২১ জানুয়ারি ২০১৮, রবিবার, ৫:০৩

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বেড়েছে চোরাচালান সোনা অস্ত্র ও মাদক পাচার

তোফাজ্জল হোসেন কামাল : বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে চোরাচালান বেড়েছে। তার সাথে বেড়েছে সোনা, অস্ত্র, মাদক আর নারী পাচার। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি-এর সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানেই এসব তথ্য উঠে এসেছে। সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বিজিবির পরিসংখ্যানে দাবি করা হয়েছে , বাহিনীটির তৎপরতার কারণেই সীমান্তসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হওয়ায় একের পর এক চোরাচালানের পণ্য আটক বা জব্ধ করা সম্ভব হচ্ছে। বিজিবি’র অভিযানে ২০১৭ সালে ১২১৭ কোটি ৫৫ লক্ষাধিক টাকার চোরাচালান ও মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়েছে। এর আগের বছর (২০১৬ সালে) বিজিবি’র অভিযানে ১১৬১ কোটি ৬৭ লক্ষ ১৭ হাজার মূল্যের বিভিন্ন প্রকারের চোরাচালান ও মাদক দ্রব্য আটক করা হয়েছিল। যা বিদায়ী বছরের তুলনায় ৫৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা কম। ২০১৬ সালের চেয়ে বিদায়ী বছরে চোরাচালান পণ্যের আটক বা জব্ধ হওয়ার ঘটনাকে সীমান্তে চোরাচালান বেড়ে যাওয়া বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দেশের ৪ হাজার ৭০০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকার ফাঁকফোকর গলেই পাশের দেশ থেকে এ দেশে নানা পদের চোরাচালান পণ্য ঢুকছে। এটি এ দেশের অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

এদিকে সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান পণ্যের আধিক্যকে নেতিবাচক হিসেবে দেখছে পর্যবেক্ষক মহল। তাদের মতে, বিডিআর বিদ্রোহের মাধ্যমে সীমান্তরক্ষী বাহিনীটির কোমর ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। যাদের উদ্দেশ্য ছিল এ অবস্থা সৃষ্টির পেছনে তারা আজ লাভবান। কারণ বিডিআর থেকে বিজিবির রূপান্তরই হচ্ছে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করার প্রাণান্তকর চেষ্টা। এ চেষ্টার ফসল হিসেবে বিগত দিনে নানা কারনে বিজিবির অবস্থান ছিল রাজপথে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হওয়া। তখনও বিজিবির কর্মকান্ড নিয়ে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিসহ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল।

চোরাচালান বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে চরম সমন্বয়হীনতার দীর্ঘদিনের অভিযোগ সংসদ সদস্যদের। তাদের এ অভিযোগের ভিত্তি মজবুত করেছে, চোরাচালান পণ্যের আটক তালিকার বহর দেখে। গত বছরের শেষ দিকে ডিসেম্বরের ২৪ তারিখে রোববার দুপুরে রাজধানীর পিলখানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদর দফতরে সংসদ সদস্য ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানদের ‘সীমান্ত সম্পর্কিত সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় ৩৩ জন সংসদ সদস্য সীমান্তে চোরাচালান বেড়েছে বলে অভিযোগ তোলেন। এর কারন হিসেবে তারা আইনশৃংখলাবাহিনীর সমন্বয়হীনতাকেই উল্লেখ করেন।

এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে মাদক ও চোরাচালান বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের কথা জানিয়ে বলেন, দেশে কোনো মাদক তৈরি হয় না। সব মাদকই সীমান্ত পথ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। দেশে কোনো মাদক যেন প্রবেশ না করে সেজন্য সীমান্ত এলাকা আরও সুরক্ষিত করা হবে। সংসদ সদস্যদের অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি উপস্থিত গনমাধ্যমকর্মীদের বলেন, কথাটি ঠিক নয়। বিজিবি-কোস্টগার্ড-পুলিশ-র্যা বের মধ্যে আরও সমন্বয়ের কথা বলা হয়েছে। সমন্বয় আমাদের আছে, যেখানে নেই সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিজিবির সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, সীমান্তে প্রতিদিনই চোরাচালানের পন্য ধরা পড়ছে। সর্বশেষ ২০ জানুয়ারি শুক্রবার মধ্যরাতে ফেনীর ছাগলনাইয়ায় বিজিবি অভিযান পরিচালনা করে বিপুল পরিমাণে ভারতীয় শাড়ী ও থ্রি পিস আটক করেছে। আটককৃত শাড়ি ও থ্রি পিসের মূল্য আনুমানিক ৪০ লাখ টাকা। মধুগ্রাম বিওপির একটি বিশেষ টহল দল ছাগলনাইয়া উপজেলার মির্জা বাজারের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৯শ ৮৬ পিস ভারতীয় শাড়ী ও ৩শ ৬৫ পিস থ্রি পিস আটক করেন।
এর আগে গত বছরের নবেম্বরে এক মাসেই দেশের সীমান্ত এলাকাসহ অন্যান্য স্থানে অভিযান চালিয়ে ৬২ কোটি ৪৪ লাখ ৭৪ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন প্রকারের চোরাচালান ও মাদক দ্রব্য আটক করে। আটককৃত মাদকের মধ্যে ছিল তিন লাখ ৬৩ হাজার ৭৮৪ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, আট হাজার ৪৫৭ বোতল বিদেশী মদ, ২৮৯ লিটার বাংলা মদ, চার হাজার ২০১ ক্যান বিয়ার, ২০ হাজার ৩৬১ বোতল ফেনসিডিল, এক হাজার ৪৫০ কেজি গাঁজা, ৬৮৮ গ্রাম হেরোইন, সাত হাজার ৬৮০টি এ্যানেগ্রা, সেনেগ্রা ট্যাবলেট, নেশাজাতীয় ইনজেকশন এক হাজার ৬৫৫ এবং ছয় লাখ ৪২ হাজার ১৭৮টি অন্যান্য ট্যাবলেট। অন্যান্য চোরাচালান দ্রব্যের মধ্যে ১৩ হাজার পাঁচটি শাড়ি, দুই হাজার ৩৬৬টি থ্রিপিস, শার্ট পিস, আট হাজার ৬৫৮ মিটার থান কাপড়, দুই হাজার ৭৮৯টি তৈরি পোশাক, ২০ হাজার ১৬৫ সিএফটি কাঠ ও তিন কেজি ৮৩৪ গ্রাম স্বর্ণ। উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে ছিল ১৮ পিস্তল, দুইটি বন্দুক, ৬০টি গুলি এবং ১২টি ম্যাগাজিন।
ওই সময়ে বিজিবি সুত্রে জানানো হয়, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে নবেম্বর পর্যন্ত এক হাজার ১৬২ কোটি ৫৮ লাখ ৬৬ হাজার ১৯৯ টাকা মূল্যের বিভিন্ন প্রকারের চোরাচালান ও মাদকদ্রব্য আটক করে। ওই বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত বিজিবি ৬৯৮ কোটি ৮৬ লাখ ৬৪ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের চোরাচালান ও মাদকদ্রব্য আটক করে।
বিদায়ী বছরের পরিসংখ্যান
