২২ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ৮:২০

বিরোধীজোটকে কোর্টের বারান্দায় আটকে রেখেই নির্বাচন পার করার পরিকল্পনা?

নতুন বছরকে ‘নির্বাচনী’ বছর বিবেচনা করে রাজনীতির মাঠে নানা প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। তবে সরকারি মহল তাদের বিরোধীজোটকে আদালতের বারান্দায় আটকে রেখেই নির্বাচন পার করার কৌশল নিয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। এই কৌশলেরই অংশ হিসেবে অসংখ্য মামলায় জড়িয়ে রাখা হয়েছে কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের মূল নেতাদের।

নির্বাচনের এক বছর বাকি থাকলেও প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচনের আগাম প্রচার-প্রচারণা মাঠে গড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ যখন সাংগঠনিক ও নির্বাচনী তৎপরতা জোরদার করছে তখন বিএনপিজোটের নেতাদের ব্যস্ত সময় কাটাতে হচ্ছে আদালতে। বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে শুধু রাজধানীর বকশীবাজারের অস্থায়ী আদালতেই বিচারাধীন রয়েছে ১৬টি মামলা। এরমধ্যে একটি মামলা একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। চলতি মাসেই এ মামলার কার্যক্রম শেষ হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। সপ্তাহের ৩-৪ দিন খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজিরা দিয়ে সময় কাটাতে হচ্ছে। তার সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও হাজির থাকছেন আদালতে। সামনের দিনগুলোতে এ হাজিরার সংখ্যা আরো বাড়তে থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। পরিস্থিতি না বদলালে কোর্ট-কাছারিতেই চলতি বছর কাটাতে হবে বিএনপি নেত্রীকে। দলটির প্রায় সব নেতারই একই অবস্থা। সরকারের পক্ষ থেকে এই পরিস্থিতিকে ‘আইনের নিজস্ব গতি’ বলে প্রচার চালানো হলেও এটা যে সরকারি কৌশলেরই একটা অংশ এব্যাপারে নিশ্চিত রাজনৈতিক মহল।

বিরোধীজোটের আইনজীবীদের অভিযোগ, মামলা-কৌশলেরই অংশ হয়ে ইতোমধ্যে বিএনপির দ্বিতীয় প্রধান নেতা তারেক রহমানের একটি মামলায় হাইকোর্টে সাজা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার কার্যক্রমও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে অবস্থান করা তারেক রহমান এসব মামলায় পূর্ণাঙ্গ আইনি লড়াইয়েরও সুযোগ পাচ্ছেন না। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধেও রয়েছে প্রায় একশ’ মামলা। তাকেও ব্যস্ত সময় কাটাতে হচ্ছে আদালত পাড়ায়। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের প্রায় প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে একাধিক মামলা। এসব মামলায় তাদেরকেও প্রতিনিয়ত হাজিরা দিতে হচ্ছে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সর্বত্রই একই চিত্র। সাবেক এমপিদের কেউ কেউ এরইমধ্যে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, ‘সরকার চায় না বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিক। এ কারণে এসব মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। সরকার বিরোধী শক্তিকে নির্মূল করতে চায়। এ জন্যই এসব করা হচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এসব মামলা দায়ের করা হয়েছে তাকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে।’ নেতাদের মতে, ‘বর্তমান পরিবেশে নির্বাচনী প্রচারণা দূরের কথা, তাদেরকে স্বাভাবিক রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কার্যক্রমই পরিচালনা করতে দেয়া হচ্ছে না।’

