২৩ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৪৯

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অজানা আতঙ্ক

সুনসান নীরবতা

আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর হাতে শিা মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মকর্তা-কর্মচারী আটক হওয়ার পর পুরো মন্ত্রণালয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি শাখায় যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ আছে, তারা অজানা আতঙ্কে রয়েছেন। গতকাল বিষয়টি নিয়ে কর্মচারীদের কানা-ঘুষা করতে দেখা গেছে। মন্ত্রণালয়ের বারান্দায় কোনো তদবিরবাজ ও শিক্ষা ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তাকে দেখা যায়নি। সুনসান নীরবতা ছিল মন্ত্রণালয়ে। তদবির করতে আসা লোকজনকেও লবির সোফাগুলোতে বসে থাকতে দেখা যায়নি।
মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের মাধ্যমিক শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবু আলম খানের খোঁজে তার বাসায় অপরিচিত লোকজন গিয়েছিলেন গত শনিবার। এরপর গতকাল তিনি অফিসে আসেননি। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও বন্ধ রয়েছে। যদিও গত রোববার তিনি অফিস করেছেন। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের কাছে গিয়ে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কান্নাকাটি করেছিলেন। এ ব্যাপারে গতকাল মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করতে চাইলে কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

জানা গেছে, আবু আলম খান ছুটি নিয়েছেন। যে অভিযোগে মন্ত্রীর পিও মোতালেব হোসেন এবং কর্মচারী নাসির উদ্দীনকে পুলিশ আটক করেছে, একই অভিযোগ তারও বিরুদ্ধে থাকতে পারে। এ ব্যাপারে তারা বলছেন, রোববার অফিস করলেও আজ (গতকাল) কেন তিনি অনুপস্থিত তা তাদের জানা নেই। ওই দু’জনকে গ্রেফতার দেখানোর পর থেকেই তিনি আর মিরপুরের বাসায় থাকছেন না বলে মন্ত্রণালয়ের কেউ কেউ বলেছেন। তার ছুটি নেয়া, মোবাইল ফোন বন্ধ থাকা এবং নিজ বাসায় অবস্থান না করা নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে মন্ত্রণালয়ে।
গতকাল পুরো মন্ত্রণালয়ে এক ধরনের চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছিল। নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা ও কানা-ঘুষা চলছিল টেবিলে-টেবিলে। অপিরিচিত বা মন্ত্রণালয়ের বাইরের কাউকে দেখলেই সবাইকে নড়েচড়ে বসতে দেখা গেছে। পদস্থ বিশেষ করে একাধিক অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিব মন্ত্রীর পিও মোতালেব এবং উচ্চমান সহকারী নাসির সম্পর্কে এবং তাদের কী হচ্ছেÑ হবে কেনইবা তাদের আটক করা হলো জানতে চেয়েছেন পরিচিতিদের কাছে। পদস্থ কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের এড়িয়ে গেছেন। তবে মন্ত্রী গতকাল সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছেন।
শিক্ষামন্ত্রী বর্তমান সরকারের টানা দ্বিতীয় মেয়াদে একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই দুর্নীতি অনিয়ম অব্যবস্থাপনা অনেকটাই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক শাখা, কলেজ শাখা, এমপিও শাখা, সরকারি কলেজ শাখা, বেসরকারি স্কুল ও বেসরকারি কলেজ শাখা, সরকারি-বেসরকারি কারিগরি শাখা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখাসহ সর্বত্রই এক ধরনের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।

