যশোরের চৌগাছায় কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত একটি বীজতলা
২২ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ৮:২৬

ইরি-বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার আশঙ্কা

কোল্ড ইনজুরিতে বীজতলা নষ্ট

যশোর, শেরপুর, পাবনা ও ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোল্ড ইনজুরিতে বীজতলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ইরি-বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের নানা পরামর্শ দিচ্ছেন।
এম এ রহিম চৌগাছা (যশোর) সংবাদদাতা জানান, যশোরের চৌগাছায় কোল্ড ইনজুরিতে বীজতলার চারা নষ্ট হওয়ায় ইরি-বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশায় প্রচণ্ড শীতে উপজেলার বোরো ধানের বীজতলা কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কৃষকরা বীজতলায় ওষুধ ব্যবহার করেও রক্ষা করতে পারছেন না। এতে চলতি মওসুমে ইরি-বোরো ধান আবাদে চারা সঙ্কটে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এ বছর ইরি-বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ হাজার ৭৫৫ হেক্টর। সে লক্ষ্যে তেজ গোল্ড, এসি আই-২, হাইব্রিড ১২০৩, সুবল লতা, মিনিকেট, ব্রি ধান-২৮, ৫০, ৫৮ ব্রি ধান ৬৩ জাতের বীজতলা তৈরি করা হয়েছে ৭৫০ হেক্টর জমিতে। এসব বীজতলার মধ্যে বেশির ভাগ বীজতলা কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছে।

মাঠপর্যায়ের কৃষকদের অভিযোগ কৃষি কর্মকর্তারা তাদের এ দুর্যোগে সে রকম কিছু করছেন না। এমতাবস্থায় কৃষকেরা বোরো আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এ দিকে কৃষি অফিস থেকে বলা হচ্ছে, তারা কৃষকদের পাশে রয়েছেন এবং এ অবস্থার উন্নতি করতেই তারা রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছেন। শৈত্যপ্রবাহ কেটে গেলেই বীজতলা স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। ফলে বোরো উৎপাদনে কোনো প্রভাব পড়বে না।
এ ব্যাপারে উপজেলার ছোটকুলি গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর আলম জানান, সাম্প্রতিক শৈত্যপ্রবাহে তাপমাত্রা নেমে আসে ৫-৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। সেই সাথে প্রকৃতি ঢেকে যায় ঘনকুয়াশায়। তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশা সহ্য করতে পারেনি ধানের ছোট ছোট চারা। ঠাণ্ডায় বীজতলার বেশির ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। একই গ্রামের কৃষাণী ইতি রাণী জানান, আমন মওসুমে বারবার ভারী বৃষ্টির কারণে ধানে লোকসান গুনতে হয়েছে। তাই সেই লোকসান পুষিয়ে নিতেই বেশি করে বোরো আবাদ করতে বেশি দামে ধানবীজ কিনে বীজতলা তৈরি করেছিলাম। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ার ফলে তা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যদি আবহাওয়া ও তাপমাত্রার পরিবর্তন না হয় এ এলাকায় ইরি-বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রইচ উদ্দীন বলেন, বীজতলাকে কোল্ড ইনজুরি থেকে রক্ষা করতে সন্ধ্যায় সেচ দিয়ে সকালে সে পানি জমি থেকে বের করে দিয়ে বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
আকরাম হোসাইন শেরপুর (বগুড়া) সংবাদদাতা জানান, শেরপুরে প্রচণ্ড শীত (কোল্ড ইনজুরি) ও নানামুখী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বোরো বীজতলার চারাগুলো মরে শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে কৃষক। তারা বীজতলার চারা বাঁচাতে কৃষি অফিসের পরামর্শের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার ওষুধ ব্যবহার করে ব্যর্থ হওয়ায় এ মওসুমে বোরো বীজের চারা সঙ্কট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা।
সরেজমিন বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে জানা যায়, একটানা শৈত্যপ্রবাহ ও ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে ‘কোন্ড ইনজুরি’র পাশাপাশি নানা ধরনের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মরে খড়ের আকার ধারণ করছে। এতে কৃষকেরা তাদের বীজতলার চারা বাঁচাতে বিভিন্ন কীটনাশকের দোকানে গিয়ে নানা পরামর্শের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক কিনে চারায় প্রয়োগ করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। এতে তারা আবার দৌড়াচ্ছেন কৃষি অফিসে সেখানে গিয়েও কৃষক নানা ধরনের পরামর্শ গ্রহণ করেও কোনো উপকার পাচ্ছেন না বলে জনিয়েছেন।

কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এ বছর শেরপুর উপজেলায় বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। আর বোরো বীজতলায় বীজ রোপিত হয়েছে ১২শ ৫৫ হেক্টর জমিতে। এ বছর উপজেলায় দেশী জাতের বিআর ২৮, বিআর-২৯, বিআর-৫৯, বিআর-৬১, বিআর-৬২ ও মিনিকেট। এ ছাড়া ইন্ডিয়ান জাত সুবললতা, কাজললতাসহ হাইব্রিড জাতের বিভিন্ন ধানের বীজ বপন করা হয়েছে।
সাগরপুর গ্রামের আন্দারু, মাগুরগাড়ির কৃষক আফজাল হোসেনসহ একাধিক কৃষক জানান, ‘ঠাণ্ডায় বীজতলায় মড়ক দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যেই বেশির ভাগ বীজতলার চারা মরে গেছে। মনে হয় এবার চারার সঙ্কট দেখা দেবে। তারা জানান বিশেষ করে সুবললতা ধানের চারায় এ রোগের প্রকোপ বেশি। তবে কাটারীভোগ, কাজললতাসহ অন্যান্য জাতের ধানের বীজতলায় এ রোগের আক্রমণ দেখা গেছে।
শেরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খাজানুর রহমান বলেন, তবে ইন্ডিয়ান জাতের বীজের চারায় এ রোগের আক্রমণ বেশি। তিনি আরো বলেন, দেশী জাতের ধানের চাষ করতে হবে কৃষকদের। তাহলে রোগবালাই কম হবে।
ইকবাল কবীর চাটমোহর (পাবনা) থেকে জানান, জানুয়ারি মাসের শুরু থেকে প্রায় পক্ষকালব্যাপী শৈত্যপ্রবাহের কারণে চাটমোহরের বোরো বীজতলাগুলো কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছে। বীজতলার চারা হলুদ হয়ে মরে যাচ্ছে। ফলে চলতি মওসুমে এ এলাকার কৃষকেরা বোরোবীজ সঙ্কটের আশঙ্কা করলেও কৃষি অফিস সূত্র জানায়, আপাতত আশঙ্কার কোনো কারণ নেই।

জানা গেছে, ঘন কুয়াশা, তীব্র শীত ও প্রয়োজনীয় সূর্যালোক না পাওয়ায় প্রথমে চারাগুলো হলুদ হয়ে যায়। পরে সে গুলো মরে শুকিয়ে যাচ্ছে। উপজেলা বিলচলন ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের কৃষক এনামুল হক জানান, চলতি বোরো চাষ মওসুমের শুরুতেই এ এলাকায় বোরো বীজ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। প্রতি কানি (৪ হাত বাই ৪ হাত) বোরো চারা ১৫০ থেকে ১৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যেসব কৃষক জমিতে বোরো চারা রোপণ করেছিলেন তাদের রোপণকৃত অনেক চারা মারা যাওয়ায় সেসব জমিতে ফের চারা রোপণ করতে হচ্ছে। ফলে বাড়ছে কৃষকের খরচ। পাশাপাশি নাবী চারা অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চারা সঙ্কট ব্যাপক আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মো: আব্দুল আউয়াল ঈশ্বরগঞ্জ (ময়মনসিংহ) থেকে জানান, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে প্রচণ্ড শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে চলমান ইরি-বোরো চাষ থমকে দাঁড়িয়েছে। প্রচণ্ড শীত আর ঘন কুয়াশায় বোরো বীজতলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বীজতলার চারা গাছগুলো লালচে হলুদ বর্ণ হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। এসব চারা দিয়ে ভালো ফলনের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কৃষক।

জানা যায়, উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১১টি ইউনিয়নেই কম বেশি ইরি-বোরো চাষাবাদ হয়ে থাকে। চলমান ইরি-বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার ৩২৮ হেক্টর জমিতে। এ লক্ষ্যমাত্রায় বাদ সাধছে শীত আর ঘন কুয়াশা। কৃষকেরা সময় মতো বোরো আবাদ করতে পারবে কি না তা নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, বয়ে যাওয়া শৈতপ্রবাহের পর প্রচণ্ড শীত আর ঘন কুয়াশার কারণে সূর্যের পর্যাপ্ত আলো না পাওয়ায় বীজতলার চারা গাছগুলো ‘কোল্ড ইনজুরি’তে আক্রান্ত হয়েছে। এ দিকে তীব্র শীতের কারণে দিনমজুররা বেশিক্ষণ মাঠে কাজ করতে পারছেন না। ফলে বোরো আবাদে দেখা দিয়েছে ধীরগতি। তাই নির্দিষ্ট সময়ে ইরি-বোরো আবাদে কিছুটা ভাটা পড়ছে। প্রতি বছর ঠিক এ সময়ে ইরি-বোরো চাষে কৃষকেরা বীজতলা থেকে বীজ উত্তোলন, দিনরাত সেচপাম্প খোলা এবং চারা রোপণে ব্যস্ত থাকেন। মওসুমের এ পর্যায়ে ৫০ ভাগ জমিতে চারা রোপণ হয়ে যায়। কোনো কোনো এলাকায় সেচপাম্প এখনো বন্ধ রয়েছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রহিমা খাতুন জানান, ঘন কুয়াশা আর শীতের কারণে সূর্যের আলো না থাকায় বীজতলাগুলো লালচে হচ্ছে। সূর্যের পর্যাপ্ত আলো না পাওয়ায় বীজতলার চারা গাছগুলো ‘কোল্ড ইনজুরি’তে আক্রান্ত হয়েছে। কৃষকেরা বোরো লাগাতে শুরু করেছেন। তাই বীজতলায় বড় ধরনের তেমন ক্ষতির আশঙ্কা নেই। চারা ক্ষেতে লাগানো হয়ে গেলে হলুদ ও লালচে রঙ থাকবে না। প্রকৃতির ওপর কারো হাত নেই। প্রকৃতি বিরূপ আচরণ করলে কিছুটা ক্ষতির আশঙ্কা আছে। তবে মাঠকর্মীরা মাঠপর্যায়ে বীজতলাসহ অন্যান্য ফসল নিবিড় পর্যবেক্ষণসহ কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/287067