মামলা-কৌশল প্রয়োগ
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমনিতেই বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিরোধীদের রাজনৈতিক ময়দান থেকে উচ্ছেদ করার জন্য সবরকম কৌশল-অপকৌশল প্রয়োগ করে আসছে। সেই থেকে এযাবত দেশের সর্বত্র বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের উপর হামলা, মামলা, গুম, খুন প্রভৃতি দমনমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে। বিশেষ করে একেকজন নেতা-কর্মীকে কাবু করার জন্য মামলা দায়ের করাকে এক ‘মোক্ষম’ হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দেয়া শুরু হয়। সারা দেশে কেবল কথিত নাশকতার অভিযোগেই জোটের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলার সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। আসামি করা হয়েছে জোটের প্রায় সাড়ে চার লাখ নেতা-কর্মীকে।
গত কয়েক বছরের চিত্রে দেখা যায়, বিরোধী জোটের প্রধান দুই দল বিএনপি ও জামায়াতের কেন্দ্রীয়, জেলা ও তৃণমূল পর্যায়ের এমন নেতা খুঁজে পাওয়া যাবে না যাদের নামে মামলা নেই। প্রতিদিনই কোন না নেতা গ্রেফতার হয়ে চলেছেন। দৌড়ের উপর আর আত্মগোপনের মধ্যে থাকতে হচ্ছে তাদের। আর এটাই সরকারের কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দল দু’টিকে ধ্বংস করার জন্য নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হয়ে দায়েরকৃত মামলাগুলো এখন যেনতেন বিচারকার্য সমাধা করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। বিএনপি নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ নেতৃবৃন্দকে দোষী সাব্যস্ত করে তাদের নির্বাচনের অযোগ্য করানোর আয়োজন চলছে- এমন অভিযোগ করে আসছে বিএনপি। আদালতে লড়াইরত আইনজীবী, ভুক্তভোগী বিএনপি-জামায়াত নেতৃবৃন্দ প্রমুখদের ধারণা, আওয়ামী লীগ সরকার চাচ্ছে মামলার খড়গ ও শাস্তি দিয়ে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকে আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে। তারা জানান, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা থাকার কারণে তারা প্রতিনিয়ত পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। মামলায় জামিন নিতে গিয়ে তারা গলদঘর্ম হচ্ছেন। কোনো কোনো নেতাকে সপ্তাহে অন্তত চার দিন আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। মামলা ছাড়াও পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হুমকি-ধমকিতে তারা দিশেহারা। রাজনৈতিক সুত্রগুলো থেকে বলা হচ্ছে, নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অন্তত অর্ধলক্ষ মামলা আছে এবং দিন দিন এ মামলার সংখ্যা বাড়ছে। এসব মামলায় লাখ লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, রাষ্ট্রদ্রোহ, নাশকতা ও মানহানির অভিযোগে প্রায় ৩৪টি মামলা রয়েছে। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ শতাধিক মামলা রয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে নাশকতা ও মানহানির অভিযোগে প্রায় ১শ’ মামলা, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৭৮টি, বিএনপি নেতা ও বিশিষ্ট সাংবাদিক শওকত মাহমুদের বিরুদ্ধে ২২টি, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে ৭০ থেকে ৭৫টি, হাবিব উন নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে ১১০টি, যুবদল নেতা সাইফুল ইসলাম নিরবের বিরুদ্ধে সর্বাধিক ১৪৩টি মামলা রয়েছে। অনেক জামায়াত নেতা-কর্মীর একেকজনের বিরুদ্ধেও বহুসংখ্যক মামলা বিদ্যমান। বর্তমানে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক জোটের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দায়ের করা আছে। এসব মামলার আসামি সাত লক্ষাধিক। অন্যতম বৃহৎ বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যাই প্রায় ২৬ হাজার। এগুলোর মোট আসামী প্রায় ৫ লাখ। এই বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মীকে আদালতের বারান্দায় আটকে রেখে সরকারদলীয়রা অবাধে নির্বাচনী কর্মকা-ে নিয়োজিত থাকতে পারবে বলে তারা আশা করছে। এদিকে গ্রেফতারের পর জামিন পাওয়া মাত্রই জেলগেট থেকে পুনরায় গ্রেফতার যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এর ফলে আদালতের আদেশ-নির্দেশ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। একজন বিশিষ্ট নাগরিক জানান, আদালতের নির্দেশে যারা মুক্তি পায় তাদের আবার নতুন করে কোনো মামলায় গ্রেফতার দেখানো বা পুনরায় গ্রেফতার করা আদালতের প্রতি অসম্মান দেখানো। এটা আইনের শাসনের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ- যা মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন করে। অপর একজন শিক্ষাবিদ বলেন, ঢালাওভাবে প্রতিপক্ষের রাজনীতিকদের এই প্রক্রিয়ায় হয়রানি গণতন্ত্রকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক চর্চাই কেবল দেশকে স্থিতিশীল করতে পারে।