বিজিবি ২০১৭ সালে (জানুয়ারি হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত) দেশের সীমান্ত এলাকাসহ অন্যান্য স্থানে অভিযান চালিয়ে সর্বমোট ১২১৭ কোটি ৫৫ লক্ষ ৭৪ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন প্রকারের চোরাচালান ও মাদক দ্রব্য আটক করে। আটককৃত মাদকের মধ্যে ছিল ১,৫৫,৭১,০১৩ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ১,৪০,৬০৮ বোতল বিদেশী মদ, ১৪,১৪৬ লিটার বাংলা মদ, ৪৯,৬৫০ ক্যান বিয়ার, ৩,২৮,৬৮৯ বোতল ফেনসিডিল, ১৬,৩৫৭ কেজি গাঁজা, ৪৪ কেজি ৩২৪ গ্রাম হেরোইন, নেশাজাতীয় ইনজেকশন ২৮,২৮০ এবং ১,৬৭,৪৫,২৫১টি অন্যান্য ট্যাবলেট। আটককৃত অন্যান্য চোরাচালান দ্রব্যের মধ্যে ২,৫৩,৯০৮টি শাড়ী, ৫০,৫৯০টি থ্রিপিস/শার্টপিস, ৪৭,০১৩ মিটার থান কাপড়, ১৮,৪০১টি তৈরী পোশাক, ২,৪২,৫৬০ সিএফটি কাঠ ও ৪২ কেজি ১০৬ গ্রাম স্বর্ণ। একই সময়কালে উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে ছিল ৬৫টি পিস্তল, ৪৮ টি বন্দুক, ৩০০টি গুলি, ৬১টি ম্যাগাজিন এবং ১টি রিভলবার। বিজিবি’র অভিযানে মাদক পাচারসহ অন্যান্য চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ২,৬৮৯ জন এবং অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের দায়ে ১,১১৪ জন বাংলাদেশী নাগরিককে আটক করে থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।
পরিসংখ্যান পর্যালোচনা
বিজিবি সূত্রে সীমান্তে চোরাচালান পণ্য আটক বা জব্ধের ঘটনার যে চিত্র জানানো হয়েছে তাতে বোঝা যায় সীমান্তে অপরাধের মাত্রা কতটুকু বেড়েছে। এই পরিসংখ্যান বিজিবির হলেও বাস্তব ঘটনা কয়েকগুণ বেশি বলে সীমান্ত এলাকাগুলোর একাধিক সূত্রের দাবি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিজিবির কাজ হচ্ছে দেশের সীমান্ত সুরক্ষা, চোরাচালান প্রতিরোধ, নারী ও শিশু এবং মাদক পাচার আমদানি প্রতিরোধে ‘অতন্দ্র প্রহরী’ প্রহরীর দায়িত্ব পালন করা। পাশাপাশি প্রয়োজনে অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করা। কিন্তু বিজিবির নিষ্ক্রিয়তায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এখন বিশ্বের সবচেয়ে রক্তঝরা ভয়ঙ্কর সীমান্তে পরিণত । প্রতিনিয়ত ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বিএসএফ নিরীহ নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের হত্যা করছে অথবা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বিএসএফের পাশাপাশি নাসাকা বাহিনীও বাংলাদেশ ভূ-খন্ডের ভেতরে প্রবেশ করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সাধারণ নাগরিকদের। অথচ তাদের মোকাবিলায় নিষ্ক্রিয় বিজিবি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিজিবি (সাবেক বিডিআর) বীরত্ব ও ঐতিহ্যের গৌরবমন্ডিত এক সুশৃঙ্খল আধা-সামরিক বাহিনী। প্রায় ২২০ বছরের ঐতিহ্য তাদের। স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রসেনানী ছিল এই বাহিনী। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে ৮১৭ জওয়ান শহীদ হওয়ার মাধ্যমে এই বাহিনী অপরিসীম বীরত্ব দেখিয়েছেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব বীরশ্রেষ্ঠ ৯ জনের মধ্যে দু’জনই এই বাহিনীর। শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ এবং শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিল। এছাড়া ৮ জন ‘বীর উত্তম’, ৩২ জন ‘বীর বিক্রম’ ও ৭৮ জন ‘বীর প্রতীক’ খেতাব পেয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে ঐতিহ্য আর গৌরবের সুষমামন্ডিত এই বাহিনীর কাজ কি?

http://www.dailysangram.com/post/316050