২৩ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৫৪

আমানত তুলে নিচ্ছে গ্রাহক বেকায়দায় বাণিজ্যিক ব্যাংক

ব্যাংকাররা উভয় সঙ্কটে

গ্রাহক ব্যাংক থেকে আমানত প্রত্যাহার করে নেয়ায় ঋণ আমানতের অনুপাত (সিডিআর) বেড়ে গেছে। এক দিকে আমানত কমায় ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে, অপর দিকে সিডিআর বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জরিমানা গুনতে হচ্ছে। এতে উভয় সঙ্কটে পড়েছেন তারা। গ্রাহক তার আমানত তুলে নিলে এর দায় কেন ব্যাংক নেবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকই কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
কথাগুলো বলছিলেন দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি। গত সপ্তাহে ইসলামী ব্যাংকের ইসি কমিটির চেয়ারম্যানও একই উক্তি করেছিলেন এক সংবাদ সম্মেলনে। ব্যাংকটির এক বছরের আর্থিক অবস্থা তুলে ধরতে ব্যাংকটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপর একটি ব্যাংকের এমডি নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, আমানতকারীরা ব্যাংকের কাছে যে আমানত রাখে তা ব্যাংক অলস বসিয়ে রাখে না। বিনিয়োগ করে থাকে। এখন আমানতকারীদের অর্থ যেকোনো মুহূর্তে প্রত্যাহার করে নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমানতকারীর পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু ব্যাংক আমানতকারীদের যে অংশটুকু বিনিয়োগ করে তা রাতারাতি বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে না। ব্যাংকগুলোর জন্য এখানেই বিপত্তি। বিষয়টিকে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুধাবন করতে হবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের কাছ থেকে যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করে তার পুরোপুরি বিনিয়োগ করতে পারে না। ১০০ টাকার আমানত নিলে প্রচলিত ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা এবং ইসলামী ব্যাংকগুলো ৯০ টাকা বিনিয়োগ করতে পারে। একেই ঋণ আমানতের অনুপাত বলা হয়। অর্থাৎ একটি ব্যাংক সর্বোচ্চ কী পরিমাণ বিনিয়োগ করতে পারবে তার সীমা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এর বাইরে আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ১০০ টাকা আমানত নিলে প্রচলিত ব্যাংকগুলোকে সাড়ে ১৯ টাকা এসএলআর ও সিআরআর হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। এর মধ্যে ১৫ দিন অন্তে সাড়ে ৬ টাকা নগদে এবং ১৩ টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা, ট্রেজারি, বিল-বন্ড ইত্যাদির মাধ্যমে সংরক্ষণ করতে হয়।

