২৪ জানুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ৯:২৬

পাচার হওয়া টাকার দুষ্টচক্র

খান আখতার : অনেক জরুরি উন্নয়ন আটকে থাকার পেছনে তহবিল সংকটের দোহাই দেওয়া হয় এ দেশে। বহুজাতিক কম্পানির কাছে গ্যাস ইজারা দেওয়ার যুক্তি, বাপেক্সের রিগ না হওয়ার যুক্তি কিংবা প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ভাতার প্রশ্নে আমরা টাকার অভাবের কথা শুনি জোরেশোরে। আবার এ বাংলাদেশেই আমরা শুনি হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনের কথা। শেয়ারবাজারের লুণ্ঠন, বিদ্যুৎ খাতের লুটপাত, বহুজাতিক কম্পানির কাছে কমিশন কিংবা বিভিন্ন হায় হায় কম্পানির লুণ্ঠনের ঘটনাও ঘটে চোখের সামনেই। এসব লুণ্ঠিত টাকা কোথায় যায়? দেশের উৎপাদনশীল অর্থনীতিতে কোথাও তা কাজে লাগে কি? সম্প্রতি পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত বিভিন্ন আন্তদেশীয় অর্থপাচার, বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে উন্নত দেশগুলো থেকে নাগরিকত্ব কেনার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্কের এক গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের অবিশ্বাস্য পরিমাণ সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য। প্রতিবেদনে ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত পাচার হওয়া টাকার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে অন্তত দুই হাজার ৪৭০ কোটি ডলার। ডলারের বর্তমান বাজার মূল্যে যার পরিমাণ কম-বেশি দুই লাখ কোটি টাকা। তবে পাচার হওয়া মোট সম্পদের পরিমাণ এর চেয়েও অনেক বেশি হবে বলেই সংস্থার অনুমান। জমি, বাড়ি, স্বর্ণ ও অন্যান্য অ-আর্থিক সম্পদ এই পরিমাণের সঙ্গে যোগ করলে প্রকৃত পরিমাণ অন্তত ৫০ শতাংশ বেশি হবে। ভারতের ক্ষেত্রে পাচার হওয়া অর্থ ও অ-আর্থিক সম্পদের অনুপাত এ রকমই ছিল। বাংলাদেশ শুধু নয়, বিশ্বের বহু উন্নয়নশীল দেশ থেকেই এভাবে অর্থ পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে উন্নত দেশগুলোতে। শুধু ২০১০ সালেই ‘অনুন্নত’ বিশ্বের বড়লোকদের ৭ দশমিক ৩ থেকে ৯ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার চলে গেছে করমুক্ত দেশ বা তথাকথিত ‘কর স্বর্গে’। এই পুরো প্রক্রিয়াই অর্থনীতির সাধারণ হিসাব-নিকাশের বিপরীত। সাধারণ অর্থনৈতিক হিসাব অনুসারে উন্নত বিশ্ব থেকে পুঁজি আসার কথা তৃতীয় বিশ্বে। কেননা তৃতীয় বিশ্বের সস্তা শ্রম কাজে লাগিয়ে দ্রুত মুনাফা করা যায়। কিন্ত এখানে পুরো উল্টো প্রক্রিয়াই আমরা দেখছি। কেন এমন ঘটছে? কিভাবে তা সম্ভব হচ্ছে? এর পরিণতিই বা কী? ঋণের বোঝা জনগণের ঘাড়ে লাভের গুড় ক্ষমতাবানের : এই যে কিছু মানুষের হাতে বিপুল পরিমাণ ‘উড়াল টাকা’ এ টাকা আসলে কোথা থেকে এলো? এ টাকার উৎস সন্ধান করলে দেখা যায়, এর একটা বিশাল অংশ এসেছে দেশের সম্পদ ও উন্নয়নের নামে বিদেশি ঋণের টাকার লুটপাটের মাধ্যমে। রিপোর্ট বলছে, ‘ঐতিহাসিকভাবে বললে সত্তর আশির দশকে তৃতীয় বিশ্বে উন্নত দেশে দ্রুততার সঙ্গে বর্ধমান ঋণপ্রবাহের সঙ্গে এটি জড়িত। ঋণ কখনো কখনো মাস, এমনকি সপ্তাহের মধ্যেই ‘উড়াল টাকা’ হয়ে পশ্চিম দেশগুলোতে ফেরত গেছে। এখনো এই দেশগুলো ঋণ করে যাচ্ছে, তাদের অভিজাতরা