ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভিসির কার্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা
২৪ জানুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ১০:১৬

ফের ঢাবিতে শিক্ষার্থীদের ওপর তাণ্ডব ছাত্রলীগের

দফায় দফায় সংঘর্ষে আহত অর্ধশতাধিক

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে রাজধানীর সাত সরকারি কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়নের বিচারসহ ৪ দফা দাবিতে ফের আন্দোলনে নামলে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের ওপর তাণ্ডব চালায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এ সময় দফায় দফায় সংঘর্ষে শিক্ষার্থী-ছাত্রলীগসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। আহতদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টার ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কয়েক দফায় এই হামলা চালানো হয়।
জানা যায়, পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে ৪ দফা দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবিগুলো হলোÑ যৌননিপীড়ক ছাত্রলীগ নেতাদেরকে বহিষ্কার, অধিভুক্ত সাত কলেজের সঙ্কট দ্রুত নিরসন করতে হবে, অজ্ঞাতনামা মামলা প্রত্যাহার এবং প্রক্টরের পদত্যাগ।

সরেজমিন জানা যায়, কর্মসূচির অংশ হিসেবে বেলা ১১টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন শেষে ভিসির কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধন শেষে একটি মিছিল নিয়ে দুপুর ১২টায় প্রশাসনিক ভবনের প্রধান ফটকের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন তারা। এরপর ১২টা ৫০ মিনিটে ভবনের ভেতরে ঢোকার প্রথম গেটের তালা ভাঙেন তারা। ১টা ৪০ মিনিটে ভেতরের দ্বিতীয় তালা ভেঙে ভিসির কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় তারা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন।
আন্দোলনকারীদের দ্বারা এ সময় ভিসি তার নিজের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসানসহ ছাত্রলীগের ২০-২৫ জন নেতাকর্মী ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। তারা ভিসিকে মুক্ত করে ফের তার কার্যালয়ে নিয়ে যান। এ সময় ভিসি কক্ষের সামনের করিডোরে অবস্থান নেয়া আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রড নিয়ে তাড়া করে কয়েকজনকে মারধরও করেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
এরপর কিছুক্ষণের জন্য অবরোধকারীদের ভিসির দরজার সামনে রেখে সরে গেলেও বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বিভিন্ন হল থেকে বিপুলসংখ্যক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী এসে লোহার রড, স্টাম্প, বাঁশ, লাঠিসোটাসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। হামলার পর ভিসি কার্যালয় থেকে সিনেট ভবনের দিকে যাওয়ার ফটক দিয়ে চলে যেতে চাইলেও সেখানে আরেক দল ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর হামলার শিকার হন আন্দোলনকারীরা। ছাত্রলীগের ধাওয়া খেয়ে প্রশাসনিক ভবনের ভেতর দিয়ে মূল ফটক হয়ে বেরিয়ে যেতে চান আন্দোলনকারীরা। কিন্তু ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ধাওয়া করে আন্দোলনকারীদের মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
আহতদের মধ্যে ছিলেন, ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী, আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র মাসুদ আল মাহাদী, আবু রায়হান খান, রাজীব দাস, ছাত্র ফেডারেশনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের প্রগতি বর্মন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সহসভাপতি মীর আরশাদুল হক, তুহিন কান্তি দাস, অপু, সালমান সিদ্দিকী, রিয়াজ, সুদীপ, সোহেল রানা, ইরা, শাকিল, শফিক, ইভা, সাদিক, নাদিম, মাকসুদা, মৌরী, লামিয়া, জামিল। এ ছাড়াও বাকিদের নাম জানা যায়নি।

