২৪ জানুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ৯:৩৬

পরামর্শক ব্যয়ে তুঘলকি

তিন প্রকল্পেই প্রস্তাব ২২৫ কোটি টাকা * লুটপাটের শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না -ড. জাহিদ হোসেন

সরকারের শেষ বছরে উন্নয়ন প্রকল্পে পরামর্শক ব্যয়ের নামে অর্থ লুটপাটের প্রবণতা বেড়েছে। একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্পে পরামর্শক ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলছে পরিকল্পনা কমিশন। সংস্থাটি বলছে, এসব ব্যয় অত্যধিক ও অযৌক্তিক। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে এলে কখনও এ ব্যয় কিছুটা কমছে, তবে অনেক ক্ষেত্রেই প্রস্তাবিত ব্যয়ই মেনে নিচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন।
জানুয়ারিতে মূল্যায়িত হওয়া বা পাস হওয়া চারটি প্রকল্প বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর তিনটিতেই পরামর্শক ব্যয় ধরা হয়ছে ২২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এ সময়ে একটি প্রকল্প পাস হয়েছে, ছোট্ট ওই প্রকল্পে ১০ লাখ টাকা পরামর্শক ব্যয় প্রস্তাব করা হয়।
এ প্রসঙ্গে সরকারের একজন নীতিনির্ধারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, পরামর্শক ব্যয়ের নামে যাচ্ছেতাই করা হচ্ছে। এটা বেশি হচ্ছে বৈদেশিক অর্থায়নের বাস্তবায়িত প্রকল্পের ক্ষেত্রে। কেননা ঋণ নিতে গেলে তাদের কিছু শর্ত মানতে হয়। এককথায় কাউকে ভালোবাসতে গেলে তার কুকুরটাকেও ভালোবাসতে হয়- এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘যেসব প্রকল্প কারিগরি দিক থেকে জটিল, সেগুলোয় পরামর্শক ব্যয় অনেক সময় বেশি হতে পারে। কিন্তু সহজসরল বা যে ধরনের প্রকল্প আগেও বাস্তবায়ন হয়েছে, যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে সেগুলোয় এত ব্যয়ের কোনো কারণ নেই।’ জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়গুলোর একটি প্রবণতা থাকে এ খাতে অতিরঞ্জিত ব্যয় দেখানো। কেননা এখানে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নেয়ার জায়গা থাকে।’ লুটপাটের জন্যই এমন ব্যয় দেখানো হয় কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে ‘অত্যাধুনিক ও বিশ্বমানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর স্থাপন’ নামের একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৫৪৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা। ১ জানুয়ারি প্রকল্পটির ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় কার্যবিবরণী সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় ১৫০ জন-মাস পরামর্শকের জন্য ১০০ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পরামর্শকের মাসিক সম্মানী ধরা হয় ৬৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, এ ব্যয় অযৌক্তিক। পরে ব্যাপক আলোচনার পর পরামর্শক ব্যয় যৌক্তিকভাবে নির্ধারণসহ পরামর্শক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কার্যপরিধি, কার্যকাল, মাসিক সম্মানী ইত্যাদি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) সংযোজনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে (মোট ব্যয় ৫ হাজার ৭১০ কোটি টাকা) রেলপথ মন্ত্রণালয় বিদেশি পরামর্শক খাতে ৯৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা প্রস্তাব করে। এ প্রকল্পে একেকজন পরামর্শকের বেতন ধরা হয় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। সে হিসাবে শুধু ডিজাইন ও তদারকি কাজেই পরামর্শকদের বেতন বাবদ ২৬ কোটি ১২ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়। এ ছাড়া পরামর্শকদের জন্য আরও বিভিন্ন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা।

এ ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে পরিকল্পনা কমিশন। ৩ জানুয়ারি প্রকল্পটির ওপর অনুষ্ঠিত পিইসি সভায় এ ব্যয়কে অত্যধিক জানিয়ে ভেটো দেয় সংস্থাটি। ওই সভায় ব্যাপক আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত এ খাতে ব্যয় ২০ কোটি টাকা কমাতে রাজি হয় প্রস্তাবকরা।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের যুগ্ম প্রধান মো. নজরুল ইসলাম সরকার যুগান্তরকে বলেন, পরামর্শকের পেছনে প্রস্তাবিত ব্যয় আমাদের কাছে অনেক বেশি বলে মনে হয়েছিল। তাই এ খাতে ব্যয় কমাতে বলা হয়েছে। আমরা কোনো অঙ্ক ঠিক না করে মন্ত্রণালয়কেই কমানোর দায়িত্ব দিয়েছি। আশা করছি এতে বেশ কয়েক কোটি টাকা বেঁচে যাবে।
মাগুরা জেলার মধুখালী হতে কামারখালী হয়ে মাগুরা শহর পর্যন্ত নতুন ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণে প্রস্তাবিত প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১৩৪ কোটি টাকা। সরকারি তহবিলের অর্থে এ প্রকল্পে পরামর্শক খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩০ কোটি ৬৬ লাখ ৪২ হাজার টাকা। কিন্তু সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়ন এবং স্থানীয় পরামর্শকদের জন্য এত টাকা ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে পরিকল্পনা কমিশন। পিইসি সভায় ব্যয় কমানোর কথা বলা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কমানো যায়নি।

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে অবস্থিত গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পেও পরামর্শক ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে প্রস্তাব করা হয়নি বলে মনে করে পরিকল্পনা কমিশন। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৬৭ কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। তবে একনেকে অনুমোদনের আগে অনুষ্ঠিত পিইসি সভায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পরামর্শক খাতের প্রস্তাবিত ব্যয় ১০ লাখ টাকা এবং একটি মাইক্রোবাস ভাড়া বাবদ ৪০ লাখ টাকাসহ বিভিন্ন খাতের ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। আলোচনার পর এসব ব্যয় যৌক্তিকভাবে কমানোর সুপারিশ করে কমিশন। সে অনুযায়ী ব্যয় সামান্য কমিয়ে ডিপিপি সংশোধন করা হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত তা কত করা হয়েছে এ প্রতিবেদন তৈরি করা পর্যন্ত জানা যায়নি।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই ও ডিজাইনের মতো কাজে পরামর্শক অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে অযৌক্তিক ব্যয় যাতে না হয় এবং অপ্রয়োজনীয় কাজে যাতে পরামর্শক ব্যয় করা না হয়। অনেক সময় দেখা যায়, বিভিন্ন প্রকল্পে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির যোগসাজশ থাকে। ফলে পরামর্শক ব্যয় বাড়িয়ে দেখানো হয়। এসব বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনকে আরও সতর্ক হতে হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/10368