উন্নত দেশগুলোর অর্থায়নকারীতে পরিমাণ হয়েছে আর ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে এসব দেশের সাধারণ মানুষ।” ফলে যেসব দেশ থেকে অর্থ উড়ে যাচ্ছে, তারা এখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ঋণগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হলেও তাদের দুর্নীতিবাজদের ৭ দশমিক ৩ থেকে ৯ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদে হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনীতি। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের নামে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা, আমদানি মূল্য বেশি এবং রপ্তানি মূল্য কম দেখিয়ে পাচার করা হচ্ছে অর্থ, আর হুন্ডি তো রয়েছেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কানাডায় পাঁচ লাখ কানাডিয়ান ডলার বিনিয়োগের বিপরীতে বহু বাংলাদেশি নাগরিকের সেখানে বিনিয়োগকারী হিসেবে নাম লেখানো কিংবা মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম হিসেবে বাংলাদেশের নাগরিকদের বিনিয়োগকে। ২০০২ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত এক হাজার ৮০০ বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় এই সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে নথিবদ্ধ হয়েছেন। সম্মিলিতিভাবে যাঁদের পাঠানো টাকার পরিমাণ ২৮০ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ নানাভাবে আয় করা অর্থ, যার একটা বড় অংশই দুর্নীতি থেকে আসা। সেই অর্থ কোনো উৎপাদনশীল কাজে ব্যয় না হয়েই চলে যাচ্ছে বাইরে। উড়াল টাকার দেশ নেই, রক্ষক বড় বড় প্রাইভেট ব্যাংক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ৫০টি ব্যাংকের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১০ সালে তারা সীমান্ত অতিক্রমকারী ১২ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যক্তিগত সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ করেছে। এর সঙ্গে যদি ছোট ব্যাংক, বিনিয়োগ সংস্থা, ইনস্যুরেন্স কম্পানি, হেজ ফান্ড, স্বাধীন অর্থ ব্যবস্থাপক এবং ব্যক্তিগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা অর্থের পরিমাণ যোগ করা হয়, তাহলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২১-৩২ ট্রিলিয়ন ডলার। সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকেই বিভিন্ন অনুসন্ধানী সংবাদকর্মী, কর বিভাগ, মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা, সন্ত্রাসবাদী অনুসন্ধানকারী, জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা এবং কিছু অর্থনীতিবিদ এ ধরনের উড়াল অর্থের ক্রমবৃদ্ধি সম্পর্কে সচেতনা হয়ে ওঠেন। তাঁরা লক্ষ করেন, একট বিপুল পরিমাণ অর্থ, আসরে সারা পৃথিবীর ব্যক্তিগত সম্পদ ও আয়ের একটা বিরাট অংশই এই উড়াল টাকার ভেতরে লুকিয়ে আছে। একটা দেখভাল করেন প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর অত্যন্ত পরিশ্রমী, প্রশিক্ষিত, ঝানু কর্মীরা। এই দেশহীন, ঘরহীন অর্থের আবাস স্বর্গ হয়ে ওঠে সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ডের মতো দেশগুলোর ব্যাংক। আর এই ব্যাংকিং বহুদিন আগেই শারীরিক উপস্থিতির