দেশের কোনো না কোনো এলাকা থেকে নানা সমস্যা নিয়ে ভুক্তভোগীরা প্রতিনিয়তই মন্ত্রণালয়ের এসব শাখায় আসেন। কাজ উদ্ধারে মন্ত্রী-সচিব থেকে শুরু করে শাখার একজন পিয়নেরও দ্বারস্থ হন তারা। এ সময় তারা বৈধ-অবৈধ যেকোনো পন্থায় সমস্যার সমাধান চান। এরই সুযোগ নেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ওইসব শাখার প্রতিটিতেই অনিয়ম-দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা ও ঘুষের ছড়াছড়ি অনেকটাই ‘ওপেন সিক্রেট’।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি কলেজে শিক্ষকদের প্রতিটি বদলিতেই অবৈধ লেনদেন হয়ে থাকে। গত কয়েক বছরে টাকা ছাড়া কারো বদলি হয়েছে এমন নজির নেই। এ শাখায় এটি এখন ওপেন সিক্রেট। এ শাখার দায়িত্বে রয়েছেন একজন অতিরিক্ত সচিব। তিনি একসময় মন্ত্রীর পিএস (একান্ত সচিব) ছিলেন।
গত ৮-৯ বছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই একই পদে ও দায়িত্বে কাজ করছেন। মন্ত্রণালয়ের বর্তমান সচিব এবং বিভিন্ন উইং বা শাখাপ্রধান হিসেবে অতিরিক্ত সচিব পদে যারা কর্মরত তাদের অনেকেই মন্ত্রীর একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন।
মন্ত্রীর পিও মোতালেব হোসেন নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে এ পদে কর্মরত ছিলেন। দ্বিতীয় মেয়াদে আবারো একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর একবার তাকে অন্যত্র বদলি করা হলেও কয়েক মাসের মাথায় পিও পদে আবারো ফিরে আসেন মোতালেব হোসেন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত পিওর দায়িত্ব পালন করছিলেন।

এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের ও সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বলেছেন, মোতালেব হোসেন সম্পর্কে পুরো মন্ত্রণালয়েই নানা আলাপ-আলোচনা ছিল। একই আলোচনা ছিল মাধ্যমিক শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবু আলম খানের ব্যাপারেও। তিনি অন্য শাখায় কর্মরত থাকলেও মাধ্যমিক শাখায় বদলির পর তার আচার-আচরণ ও চলাফেরায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এ শাখায় প্রতিদিনই লোকজনের ভিড় লেগেই থাকত।
গতকাল মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠক শেষে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সচিবালয়ে ফিরে এলে সাংবাদিকেরা তার সাথে কথা বলেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তিনি নিয়োগ-পদায়ন করেন না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক শাখা থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর পদটিই শুধু অস্থায়ী পদ। অন্যরা সরকারি বিধি মোতাবেক নিয়োগ পেয়ে থাকেন।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ দেশ ও সমাজের বাইরে নয়। তবে এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়মের ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করে আসছি। তিনি বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) অধীন ডিআইএ ছিল এত দিন অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির আখড়া। আধুনিকায়নের মাধ্যমে আমরাই এটিকে অনেক উন্নত করেছি। তিনি বলেন, বিভিন্ন সংস্থা বলেছে, সারা বিশ্বে শিক্ষায় দুর্নীতি ১৭ শতাংশ, কিন্তু বাংলাদেশে এ হার ১২ শতাংশ। আমরা ঘুষ-দুর্নীতির ব্যাপারে কোনো ছাড় দেইনি, দেবো না।

মোতালেব-নাসির নিখোঁজ ও পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হওয়া প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে গেছে, নিশ্চয়ই কোনো অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। আদালতেই তাদের (মোতালেব-নাসির) প্রমাণ করতে হবে অভিযোগ সম্পর্কে। অভিযুক্ত হলে শাস্তি হবে। এরপর মন্ত্রণালয় তাদের ব্যাপারে কঠোর ও সর্বোচ্চ বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবে। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়মের ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই। আমরা কখনোই এগুলো প্রশ্রয় দেইনি। বরদাশতও করা হবে না। কেউ অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অপর দিকে গতকাল রাজধানী উচ্চবিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজার মণ্ডপ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, পুলিশ ও ডিবি কাউকে ধরলে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই ধরে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/287351