রাজনৈতিক কার্যালয় বন্ধ
দেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনী পরিস্থিতি তৈরির জন্য মুক্ত রাজনৈতিক কার্যক্রমের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কার্যালয় কোন কারণ ছাড়াই বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরীর কার্যালয়। বন্ধ রয়েছে বিভিন্ন মহানগরসহ সারা দেশের কার্যালয়গুলো। জামায়াতে ইসলামীর কোনো অফিসেই কার্যক্রম চালাতে পারছে না দলের নেতা-কর্মীরা। একটি বৈধ রাজনৈতিক দলকে প্রকাশ্য সভা সমাবেশও করতে দিচ্ছে না আইনশৃংখলা বাহিনী। নিজেদের বাড়িতেও থাকতে পারছেন না তারা। একইভাবে বন্ধ রয়েছে ইসলামী ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশের কার্যালয়গুলো। একজন বুদ্ধিজীবী জানান, বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভূমিকা পালন করেছে জামায়াতে ইসলামী। অংশ নিয়েছে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিটি নির্বাচনে। আন্দোলন সংগ্রামের কারণে জামায়াতে ইসলামীর বহু নেতাকর্মী প্রাণ দিয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে অগণিত নেতা-কর্মী। ২০০৯ সালে নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরপর বিরোধীদলের সভা সমাবেশে বাধা দেয়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে জামায়াতে ইসলামীর সভা সমাবেশ অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। ধীরে ধীরে ঘরোয়া বৈঠক বন্ধ করে দেয়া হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা এসব কার্যালয়েও পুলিশ মাঝে-মধ্যে হানা দিয়ে নানাপ্রকার ‘কাহিনী’ সাজায় বলে জামায়াতের অভিযোগ। কোন রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ না করেও তাদের সঙ্গে সেরকম আচরণই করা হচ্ছে সরকারী মহল থেকে। তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদান করা নিয়মিত ও সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সর্বসাম্প্রতিক সময়েও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে সেই একই কায়দা ও কৌশল প্রয়োগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। গোপন বৈঠক, নাশকতার পরিকল্পনা, বিনা অনুমতিতে মিছিল-সমাবেশ, বিস্ফোরক দ্রব্য-জিহাদি বই থাকা প্রভৃতির অভিযোগ তুলে যেকোন শান্তিপূর্ণ ও ঘরোয়া কার্যক্রমে আইন-শৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে কর্মসূচি ভ-ুল করে দেয়া হয়। এমনকি ঘরোয়া সভা ও মানববন্ধনের মতো নীরিহ কর্মসূচিতেও বাধা দেয়া হয়, ব্যানার কেড়ে নেয়া হয়, ঘটনাস্থল থেকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। সরকারের সাধারণ নির্দেশনা ও স্থানীয় দলীয় নেতাদের ইঙ্গিতে সাধারণ কর্মসূচিতে বাধা প্রদানের ঘটনাগুলো ঘটে বলে প্রকাশ। এভাবে বিরোধীদলীয় রাজনীতিকে একপ্রকার চিপাগলি থেকে কানাগলিতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাষ্যকারদের অভিমত, এর মূল লক্ষ্য আগামী নির্বাচনে বিরোধীদের কোণঠাঁসা করে রেখে সরকার সমর্থক জোটের নির্বিঘেœ নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া।

http://www.dailysangram.com/post/316161