২৪ জানুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ১০:১৪

জীবনধারণ নিদারুণ কঠিন

জীবনযাত্রার ব্যয় দিন দিন বৃদ্ধি

দিন দিন নিদারুণ কঠিন পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনধারণ। সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত মানুষ পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণের খরচ জোগাতে গিয়েই এখন নাভিশ্বাস অবস্থা। চাল-ডাল, তেল, সবজি ওষুধপথ্য ক্রয় যাতায়াত খরচ থেকে শুরু করে সন্তানদের পড়াশোনার আকাশছোঁয়া ব্যয়, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল, বাড়ি ভাড়া লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিত্য ও ভোগ্য পণ্যসামগ্রী, সেবাখাতের ব্যয় অনিয়ন্ত্রিত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরমধ্যে অনেক কিছুই চলে গেছে ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। তদুপরি ভ্যাটসহ হরেক ধরনের শুল্ক-করের ভারে আর যথেচ্ছ হয়রানিতে মানুষ ত্যক্ত-বিরক্ত। আয়ের সাথে ব্যয় খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই। পরিবারের কর্তাব্যক্তিরা দায়-দেনাভারে জর্জরিত। সুদি মহাজন আর কতিপয় এনজিওর সুদের কারবার রমরমা। মধ্যবিত্ত যাদের হাতের পাঁচ ক্ষুদ্র সঞ্চয় ছিল তাও ভেঙে কোনো রকমে দিনাতিপাত করছে। দিনমজুর শ্রমিক দিনে এনে দিনে খেটে খাওয়া মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগ বর্ণনাতীত। অসদুপায়ে আয়ের সুবাদে হঠাৎ ‘টাকার কুমির’ বনে গিয়ে যারা ভোগবিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত শুধুই তাদের কথা আলাদা। অধিকাংশ জনসাধারণের অভাব-অভিযোগ দুঃখ-কষ্টের ফর্দ লম্বা হচ্ছে। সাধারণ জনগণের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে ফারাক বিস্তর। অথচ এতসব ক্ষেত্রে জীবনধারণে মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও দুর্ভোগ নিয়ে রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধিদের নেই কোনো মাথাব্যথা। বরং তারা সম্পূর্ণ নির্বিকার। যার যার ক্ষমতার বলয় মজবুত রাখতেই মরিয়া হয়ে ছুটছেন। আমজনতার আশা-আকাক্সক্ষার উল্টোপথে চলছে রাজনীতির গাড়ি। জনজীবনে বিরাজমান হাজারো সমস্যা-সঙ্কট অভাব-অভিযোগ জনদুর্ভোগ নিয়ে প্রধান প্রধান দল-জোটের রাজনীতিক এবং এমপি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, মেয়র-কাউন্সিলর, উপজেলা চেয়ারম্যান ভাইস চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ জনপ্রতিনিধিদের নির্লিপ্ততার কারণে নিদারুণ আশাহত সাধারণ মানুষজন। কোথাও নাগরিক সমস্যার কথাগুলো তুলে ধরার যেন কেউই নেই। শহর-নগর-গঞ্জে বিভিন্ন দলের ব্যানারে মিছিল-মিটিংয়ে কথামালার অনেক ফুলঝুড়ি থাকলেও জনসাধারণের জীবনধারণ যে দিন দিন কঠিন ও জটিল হয়ে পড়েছে তা নিয়ে কোনো আওয়াজ উঠে না।
সাধারণ মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রা নির্বাহের ব্যয় অব্যাহত বৃদ্ধিতে জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়া প্রসঙ্গে আলাপকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম গতকাল (মঙ্গলবার) ইনকিলাবকে বলেন, খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। চালের দামও বেড়ে গেছে। এর পেছনে অবশ্য কিছু বাস্তব কারণও আছে। গত একবছরে দেশে মুদ্রস্ফীতি সামান্য বেড়েছে। তবে সার্বিকভাবে মানুষের জীবনযাত্রা অতিষ্ঠ হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি বলে তিনি মনে করছেন।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আযাদ ইনকিলাবকে জানান, জীবনযাত্রার ব্যয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে খরচও বেড়েছে। ধানকাটার মওসুমে এবার চালের মূল্য বেড়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা দেশের মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এমনকি শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্মসংস্থানের তেমন কোনো উদ্যোগও নেই। একদিকে কর্মসংস্থানে অভাব, অন্যদিকে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিকে ‘দ্বিমুখী সমস্যা’ হিসেবে উল্লেখ করে ড. আযাদ বলেন, এ অবস্থায় দেশের প্রান্তিক জনগণের জীবন-জীবিকায় দুঃখ-কষ্ট আরও বেড়েছে। দেশে ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও প্রতিনিধিত্বকারী জাতীয় স্বেচছাসেবী প্রতিষ্ঠান কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ক্যাব সূত্র জানায়, সদ্যবিদায়ী ২০১৭ সালে মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ। পণ্যমূল্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য বেড়ে গেছে ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। এর আগের বছর ২০১৬ সালে এই বৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। গত এক বছরে খাদ্যপণ্য বিশেষত চালের মূল্য ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭ সালে সবধরনের চালের গড় মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে ২০ দশমিক ৪০ শতাংশ। এরমধ্যে গরিবের মোটা চালের দাম বেশীই বৃদ্ধি পেয়েছে। যা এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত। সেবা খাতে ২ বার্নার গ্যাসের চুলার গ্যাসের মূল্য বেড়ে গেছে ২৩ দশমিক ০৮ শতাংশ। আবাসিক খাতে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ ও বাণিজ্যিক খাতে বেড়েছে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ওয়াসা সরবরাহ করা পানির মূল্য প্রতি হাজার লিটারে বেড়েছে ৫ শতাংশ। বাসা ভাড়া বেড়ে গেছে ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ।

এদিকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলসহ সারাদেশে বাস-মিনিবাস, টেম্পু-সিএনজি, বেবিট্যাক্সি, রিকশা মিলিয়ে সকল ধরনের গণপরিবহনে ভাড়া আদায়ে চলছে যথেচ্ছ নৈরাজ্য। গ্যাসের সঙ্কটে বাড়িঘরে রান্নার চুলা জ্বলছে না। কল-কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে উৎপাদন। বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কালো-আঁধার ঘিরে ধরেছে শহর-নগর থেকে গ্রাম-গঞ্জ-উপজেলা, হাট-বাজার পর্যন্ত। প্রান্তিক অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বেকারের মিছিল হচ্ছে দীর্ঘ। শহর বন্দরে কোথাও নেই কাজ। চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে আগে হরেক ধরনের কাজের যে সুযোগ ছিল তা এখন সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। সড়ক মহাসড়কের বেহালদশা কাটেনি। হরহামেশা ঘটছে দুর্ঘটনা। ঝরে পড়ছে তরতাজা প্রাণ। খুন ছিনতাই ডাকাতি রাহাজানি চাঁদাবাজি চলছেই। অপরাধের ধরণ পাল্টে যাচ্ছে।
অন্যদিকে জীবনযাত্রা ও জীবন-জীবিকার সঙ্কট নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে যে আকুতি গুমড়ে মরছে সেগুলো নিরসনের বা লাঘবের উপায় নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ আর মাঠের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি, কিংবা জাতীয় পার্টি, হেফাজতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দল-সংগঠনের নেতা এবং জনপ্রতিনিধিদের অন্তরকে কোনোভাবেই যেন স্পর্শ করছে না। জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের অধিকাংশকেই নিজ এলাকাবাসী সুখে-দুঃখে কাছে কিনারেও আর খুঁজে পাচ্ছে না। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ও প্রধান বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাধারণ মানুষের আলাপচারিতায় জনজীবনের নানামুখী এসব ভোগান্তি আর হতাশার কথাগুলো বেরিয়ে আসছে, মাঠে-ঘাটে হাটে-বাজারে, যানবাহনে, স্টেশনে, আলাপে-আড্ডায়।