এ ছাড়াও ছাত্রলীগ নেতাদের হামলার শিকার হন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। ভাঙচুর করা হয় বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা। এরপর সেখান থেকে পালিয়ে যেতে চাইলে প্রশাসনিক ভবনের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে ধরে মারা হয় আন্দোলনকারীদের। বিকেল ৫টায় পরিস্থিত নিয়ন্ত্রণে আসে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ সময় বাম সংগঠনের কর্মী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃৎশিল্প বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তানভীর হোসেন মুঈন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে ঘুষি মারেন। এ ছাড়াও তাদের মারধরের শিকার হয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন আহত হন। বাম নেতাকর্মীদের ঘুষিতে তার ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হয়।
এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি ইভা মজুমদার বলেন, আমরা নিপীড়কদের বিচার চাইতে এসেছিলাম। কিন্তু ছাত্রলীগ আমাদের ওপর উল্টা হামলা চালায়। এতে আমাদের অনেক নেতাকর্মী আহত হন। আহতরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বিশ^বিদ্যালয় মেডিক্যালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
এ দিকে ভিসির কার্যালয়ে হামলাকারীদের বহিষ্কার ও বিচার দাবি করেছে ছাত্রলীগ। বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোতহার হোসেন প্রিন্স বলেন, আমরা ভিসির কার্যালয়ে হামলাকারীদের বহিষ্কার ও বিচার দাবি করছি। সংঘর্ষের ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এস জাকির হোসাইন বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীরা অবরুদ্ধ ভিসি স্যারকে উদ্ধার করতে গিয়েছে। এ সময় অবস্থানরত বাম সংগঠনের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করলে আমরা মীমাংসা করার চেষ্টা করেছি। সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে দাবি করেন জাকির হোসাইন। সার্বিক বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, আন্দোলনের নামে এখানে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যমূলক কার্যক্রম ঘটানো হচ্ছে। বিশ^বিদ্যালয়ের সম্পদের হানি ঘটানোর চেষ্টা হচ্ছে। আমাদের মনে হয় এটি পূর্বপরিকল্পিত এবং কেউ কেউ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ বিঘিœত করার প্রয়াসে লিপ্ত আছে।
এ দিকে গত সোমবার ছুটির দিন থাকায় গতকাল মঙ্গলবার সকালে শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে তিনজন প্রতিনিধিকে চিঠি দিয়ে ডাকা হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে দাবি করা হয়। তিনজন হলেনÑ উম্মে হাবীবা বেনজির, আবু রায়হান খান এবং হাসিব মোহাম্মদ আশিক। কিন্তু তারা তদন্ত কমিটিতে আসেনি বলে অভিযোগ প্রশাসনের।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর আবু হোসেন মুহম্মদ আহসান বলেন, গতকাল সকাল ১০টায় রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. জিনাত হুদার কক্ষে আয়োজিত তদন্ত কমিটির সভায় আসার জন্য আমরা তিনজনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। শিক্ষার্থীদের দেয়া অভিযোগপত্রে কোনো অভিনযুক্তের নাম উল্লেখ করা হয়নি বলেও জানান তিনি।

সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে প্রথমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ডাকে আন্দোলন হলেও গত ১৭ জানুয়ারি থেকে তা বাম ছাত্র নেতাদের আন্দোলনে রূপ নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের ইন্ধন রয়েছে বলেও জানা যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক নয়া দিগন্তকে বলেন, আন্দোলনকারীরা নিজেদেরকে বাম সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সামনে রেখে একজনের ইশারায় কলকাঠি নাড়ছেন। তার সাথে গোপনে বৈঠক করেছেন তারা।
এ দিকে ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে তাৎক্ষণিক মিছিল বের করেন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা ছাত্রলীগের ন্যক্কারজনক হামলার সমালোচনা করেন। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় কথায় কথায় ছাত্রলীগকে উসকে দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমালোচনা করেন। বিক্ষোভ মিছিলপরবর্তী সমাবেশে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ সারা দেশে এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়াও আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন তারা। এ থেকে পরবর্তী করণীয় জানাবেন তারা।
এর আগে গত ১৫ জানুয়ারি রাজধানীর সরকারি সাত কলেজকে বিশ^বিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা ও ছাত্রী উত্ত্যক্তের বিচারসহ চার দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীরা। শুরুতে এটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থাকলেও একপর্যায়ে এতে বাম ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা যোগ দেন।


 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/287655