সীমাকে ছাড়িয়ে ঢুকে গেছে ভার্চুয়াল জগতে। কাজেই উড়াল টাকা পুরোপুরি ভৌত উপস্থিতির ওপরও নির্ভর করে না। এগুলো নানা আইন-কানুনের ফাঁকে, নানা ধরনের সম্পদে ভাগ করে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। ‘নিরাপদ জীবন’ ‘ভোগের স্বর্গ’, কিসের বিনিময়ে? এই যে বিশাল পরিমাণ টাকা উড়ে যায়, সেগুলো আসলে কিভাবে ব্যবহৃত হয়? সুইজারল্যা- কিংবা সিঙ্গাপুরের দিকে তাকালেই অনেকটা পরিষ্কার হয়। বিশেষ নিরাপত্তাযুক্ত ব্যাংকের সঙ্গে সেখানে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে ধনবানদের বাড়ি ব্যয়বহুল প্রাইভেট স্কুল, উন্নতমানের এবং দামি হাসপাতাল আর অবকাশযাপন কেন্দ্র। চীনা রিয়েল এস্টেটের ফটকা ব্যবসায়ী, সিলিকন ভ্যালির সফটওয়্যার টাইকুন, দুবাইয়ের তেল মালিক শেখ, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট, আফ্রিকার খনি ব্যবসায়ী, বাংলাদেশের এনজিও, আমলা, রাজনীতিবিদ কিংবা মেক্সিকোর মাদক স¤্রাট-সবারই সেখানে রয়েছে সাদর আমন্ত্রণ। কিছু পার্থক্য সত্ত্বেও এঁদের সবার রয়েছে কিছু সাধারণ চাহিদা- (১) তাঁদের নিজেদের, পরিবারের, ব্যবসার অথবা রাজনৈতিক কাজকরারবারের গোপনীয়তা; (২) ভবিস্যৎ করের পরিমাণ ও কর ফাঁকির খরচ কমিয়ে আনা; (৩) দুনিয়ার যেকোনো জায়গা থেকে তাঁদের সম্পদের সহজপ্রাপ্যতা ও দেখভাল করার নিশ্চয়তা; (৪) বসবাস বা লুকানোর নিরাপদ জায়গা করার নিশ্চত করা ও জীবন উপভোগ করা; (৫) যাঁরা এখনো বিনিয়োগ করতে আগ্রহী, তাঁদের বিনিয়োগের ব্যবস্থাপনা; (৬) প্রধানত তাঁদের কর না দেয়া গোপন বিপুল পরিমাণ সম্পদের লৌহ কঠিন নিরাপত্তা। এই নিরাপত্তা শুধু কর বিভাগ বা রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগকারীদের কাছ থেকেই নয়, একই সঙ্গে অপহরণকারী, ছিনতাইকারী, গোয়েন্দা, ঘাতক, বিরোধী পক্ষ, হ্যাকার, পাপারাজ্জি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, অসন্তুষ্ট আত্মীয়, সাবেক প্রেমিক প্রেমিকা, সাবেক স্বামী-স্ত্রী এঁদের কাছ থেকেও। অর্থাৎ তাঁদের বিত্ত-বৈভব, আরাম-আয়েশ, ভোগ সঞ্চয় সবই রাষ্ট্রের কর ফাঁকি দেয়ার ওপর নির্ভর করে; যে করেন টাকা জনগণের শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে কিংবা অর্থনীতির উৎপাদনশীল খাত গঠনে ব্যবহৃত হতে পারত। হাওয়া হওয়া সম্পদের প্রকৃত পরিমাণ আরো বেশি : সীমান্ত অতিক্রমকারী ব্যক্তিগত সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের পুরো কাজটাই চলে অতি গোপনে। ফলে এ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করাও অত্যন্ত জটিল এবং পুরো তথ্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব। প্রথমত, প্রাইভেট ব্যাংকার, আইনজীবী ও হিসাবরক্ষকরা তাঁদের খদ্দেরদের সম্পদ, পরিচয়, এমনকি আচর-আচরণ লুকিয়ে রাখার জন্য ভালো পয়সা পান। তাঁরা সবাই মিলে আবার অত্যন্ত প্রভাবশালী লবিস্টদের সহায়তা নেন। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন দেশের ব্যাংক নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রাইভেট ব্যাংকগুলোকে দেখে তাদের প্রধান ক্লায়েন্ট হিসেবে। এ কারণে সম্পদের প্রকৃত উৎস গোপন করার বিষয়টি এড়িয়ে যায় তারা। তৃতীয়ত, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশনাল সেটলমেন্ট, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক- এসব সংস্থাকে সাধারণভাবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত ধরা হলেও ওয়ান স্ট্রিট গং এর সামগ্রিক স্বার্থের প্রতি তাদের নিবেদন ও স্পর্ককাতরতা খুবই উঁচু মাত্রার। এরা কখনোই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ধরনের সীমান্ত অতিক্রমকারী সম্পদের হিসাব-নিকাশ, এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে হোক, তাও চায় না। ফলে সামগ্রিকভাবে এসব সম্পদের হিসাব পুরোটা উঠে আসে না। আর এই আর্থিক সম্পদের বাইরেও বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে এ ব্যাংকগুলোর ভল্টে। সোনার বার, গহনা, দামি চিত্রকর্ম, অ্যান্টিক কার, অস্ত্র, ইয়ট, রতœ-এ ধরনের নানা জিনিস অতিশয় গোপনীয়তার সঙ্গে রাখা হয় এসব ব্যাংকে; যার সঠিক পরিমাণ ও মূল্যের হদিস পাওয়াটা আসলেই প্রায় অসম্ভব। ফলে দুনিয়াজুড়ে এ ধরনের সর্বমোট উড়াল সম্পদের পরিমাণ যা জানা যায়, তার চেয়েও আরো অনেক বেশি। কেন্দ্র প্রান্ত বিভাজনের ভিত্তিতে গড়ে উঠছে বৈশ্বিক লুটেরা শ্রেণী : বর্তমান পৃথিবীতে গরিব দেশগুলোকে যেসব অস্ত্র দিয়ে দাবিয়ে রাখা হয়, তার অন্যতম হলে বৈদেশিক ঋণ। এসব গরিব দেশে উন্নয়নের নামে ধনী দেশগুলোর তাদের ঋণ ব্যবসা চালিয়ে যায়। কিন্তু এর কতটুকু বাস্তবতার প্রতিফলন আর কতটুকু তৈরি করা বাস্তবতা? ট্যাক্স ফর জাস্টিস নেটওয়ার্ক-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘যদি উড়াল অর্থের পরিমাণ ২১ ট্রিলিয়ন ধরা হয়, তাহলে যেসব দেশ থেকে এই অর্থ পাচার হয়েছে সেসব দেশে ১৮৯ বিলিয়ন ডলারের ট্যাক্স দিতে হতো। এই ট্যাক্সের পরিমাণ উন্নত দেশগুলোর থেকে ‘তৃতীয় বিশ্ব’ যে ঋণ নেয় তার দ্বিগুণেরও বেশি। অর্থাৎ গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ‘তৃতীয় বিশ্বের’ দেশগুলো যারা ঋণগ্রস্ত হিসেবে পরিচিত, তারা আসলে এক ধরনের ঋণদানকারী হিসেবেই কাজ করছে। এর সঙ্গে যদি এই তথ্য যুক্ত করা হয় যে ধনী পরিচিত দেশগুলো যে ঋণ দেয়, তা আসলে বহু বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমে উপনিবেশিত দেশগুলোর শ্রম ও সম্পদ লুট করেই সংগ্রহ করা, তাহলে আরেক বাস্তবতার দেখা মেলে। তথাতথিত ধনী বিশ্ব আসলে ধনী হয়েছে ‘গরিব’ বিশ্বের ধনের ওপর নিজের লুণ্ঠন আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ফল হিসেবেই। আর এ ক্ষেত্রে সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করছে জমিদার, ব্রিটিশদের নব্য ইংরেজি শিক্ষিত আর মধ্যস্বত্বভোগীদের যে অংশ এখানে ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনের সহযোগী ছিল, তাদেরই উত্তরসূরিরা এখনো ক্রিয়াশীল। এই অতি বড়লোক শ্রেণী আসলে একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বাসিন্দা, তারা দ্রুততার সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রম করে দেশ বদল করতে পারে। তারা কর না দিয়েও প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম, বিভিন্ন দেশে তারা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম এবং অবৈধ অর্থের জোরে তারা এই ক্ষমতা ভোগ করে। ফলে দুনিয়াব্যাপী