২৩ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:০৩

বাড়ৈ থেকে মোতালেব

শিক্ষামন্ত্রীর সাবেক এপিএস মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ-এর পর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোতালেব হোসেন যুগের অবসান হতে চলেছে। এখন ওই স্থানটি কে দখলে নেয় এনিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চলছে জোর আলোচনা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের আলোচিত সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ছিলেন বাড়ৈ। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে দুর্নীতির দায়ে শিক্ষামন্ত্রীর এপিএসের দায়িত্ব থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। অব্যাহতি দেয়ার আগে অনেক জল ঘোলা হলেও বাড়ৈ’র টিকিটিও কেউ ছুঁতে পারেনি। মাঝে মধ্যে খোদ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তার ঘনিষ্ঠজনদের কাছে বাড়ৈ’র বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করলেও অজানা কারণে এপিএস পদ থেকে তাকে সরাননি।
তবে শেষ পর্যন্ত একাদশ শ্রেণির অনলাইন ভর্তি পদ্ধতি নিয়ে সারা দেশে যখন বিতর্কের ঝড় উঠে তখনই অনেকটা বাধ্য হয়ে এপিএস পদ থেকে মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈকে সরিয়ে দেয়া হয়। অবসান হয় বাড়ৈ যুগ। যদিও মন্ত্রণালয় থেকে সরে শিক্ষা বোর্ডে ভালো পদে দায়িত্ব পান তিনি। বাড়ৈ মন্ত্রণালয় ছাড়ার পর শিক্ষামন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোতালেব হোসেনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তৈরি হয়। ফলে গত প্রায় আড়াই বছর ধরে মোতালেব হোসেন দাপটের সঙ্গে তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছিলেন। শিক্ষামন্ত্রীর কাছে বিভিন্ন সংস্থা থেকে মোতালেব সম্পর্কে সতর্ক করা হলেও তাতে তিনি কান দেননি। মোতালেবের ঘনিষ্ঠজনরা জানান, মোতালেব কাউকে পাত্তা দিতেন না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে মহাজোট প্রথম দফায় সরকার গঠনের পর শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। তখনই শিক্ষামন্ত্রীর এপিএস পদে নিয়োগ লাভ করেন মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ। এর আগে ’৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালনকালেও মন্মথ তার এপিএসের দায়িত্ব পালন করেন। মহাজোট সরকারের দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব গ্রহণের পর আবারো এপিএস হিসেবে ফের নিয়োগ পান বাড়ৈ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নিজের নানা কর্মকাণ্ডের কারণে বিতর্কিত হয়ে উঠেছিলেন মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ। শিক্ষা প্রশাসনে তিনি নিজস্ব একটি বলয় গড়ে তুলেছিলেন। তার নেতৃত্বাধীন একটি সিন্ডিকেট দাপটের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল। সাড়ে ৬ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি বদলি, পদোন্নতি, কমিশন নেয়া, পদায়ন ও নিয়োগ, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ভবন নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন খাতে প্রভাব বিস্তার করেন তিনি। এরপর ২০১৫ শিক্ষাবর্ষের একাদশ শ্রেণির অনলাইন ভর্তিতে তার সিন্ডিকেটের কারণে গোটা পদ্ধতিতে একটি বিতর্কের মুখে পড়ে। ভর্তির সংকট উত্তরণে ৪ঠা জুলাই রাজধানীর হেয়ার রোডে শিক্ষামন্ত্রীর বাসভবনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন শিক্ষাসচিব। রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের কোনো ফাইলই রাজনৈতিক বিবেচনায় নিযুক্ত এপিএস’র টেবিলে যাওয়ার কথা নয়। বাড়ৈ’র সময়ে বাস্তবতা ছিল যাবতীয় বদলিভিত্তিক পদায়ন, পদোন্নতি, সরাসরি নিয়োগ, এমপিও, প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ, বিদেশ ভ্রমণের তালিকা, ভর্তি, কমিটি অনুমোদন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনবল নিয়োগ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনের ফাইল প্রক্রিয়াকরণ, টেন্ডারসহ গুরুত্বপূর্ণ সবকিছুতেই নজর ছিল বিতর্কিত এপিএস’র। এই সুযোগে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের ফাইল গায়েব, কখনও ফেরত পাঠাতেন তিনি। এসব কারণে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব এপিএস’র এসব কর্মকাণ্ড কখনই পছন্দ করেননি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাড়ৈ এপিএস পদে নিয়োগ পেয়ে বিপুল পরিমাণ টাকার মালিক হয়েছেন। তার নেতৃত্বেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সব দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সেই টাকার ভাগ চলে যেতো তার পকেটে। বাড়ৈকে এপিএসের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার পর একই সিন্ডিকেট পিও মোতালেব হোসেনের সঙ্গে হাত মেলায়। মোতালেব গ্রেপ্তারের পর থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়তে শুরু করেছে। পিও পদে থেকে কোটি কোটি টাকা অর্জনের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানীর বছিলা রোডে সাত তলা বাড়ি বানাচ্ছেন পিও মোতালেব হোসেন। পশ্চিম ধানমন্ডির বি ব্লকের ৪ নং রোডের ২৬ নম্বর প্লটে নির্মাণাধীন বাড়িটিই তার। মোতালেব হোসেনের এই বাড়িটি ৩ কাঠা জমির ওপর নির্মাণ করছেন। এ বাড়িটির বর্তমান মূল্য প্রায় চার কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে ১০ম গ্রেডে সরকারি বেতন পাচ্ছেন পিও মোতালেব হোসেন। তার মূলবেতন ২৮ হাজার ১০০ টাকা। বাড়িভাড়াসহ বিভিন্ন খাতে কেটে নেয়ার পর বর্তমানে মাসে মোট ১৩ হাজার ৮৮ টাকা উঠান তিনি। তাই কয়েক কোটি টাকা খরচ করে ভবন নির্মাণ বিস্ময়কর। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বাড়ৈ-এর পর মোতালেব হোসেনও গ্যাঁড়াকলে পড়লেন। তাই সময়ই বলে দেবে নতুন করে কার যুগ শুরু হয়।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=101750