২৩ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৫৯

রোহিঙ্গা প্রত্যর্পণ হতে হবে স্বেচ্ছায় : জাতিসংঘ দূত ইয়াংহি লি

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাচ্ছে না বাংলাদেশ

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর আগেই থমকে গেছে। প্রত্যাবাসন চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মঙ্গলবার (আজ) থেকে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পাওয়ায় তাদের ফেরত পাঠাতে পারছে না বাংলাদেশ সরকার। পাশাপাশি রোহিঙ্গা পরিবারের তালিকা প্রস্তুত ও যাচাইয়ের কাজ শেষ না হওয়ায় এখনই এ প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না। তবে কবে নাগাদ এ প্রক্রিয়া শুরু হবে তাৎক্ষণিকভাবে তা জানা যায়নি। সোমবার শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম বলেন, ‘কিছুটা সময় লাগবে। দুই দেশের প্রস্তুতিমূলক অনেক কাজ রয়েছে, যেগুলো মূল কাজ (প্রত্যাবাসন) শুরুর আগে আমাদের সমাধান করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ’পুরো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটাই জোরজবরদস্তি ছাড়াই স্বেচ্ছায় হতে হবে।’

১৬ জানুয়ারি মিয়ানমারের নেপিদোয় বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হয়। প্রত্যাবাসন নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার বেশ তোড়জোড় পরিলক্ষিত হলেও সোমবার উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প, উপজেলা প্রশাসন, বিভিন্ন এনজিও সংস্থাসহ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া যায়নি রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে কবে ফিরছে? প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সোমবার সকালে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তিনি এখনও কোনো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ-নির্দেশ বা প্রজ্ঞাপন পাননি। তবে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে উপজেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) যোগাযোগ কর্মকর্তা শিরিন আখতার জানান, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এ দুই সরকারের মধ্যকার বিষয়। তারা এ বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন যে, রোহিঙ্গাদের কখন মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে। আইওএমের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এখনও পর্যন্ত। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কক্সবাজারস্থ কো-অডিনেটর সেলিম আহমদ বলেন, সরকারের চুক্তি অনুযায়ী আজ (মঙ্গলবার) রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম যদি বাস্তবায়ন হতো তাহলে ক্যাম্পে একটি অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি হতো। তাতে অনায়াসে বোঝা যেত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হচ্ছে। এ পর্যন্ত তেমন আভাস মেলেনি।
গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত ছয় লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের ফেরত পাঠাতে ২৩ নভেম্বর মিয়ানমার ও বাংলাদেশ যে সম্মতিপত্রে সই করেছিল, সেখানে দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করার লক্ষ্য ঠিক করে দুই দেশ। সেই দুই মাস সময় শেষ হচ্ছে মঙ্গলবার। ওই সম্মতিপত্রের ভিত্তিতে দুই দেশ ১৯ ডিসেম্বর যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে। ১৬ জানুয়ারি ওই গ্রুপের প্রথম বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিভিন্ন বিষয় ঠিক করে ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ স্বাক্ষরিত হয়।

আবুল কালাম বলেন, ‘আমরা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছি। কাজ চলমান আছে। প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেই আমরা মূল প্রত্যাবাসন, তাদের ফেরত পাঠানোর কাজটি শুরু করতে পারব বলে আশা করছি।’ পুরো কাজটিকে তিন ভাগে দেখার কথা জানিয়ে প্রত্যাবাসন কমিশনার বলেন, প্রথম পর্যায়ের কাজ হল পদ্ধতিগত বিষয় ঠিক করা। দ্বিতীয়ত, ভৌত ও কাঠামোগত ব্যবস্থা তৈরি করা। তৃতীয় পর্যায়ে প্রত্যাবাসন শুরু করা। তিনি বলেন, ’প্রথম ধাপটি আমরা ভালোভাবেই শুরু করেছি বলা যায়। আমরা এখন দ্বিতীয় পর্যায়ে আছি। ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্টের আলোকে আমরা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছি। পাঁচটি ট্রানজিট ক্যাম্প করতে হবে, সেগুলোর স্থান নির্বাচন করেছি। পরিবারভিত্তিক তালিকা প্রণয়নের কাজও চলছে।’