তাদের স্বার্থ নিচু মাত্রার সম্পদ কর ও আয়কর ব্যবস্থা, দুর্বল সরকারি নিয়ম-নীতি, আরো বেশি গমনাগমনে যত দূর সম্ভব কম রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, আন্তর্জাতিক পাইরেট ব্যাংক, আইনি সহায়তা সংস্থা, অ্যাকাউন্টিং ফার্ম, লবিস্ট এদের বাড়বাড়ন্ত। অর্থাৎ তথাকথিত বিশ্বায়নের এবং জাতীয় অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের পক্ষে একটি বিরাট বাহিনী তৈরি হয়েছে বিশ্বজোড়া। এই বৈশ্বিক লুটেরা শ্রেণীর স্বার্থ আবশ্যিকভাবেই সারা দুনিয়ার জনগণের স্বার্থের বিপরীত ও সাংঘর্ষিক। কী ঘটেছে, কী ঘটছে বাংলাদেশে? ১৯৭১ সালে একটা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ভেরত দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করলেও স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে স্বাধীন অর্থনীতি কিংবা রাজনীতি গড়ে ওঠেনি। শুরু থেকেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ চলে যায় এমন এক শ্রেণীর কাছে, উৎপাদননির্ভর অর্থনীতির সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। কমিশন-বাণিজ্য, দালালি, ফটকা ব্যবসা, মজুদদারি- এসবের মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটিপতির জন্ম হয় ১৯৭১ সালের পর থেকে। প্রথম থেকেই রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুণ্ঠনই তাই হয়ে ওঠে তাদের ধনসম্পদ আহরণের প্রধান উপায়। প্রথম থেকে কিছু সম্পদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বহাল আন্তর্জাতিক প্রেসিক্রিপশনের সুযোগ এই লুটপাট বিস্তৃত হয়ে পড়ে। গণতান্ত্রিক শক্তির অনুপস্থিতিতে সামরিক সরকাররা এই দুর্নীতিকে উৎসাহ জুগিয়েছে। এই সময় থেকে রাষ্ট্রীয় কল-কারখানার বিরাষ্ট্রীকরণ শুরু হয়। কারখানার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কুক্ষিগত করা এবং এসব কারখানার নামে বড় অঙ্কের ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করে আত্মসাৎ করার লক্ষ্যে মরিয়া হয়ে ওঠে দুর্নীতিবাজরা। পরিণতিতে বিরাষ্ট্রীকৃত কল-কারখানার প্রায় সবই পরে বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এ সময় বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণ বাংলাদেশে আসে, যার একটা বড় অংশই আসলে আত্মসাৎ করে দুর্নীতিবাজরা। এভাবে অর্জিত অর্থের প্রায় পুরোটাই ব্যয় হয় অনুৎপাদনশীল খাতে এবং এর একটা বড় অংশ ‘উড়াল অর্থ’ হয়ে চলে যায় বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে। এই অবৈধ অর্থের মালিকরা নিজেদের স্বার্থে শুধু অর্থনীতিই নয়, দেশের রাজনীতিকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করেছেন। কারণ রাজনৈতিক ক্ষমতাই তাঁদের অবৈধ অর্থের সর্বোত্তম রক্ষাকবচ। এই ক্ষমতা নতুন নতুন দুর্নীতি করার হাতিয়ারও বটে। বিশ্বের ছোট-বড় সব দেশ থেকেই এভাবে আহরিত হচ্ছে সম্পদ। এই সম্পদ চলে যাচ্ছে বিদেশে এবং ফিরে আসছে ঋণ অনুদানের নানা শর্তের বেড়াজালে। বাংলাদেশের মানুষের তাই উচিত হবে এদিকে নজর দেয়া। হাজার কোটি টাকার এই পাচারযজ্ঞ বন্ধে জনসচেতনতা ও জনপ্রতিরোধ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।

 

http://www.dailysangram.com/post/316441