ক্যাবের সুপারিশ
দেশের মানুষের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিবেচনা করে ১২ থেকে ১৫টি ‘অতি প্রয়োজনীয় পণ্য’ চিহ্নিত করে সেসব পণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি স্থিতিশীল ও মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সুপারিশ করেছে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ক্যাব। তাছাড়া দ্রব্যমূল্য ও সেবাখাতের ব্যয় জনসাধারণের জন্য সহনীয় সীমায় রাখার লক্ষ্যে ১০ দফা সুনির্দিষ্ট সুপারিশও করেছে ক্যাব। এরমধ্যে রয়েছেÑ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল থেকে দরিদ্র, স্বল্প আয় এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের ভোক্তারা যাতে বঞ্চিত না হন সে লক্ষ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। এরজন্য ১২ থেকে ১৫টি খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চিহ্নিত করে সেসব পণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে এবং মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য ‘সরবরাহ ও মূল্য’ নামে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি পৃথক বিভাগ অথবা একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করা প্রয়োজন। বিকল্প হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার দায়িত্বে তার কার্যালয়ে একটি পৃথক উইং প্রতিষ্ঠাও বিবেচনা করা যেতে পারে। ধান-চালের মূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং কৃষককে উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত মূল্য প্রদানের লক্ষ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ‘কনট্রাক্ট গ্রোয়িং’ পদ্ধতি অনুসরণ করা। এর মাধ্যমে ধান কাটার মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান-চাল সংগ্রহ ও তাদের জন্য শস্যবীমা প্রথা প্রবর্তন করা। বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম। এরমধ্যে বিপিসি অতীতের সব লোকসান পুষিয়ে বিপুল অংকের অর্থ লাভ করেছে। অবিলম্বে বিশ্ববাজারে তেলের দামের সাথে দেশে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় এবং সাথে সাথে বিইআরসি কর্তৃক বিদ্যুতের দাম পুনর্নিধারন করে হ্রাস করা। বাড়ি ভাড়া আইন ১৯৯১ অনতিবিলম্বে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে ভাড়াটেদের স¦ার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী বাড়ি ভাড়া কমিশন গঠন করা। ডাক্তারদের ফিসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল্য নির্ধারন, ওষুধের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ; বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সুলভে মানসম্মত চিকিৎসা সেবা প্রদান নিশ্চিত করা। শিক্ষাখাতে অনিয়ম-দুর্নীতি দূরীভূত করার লক্ষ্যে অবিলম্বে শিক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। শিক্ষার মান উন্নয়নে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণে প্রণীত আইন-ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, প্রতিযোগিতা আইন ২০১২, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫ এর বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ওষুধ নীতি বাস্তবায়ন করা। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআই ও ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করা। জনস্বার্থে সিটি কর্পোরেশন ও অনান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের পণ্য ও সেবার মান এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণে আইনানুগ কার্যকর ভূমিকা পালন করা। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য হ্রাসের সুফল ভোক্তারা যাতে পেতে পারে সেই লক্ষ্যে আমদানি বাণিজ্যকে অধিকতর প্রতিযোগিতামূলক করা। প্রয়োজনে বাস্তবতার ভিত্তিতে টিসিবির মাধ্যমে ‘লোকসান নয়, লাভও নয়’ ভিত্তিতে মানসম্পন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী নিয়মিত আমদানি ও বাজারজাতে উদ্যোগ গ্রহণ করা। মুদ্রা বিনিময় হারের পরিবর্তনের কারণে আমদানিকৃত পণ্যের দাম যাতে বৃদ্ধি না পায় সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল যাতে সুষম বণ্টন হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা। আয় বৈষম্য নিয়ন্ত্রণের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।

https://www.dailyinqilab.com/article/114040