২৩ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৫৫

বাঘ বাঁচলে বন বাঁচবে

সুন্দরবনে রয়েছে মাত্র ১০৬টি

জগতের এক অনন্য সৃষ্টি বাঘ। বাঘ হিংস্র নয় বরং উদার হৃদয়ের। বাঘ নিতান্ত নিরুপায় হয়ে মানুষ শিকার করে বা মানুষ নিজের দোষে বাঘের কবলে পড়ে শিকার হয়। উল্টো বাঘই মানুষকে ভয় পায়। পারতপক্ষে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। বাঘের প্রতি মানুষের মমতা জেগে উঠুক। ভালোবাসা জেগে উঠুক। ভয় দূর হয়ে যাক। ভয়ের বদলে তাকে সম্মান করা ও দূরে থাকা হোক। সুন্দরবনে অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। বাঘের ভেতরের চরিত্রটাকে তার মতো থাকতে দিতে পারলে মানুষের সঙ্গে বাঘের সংঘাত হবে না। তাতে বাঘেরও বদনাম হবে না মানুষখেকো হিসেবে, মানুষেরও বদনাম হবে না বাঘ হত্যাকারী হিসেবে। বাঘ বাঁচলে শুধু বন নয়, মানুষও বাঁচবে। আর বাঘের সংখ্যা কমায়, বন ধ্বংসের সঙ্গে ধ্বংস হবে মানুষও। সবশেষ হিসাব বলছে, সুন্দরবনে এখন মাত্র ১০৬টি বাঘ রয়েছে। বাঘগুলো মানুষরূপী হিংস্র প্রাণী, চোরাকারবারিদের হাত থেকে বাঁচতে উদ্বিগ্ন থাকছে। আগামী ২৫ জানুয়ারি শুরু হচ্ছে সুন্দরবনের বাঘ গণনা। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে এ কর্মসূচি চলবে বছরজুড়ে। এ উপলক্ষে বাঘ নিয়ে আলাপকালে এমন মন্তব্য খোদ পরিবেশ-প্রাণী বিশেষজ্ঞসহ বন সংরক্ষক, গবেষক ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তার।

বাঘ শিকারকে বীরত্বের প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে সুদূর অতীত থেকেই। তাই বাঘ হত্যার বর্বর আয়োজন নিয়ে গাওয়া ‘ও আমি বাঘ শিকার যামু, বন্দুক লইয়া রেডি হইলাম আমি আর মামু’ গানটি দেশের মানুষের কাছে বেশ পছন্দের। দেশে বাঘের সংখ্যা কমছে। এরই মধ্য দিয়ে প্রতিবছর ২৯ জুন বিশ্ব বাঘ দিবস পালিত হয়। পালিত হয় প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ। প্রতিবছরই দিনটি আসে, চলেও যায়। আলোচনা হয়, তারপর যেমন চলার তেমনই চলে। বন ও প্রাণী রক্ষা আইন কার্যকর করার ঘাটতিও আছে ষোলো আনার উপর আঠারো আনা। আইন কার্যকরী করতে সরকারি উদাসীনতা সীমাহীন। তাই দিন আসে, দিন যায়। বাঘ হত্যাকারী, চোরাকারবারি দাপিয়ে বেড়ায়।
গবেষণায় জানা যায়, বাংলাদেশের ভেতরে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বাজার তৈরি হয়েছে। সুন্দরবন এলাকায় বাঘ হত্যা ও চোরাকারবারিদের শক্তিশালী চক্র গড়ে উঠেছে। বাঘের মাংস, হাড়, চর্বি মূলত কবিরাজি ঔষধ, আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, গহনা এবং দর্শনীয় বস্তু হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। গত ১১ ডিসেম্বর প্রকাশিত ‘বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্থানীয় বাজারের সঙ্গে সুন্দরবনের বাঘ হত্যার সম্পর্ক’ শীর্ষক ওই গবেষণায় বলা হয়, সুন্দরবন সংলগ্ন চারটি উপজেলার স্থানীয় কিছু শিকারি ওই চক্রকে বাঘ হত্যা এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রিতে সহায়তা করছে।