আবুল কালাম বলেন, চুক্তিতে ঠিক হয়েছে এই প্রত্যাবাসন হবে নিরাপদ ও স্বেচ্ছামূলক। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফেরত পাঠানো যাবে না। তাই মিয়ানমারে গিয়ে তারা কী অবস্থা পাবেন, সে বিষয়েও আশ্রয় শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের ধারণা দিতে হবে। সচেতনতা তৈরির এ কাজটি দ্বিতীয় পর্যায়েই করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা পরিবার বাংলাদেশে আছে, তার মধ্যে দেড় লাখের বেশি পরিবার এসেছে ২৫ আগস্টের পর। চুক্তি অনুযায়ী এবার শুধু তাদেরই ফেরত পাঠানো হবে। তাদের সবাইকেই আমরা ফেরত পাঠাতে চাই। সে অনুযায়ী তালিকা তৈরি করছি। পুরো তালিকা হয়ে গেলে আমরা গ্রাম ভিত্তিতে তাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করব। যাতে তারা নিজেদের মধ্যে সংঘবদ্ধ থাকতে পারে। প্রত্যাবর্তন করেও যেন তারা নিরাপত্তায় সেখানে থাকতে পারে।’

বাংলাদেশ সরকারের এই কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমার থেকে যারাই এসেছে তাদের সবাইকেই তালিকায় আনা হবে। ওই তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এরপর মিয়ানমার তাদের তৈরি ভেরিফিকেশন ফরম অনুযায়ী তালিকার ব্যাপারে যাচাই-বাছাই করবে। তিনি জানান, বাংলাদেশ সপ্তাহে ১৫ হাজার করে রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু মিয়ানমার প্রথম দিকে সপ্তাহে দেড় হাজার করে ফেরত নিতে সম্মত হয়েছে।
এদিকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রত্যাবাসন নিয়ে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। ফিরে যাওয়ার শর্ত তুলে ধরে সোমবারও বিক্ষোভ করার চেষ্টা করেছেন একদল রোহিঙ্গা। তারা বলেন, মিয়ানমারের নাগরিকত্বের অধিকার; নিজেদের ভূমি, বাড়িঘর মসজিদ ও স্কুল ফিরে পাওয়া, সেনা অভিযানের নামে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের বিচার; সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে গ্রেফতার রোহিঙ্গাদের মুক্তি এবং মিয়ানমারে ফেরার পর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেলে তারা ফিরে যাবেন না। রয়টার্স লিখেছে, ক্যাম্পের কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা সোমবার সকালে পালংখালি ক্যাম্পের কাছে লাউড স্পিকার ও নিজেদের দাবি সংবলিত ব্যানার নিয়ে বিক্ষোভ করার চেষ্টা করেন। পরে সেনা সদস্যরা গিয়ে সেখানে জড়ো হওয়া প্রায় ৩০০ রোহিঙ্গাকে সরিয়ে দেন এবং ব্যানার হাতে থাকা এক রোহিঙ্গা নেতাকে আটক করে নিয়ে যান।

অন্যদিকে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোর মানবিক পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি আলজাজিরা টিভি চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, কয়েক মাস পরই বাংলাদেশে বর্ষাকাল শুরু হবে। বর্ষাকালে সেখানকার জনাকীর্ণ ক্যাম্পগুলোতে ভূমিধসের কারণে আমরা হয়তো অনেককেই হতাহত হতে দেখব। অতিবৃষ্টির কারণে নানা ধরনের রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর জনাকীর্ণ অবস্থার উন্নতি ঘটাতে সহযোগিতা করার জন্য আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি প্রসঙ্গে ইয়াংহি লি বলেন, মিয়ানমারে এখনও রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা হল তারা কোথায় যাবে? তারা জীবনযাপনের সব উপকরণ হারিয়ে ফেলেছে। ঘর-বাড়ি, জমি ও ফসল সবই গেছে। তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রকৃত অবস্থা জানাতে হবে। এরপর তারা ফিরতে রাজি হলেই কেবল তাদের সেখানে পাঠানো যেতে পারে। রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়াটা হতে হবে স্বেচ্ছায়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/10007