এখন একটি ব্যাংকের আমানত ১০০ টাকা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশেনা অনুযায়ী ব্যাংকটি ৮৫ টাকা বিনিয়োগ করতে পারে। এ বিনিয়োগ বিভিন্ন মেয়াদি বিনিয়োগ হতে পারে। এখন কোনো আমানতকারী তার ১০ টাকার আমানত প্রত্যাহার করে নিলে ব্যাংকের ১০০ টাকার আমানত কমে নামে ৯০ টাকায়। কিন্তু ব্যাংক রাতারাতি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে পারে না। ব্যাংকটির বিনিয়োগ ৮৫ টাকাই থাকছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ আমানতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকটির ঋণ আমানতের অনুপাত ৯৪ দশমিক ৪৪ শতাংশে উঠে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ঋণ আমানতের অনুপাত কোনো ক্রমেই ৮৫ ভাগের অতিরিক্ত হবে না। বেশি হলেই জরিমানা বা তিরস্কার গুনতে হবে। সম্প্রতি কয়েকটি ব্যাংকের এমন তিরস্কারও শুনতে হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে। কয়েকটি ব্যাংককে এ জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।
কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, বিনিয়োগ মন্দায় ও বিনিয়োগ চাহিদা না থাকায় ব্যাংকগুলো গত কয়েক বছর ধরে আমানত সংগ্রহে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে। আমানতের সুদ বা মুনাফার হার কমানো হয়। বছর চারেক আগে ১০০ টাকার আমানত নিতে যেখানে সর্বোচ্চ ১৪ টাকা পর্যন্ত সুদ বা মুনাফা দেয়া হতো, এখন তা কমতে কমতে তলানিতে নেমে গেছে। অর্থাৎ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংক রেট ৫ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। কিন্তু সঞ্চয়পত্রের সুদহার এখনো সাড়ে ১১ শতাংশই রয়ে গেছে। ফলে সাধারণ আমানতকারীরা বেশি মুনাফার আশায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছে। আগে যেখানে সরকারের বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হতো না, গত তিন বছর ধরে মাত্র তিন-চার মাসেই পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করছে। যেমনÑ গত অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) যেখানে ২০ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা ছিল, যা এ বছরে একই সময়ে ২১ হাজার ১৭২ কোটি টাকায় উঠে গেছে। আবার ইসলামী ব্যাংকগুলোর যেহেতু শরিয়া ভিত্তিতে পরিচালিত হয় এ কারণে এসব ব্যাংকের আমানতকারীরা বেশি মুনাফার আশায় ব্যাংকের পরিবর্তে পুঁজিবাজারসহ নানা ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করছেন। এতেই কমে যাচ্ছে ব্যাংকের আমানত।

আমানত কমলেও রাতারাতি বিনিয়োগ আদায় করা যাচ্ছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ দেখিয়ে অনেকেই ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করছে না। ফলে রাতারাতি ব্যাংকের ঋণ বা বিনিয়োগ কমানো যাচ্ছে না। এ দিকে আমানত প্রত্যাহার হওয়ায় বা নতুন আমানত কম আসায় ঋণ আমানতের অনুপাত বেড়ে যাচ্ছে। দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি গতকাল নয়া দিগন্তের এ প্রতিনিধির কাছে আক্ষেপ করে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর এসব যুক্তি মানতে নারাজ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একই কথা তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী ঋণ আমানতের অনুপাত কমিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় নিয়ম লঙ্ঘনের দায়ে জরিমানা গুনতে হবে। এক দিকে আমানত কমায় তাদের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে, অপর দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জরিমানা গুনতে হবে। এ যেন তারা উভয় সঙ্কটে পড়েছেন।
গত ৩ জানুয়ারি সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সাথে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের লক্ষ্য ছিল ১৬ দশমিক ২ শতাংশ, কিন্তু নভেম্বরেই তা ১৯ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ হয়ে গেছে। তাই ঋণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে ঋণ আমানত অনুপাত কমিয়ে আনা হবে। প্রচলিত ব্যাংকগুলোর জন্য ৮৫ শতাংশের পরিবর্তে ৮০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ৯০ ভাগের পরিবর্তে ৮৮ শতাংশ করা হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কাজও শুরু করা হয়েছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এ পদক্ষেপ নেয়া হলে, ব্যাংকগুলোর জন্য আরো খারাপ অবস্থা হবে। যেহেতু রাতারাতি ঋণ বা বিনিয়োগ কমিয়ে আনা যাবে না, তাই আমানত বাড়াতে সুদ বা মুনাফার হার আরো বাড়ানো হবে। শুরু হয়ে যাবে অসাধু প্রতিযোগিতা। এতে এক ব্যাংকের আমানত আরেক ব্যাংকে চলে যাবে। এমন কাড়াকাড়িতে ব্যাংকিং খাতে আবারো অস্বস্তিদায়ক পরিস্থিতি নেমে আসবে।
বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন ব্যাংকাররা। বাংলাদেশ ব্যাংককে তার সম্ভাব্য পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে ইতোমধ্যেই ব্যাংকারদের শীর্ষ সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/287391