বাঘ হত্যা, চোরাকারবারি রোধে ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম (ভিটিআরটি) কাজ করে যাচ্ছেন জানিয়ে, বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, খুলনার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভাগীয় বন কর্মকর্র্তা মো. মদিনুল আহসান যুগান্তরকে জানান, বাঘ হত্যা ও চোরাকারবারি পুরোপুরি বন্ধ করতে না পারলে বাঘ বাঁচানো সম্ভব হবে না। বাঘ মানুষের শত্রু নয়। এটি অনেক সুন্দর একটি প্রাণী। তারা উদার হৃদয়ের। তারা নিরুপায় হয়েই মানুষ শিকার করে কিংবা মানুষ নিজের দোষে বাঘের কবলে পড়ে। বাঘের প্রতি মমতাবোধ, ভালোবেসে ভয় দূর করতে হবে। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে বাঘ বেরিয়ে আসে ৪ বার, বাঘের আক্রমণে ২ জন মারা যায়। সচেতনতার অভাবে মানুষসহ গরু-ছাগলের ক্ষতি হচ্ছে। জঙ্গলে অবৈধভাবে ঢোকার ফলে এ দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে।
বনবিভাগ বলছে, ২০০০ সাল থেকে ২০১৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত ৩০টি বাঘকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হয় ৩২৮ জন। বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু হয় ১৩টি বাঘের। ২০১০ সালে টাইগার সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩টি বাঘসমৃদ্ধ দেশের সরকার প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। ওই সামিটে মূল বিষয় ছিল আগামী ২০২২ সালে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার। প্রতিটি দেশেকে বাঘ সংরক্ষণে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নসহ ১৬টি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশের বাঘ হত্যা এবং চোরাচালান নিয়ে তদারকি শুরু করেছে। সংস্থার প্রতিবেদনে, সুন্দরবনের বাঘ হত্যার পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী চক্র জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুন্দরবন থেকে বাঘ হত্যা করে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চীন ও থাইল্যান্ডের বাজারে পাচার হচ্ছে বলে ইন্টারপোলের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে র্যা বের আইন ও গণমাধ্যম শাখার উপ-পরিচালক মেজর রইসুল আজম যুগান্তরকে জানান, বনদস্যুদের নিয়ন্ত্রণ নয়, তাদের গ্রেফতার ও আত্মসমর্থণ করিয়ে শূন্যের কোঠায় আনার চেষ্টা চালাচ্ছে র্যা ব। র্যা ব প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৯০ জন বনদস্যুকে গ্রেফতার, ৩১৬টি অস্ত্র ও প্রায় ১৭ হাজার গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া একাধিক অভিযানে ৯টি বাঘ উদ্ধারসহ ১৬ জন বাঘ চোরাকারবারিকে আটক করা হয়। বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয় ২৩টি এবং দাঁত উদ্ধার করা হয় ৫৫টি। বাঘ হত্যা, চোরাকারবারিদের রক্ষা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, অপরাধীদের বিরুদ্ধে র্যা বের অভিযান চলছে।

সচেতনতার মাধ্যমেই বাঘ রক্ষা সম্ভব জানিয়ে প্রধান বন সংরক্ষক শফিউল আলম চৌধুরী বলেন, ২০১৫ সালে সরকারের করা জরিপে ১০৬ টি বাঘ পাওয়া যায়। ২০০৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৪০ টি। বাঘ হত্যা কমে আসছে, তবে চোরাচালান রোধ করতে না পারলে কোনো কিছুই কাজে আসবে না। বনবিভাগের একার পক্ষে বাঘ হত্যা ও চোরাচালান বন্ধ করা যাবে না। এজন্য দেশের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। ভিটিআরটি’র মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ এবং বণ্যপ্রাণী বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়াইল্ড টিমের ১০ গবেষকের উদ্যোগে পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, সেখানে স্থানীয় ১৩৭ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৯০ জন বলছেন বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহারে উপকার পাওয়া যায়। জরিপের তথ্য অনুযায়ী রোগব্যাধি দূর করতে মানুষ বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহার করছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও ওয়াইল্ড টিমের প্রধান নির্বাহী আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বাঘের মাংস-চর্বি খাওয়া সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর এবং অবৈজ্ঞানিক। এগুলো রোগ দূর করার জন্য খেলে উল্টো নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বাঘের মাংসে রোগ নিরাময়কে তিনি কুসংস্কার বলে মন্তব্য করেন।

জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান যুগান্তরকে বলেন, সুন্দরবনে ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী মাত্র ১০৬টি বাঘ আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, চোরাশিকারিদের কবলে পড়ে বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই কম্বোডিয়া থেকে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চীন ও ভিয়েতনামে মাত্র পাঁচ থেকে ছয়টি বাঘ রয়েছে। বাঘ হত্যা ও চোরাচালান বন্ধ করতে না পারলে বাংলাদেশ থেকেও বিলুপ্ত হয়ে পড়বে বাঘ। দেশের ভেতর বাঘের যে সব বাজার তৈরি হয়েছে তা দ্রুত বন্ধ করতে হবে। বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে ওষুধ বিক্রেতাদের গ্রেফতার করতে হবে। নতুবা জাতীয় প্রাণীর নামটিই শুধু থাকবে বাংলাদেশে।

বিশ্ব বন্য প্রাণী তহবিলের (ডব্লিউডব্লিউএফ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৮ বছরে ভারত নেপাল ও রাশিয়ায় বাঘের সংখ্যা বাড়লেও বাংলাদেশে তা কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, সুন্দরবনের আয়তন অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণে হরিণ ও শূকরের মতো বাঘের শিকার প্রাণী নিশ্চিত করা হলে এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করা সম্ভব। ফলে এই কয়েকটি বাঘকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে হলে বাঘ রক্ষায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বাঘের সংখ্যা কমছে এটা খুবই পীড়াদায়ক জানিয়ে জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন যুগান্তরকে জানান, বাঘ জাতীয় প্রাণী, আমাদের শক্তির উৎসও বটে। যে কোনো মূলে বাঘের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বাঘ শুধু রক্ষা নয়, সংখ্যা বাড়িয়ে ছয়শ’তে নিয়ে যেতে হবে। চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বাঘ হারালে দেশের অনেক কিছুই হারিয়ে যাবে।

২৫ জানুয়ারি বাঘ গণনা শুরু : ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে সুন্দরবনে বছরব্যাপী বাঘ গণনা শুরু হচ্ছে। এই প্রথম বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে সুন্দরবনে বাঘ গণনা করা হবে। ১১ ফেব্রুয়ারি শুরু হবে প্রথম পর্যায়ে ক্যামেরা লাগানোর কাজ। তিনটি পর্যায়ে এ গণনা চলবে। জঙ্গলকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে ৪০টি দল গঠন করা হবে। এ জন্য তিনটি পর্যায়ে প্রায় ১৪১০টি অত্যাধুনিক ক্যামেরা লাগানো হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/10002