হওয়া পর্যন্ত শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ করা হবে না এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বিজেএমসির পক্ষ থেকে। গত মঙ্গলবার বিজেএমসির মহাব্যবস্থাপক (হিসাব ও অর্থ) মো. আব্দুল মালেক স্বাক্ষরিত এক পত্রে চালু থাকা দেশের ১২টি পাটকলের শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। আর বন্ধ পাটকলের মজুরি ও ডিএ মিল চালু হওয়ার পর পরিশোধ করা হবে বলে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

বিজেএমসির ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, মিলসমূহের শ্রমিকদের বেশ কয়েক সপ্তাহের মজুরি বকেয়া রয়েছে। এছাড়া ২০ শতাংশ মহার্ঘভাতা বাবদও কিছু বকেয়া পাওনা রয়েছে। গোল্ডেন ফাইবার ট্রেড সেন্টার লিমিটেড এর নিকট সম্প্রতি বিক্রিত বি-টুইল পণ্যের অর্থ পর্যায়ক্রমে পাওয়া যাচ্ছে। বকেয়া মজুরি ও ২০ শতাংশ বকেয়া ডিএ এর ৬০ শতাংশ, জুট কাটিং ও সুতার বকেয়া, গালফ্রা হাবিব এর বকেয়া পাওনা প্রাপ্ত টাকার আনুপাতিক হারে এবং বকেয়া এক মাসের বেতন পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

চিঠিতে খুলনার খালিশপুর জুট মিলের ৩ সপ্তাহের মজুরি এবং দৌলতপুর জুট মিলের ২ সপ্তাহের মজুরি, যশোরের কার্পেটিং জুট মিলের ৫ সপ্তাহের মজুরি, বাংলাদেশ জুট মিলের ৩ সপ্তাহ, করিম জুট মিলের ২ সপ্তাহ, রাজশাহী জুট মিলের ৪ সপ্তাহ, আমিন জুট মিলের ৪ সপ্তাহ, গুল আহমদ জুট মিলের ৪ সপ্তাহ, হাফিজ জুট মিলের ৪ সপ্তাহ, বিডিসিএফ জুট মিলের ৩ সপ্তাহ, এম এম জুট মিলের ৪ সপ্তাহ, কেএফডি জুট মিলের ৪ সপ্তাহের মজুরি এবং ২০ শতাংশ ডিএ’র বকেয়া ৬০ শতাংশ পাওনা পরিশোধের কথা বলা হয়েছে।

এতে আরো উল্লেখ করা হয়, বন্ধ থাকা মিলগুলোর মজুরি ও ডিএ মিল চালু হওয়ার পর পরিশোধযোগ্য। যে সকল মিলে মজুরি বকেয়া নেই সে সকল মিলে ফান্ডপ্রাপ্তি সাপেক্ষে বকেয়া মহার্ঘ ভাতার ৬০ শতাংশ পরিশোধ করতে হবে। অগ্রাধিকার প্রদান পূর্বক পরিশোধ করতে হবে। পাটপণ্য বিক্রয়ের অর্থপ্রাপ্তি সাপেক্ষে উপযুক্ত বর্ণনা মোতাবেক অগ্রাধিকার প্রদান পূর্বক পরিশোধ করতে হবে। একই সঙ্গে অর্থ প্রাপ্তি সাপেক্ষে পাট ক্রয়ের পাওনা পরিশোধেরও ব্যবস্থা নিতে হবে।

অপরদিকে বকেয়া মজুরি পরিশোধসহ ১১ দফা দাবিতে খুলনার ৮ পাটকলের অর্ধলক্ষ শ্রমিক পরিবারে এখন চরম দুরাবস্থা। সবার ঘরের একই চিত্র ঘরে খাবার নেই, ছেলে মেয়েদের নতুন বছরে ভর্তি বন্ধ, অসুস্থদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। চরম মানবেতর দিনযাপন করছে এ শ্রমিক পরিবারগুলো।

প্লাটিনাম জুটমিলের শ্রমিকবধূ শাহানাজ পারভীন বললেন, আমাদের অবস্থা যে কত করুণ, তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব না। টাকার অভাবে ছেলেকে নাইনে ভর্তি করতে পারিনি। অসুস্থ স্বামী ও ছেলেকে ওষুধ খাওয়াতে পারছিনা। ৩ মাস অতিবাহিত হয়েছে-তার স্বামী কোন মজুরি পায়নি। যে কারণে তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চরম অভাব অনটনে দিনাতিপাত করছেন। তার বড় ছেলে অনার্স ফাইনালের ছাত্র সজল ও সজলের পিতা দু’জনেই অসুস্থ। সজলের অপারেশন করিয়েছেন ধার দেনা করে। কিন্তু এখন পথ্য তো দূরে থাক এক মুঠো ভাত তুলে দিতে পারছেন না অসুস্থ ছেলের মুখে।

বিধবা আলেয়া বেগমের এক ছেলে অস্থায়ী চাকরি করে পাটকলে। গতরাতে এক বেলা খেয়েছেন আজ এখন পর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের মুখে কোন খাবার দিতে পারেননি বলে জানান আলেয়া বেগম (৫৮)।

ক্রিসেন্ট জুটমিলের শ্রমিক সুলাইমান তার এক মেয়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ছে। তার সেমিস্টার খরচ দিতে না পারায় তার লেখাপড়া বন্ধ হবার উপক্রম। অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে।

শ্রমিক নেতা সোহরাব হোসেন আরো বলেন, শ্রমিদের ন্যায্য মজুরি না দিয়ে নিজেদের বেতন ভাতা নিচ্ছেন বিজেএমসি কর্মকর্তারা। তাদের ব্যর্থতার কারণে পাটজাত পণ্য রফতানি যথাযথভাবে হচ্ছে না। সে দায় কেন শ্রমিকদের ঘাড়ে চাপাবে। শ্রমবান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাটকল শ্রমিকদের উন্নয়ন, পাটকলের আধুনিকীকরণে এক হাজার কোটি টাকা দিয়েছেন। অথচ শ্রমিকরা আজ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। মন্ত্রণালয় ও বিজেএমসির কাছে এর জবাদ নেয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

বিজেএমসির খুলনা আঞ্চলিক অফিসের প্রধান গাজী শাহাদাত হোসেন জানান, সুদানে পাটপণ্য বিক্রির টাকা অল্পদিনের মধ্যে হাতে পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। এ টাকা হাতে পেলে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি দেয়া সম্ভব হবে। শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা এখন প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি হয়তো কোন সমাধানের কথা বলবেন। এ প্রত্যাশায় খুলনাসহ সকল পাটকলের শ্রমিক পরিবার।

উল্লেখ্য, গত ২৮ ডিসেম্বর থেকে বকেয়া মজুরির দাবিতে খালিশপুর, প্লাটিনাম, ক্রিসেন্ট, দৌলতপুর, স্টার জুট, আলীম, ইস্টার্ণ, জেজেআই জুট মিলের উৎপাদন বন্ধ করে দেয় শ্রমিকরা। গত বৃহস্পতিবার আংশিক মজুরি পাওয়া সাপেক্ষে খালিশপুর ও দৌলতপুর জুট মিল চালু হলেও বাকী ছয়টি পাটকলের শ্রমিকরা উৎপাদন বন্ধ রেখেছে।

http://www.dailysangram.com/post/316527