২১ জানুয়ারি ২০১৮, রবিবার, ৪:৫৮

মেয়র আইভির প্রহার : ডাকসু ইলেকশনের নির্দেশ এবং সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত

এই মাসে তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। তিনটির মধ্যে দুটি ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটি ঘটনা আদালতের রায় সম্পর্কিত। বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষিত মানুষ এই দুটি ঘটনাকে বলছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আর তৃতীয় ঘটনাটি জাতির ললাটে কলঙ্ক তিলক এঁটে দিয়েছে। প্রথম দুটি ঘটনা হলো আদালত সম্পর্কিত। এখানে দুটো মামলার মধ্যে একটি মামলার রায়ে মাননীয় আদালত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের চেয়ারম্যানের বাই ইলেকশন এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের সম্প্রসারিত এলাকার ১৮ জন কাউন্সিলরের নির্বাচন স্থগিত করেছেন। এই রায়ের পরদিন আরেকটি রিট পিটিশনের নিষ্পত্তি হয়। ঐ রায়ে বলা হয় যে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৮টি সম্প্রসারিত ওয়ার্ডের যে নির্বাচন ২৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল সেটিও তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হলো। সরকারের প্রতি জারিকৃত এক রুলে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ জানতে চেয়েছেন যে, মেয়রের উপনির্বাচন এবং ১৮ জন কাউন্সিলরের নির্বাচন কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না? সেটি সরকার উত্তর না দেয়া পর্যন্ত আগামী ৩ মাসের জন্য নির্বাচনের সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।

আরেকটি রায়ও যুগান্তকারী। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের বা ডাকসুর ইলেকশন সম্পর্কিত। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আজ থেকে ২৭ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন বাতিল হয়। তারপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং তাদের অঙ্গ সংগঠনসমূহ নিয়মিত সংসদ নির্বাচনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দিলেও সেই নির্দেশ মানা হয়নি। এমনকি প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদও একটি বক্তৃতায় ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু কোনটাতেই কোন কাজ হয়নি। ২৭ বছর ধরে ডাকসু ইলেকশনের গিট্টু লেগে আছে। সেই গিট্টু একটি দুর্বোধ্য কারণে ২৭ বছর ধরে খোলেনি। এখন উচ্চ আদালতের রায় এসেছে। দেখা যাক বর্তমান সরকার অথবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকে কতখানি মূল্য দেয়।
তৃতীয় ঘটনা হলো নারায়ণগঞ্জের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত মেয়র সেলিনা হায়াত আইভিকে অপর একজন জনপ্রতিনিধি শামীম ওসমানের ক্যাডাররা রাস্তায় পিটিয়ে শুইয়ে ফেলেছিল। সেই সাথে আইভির একশত অনুসারীকেও বেদম পিটিয়েছে। দুইজন প্রতিনিধিই শাসক দল আওয়ামী লীগের। বিতর্কিত পার্লামেন্টের সদস্য শামীম ওসমান এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী। শনিবার ২০ জানুয়ারি যখন এই কলাম লিখছি তখন পর্যন্ত আইভী এবং তার সমর্থক শতাধিক ব্যক্তিকে প্রহারের কারণে কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়নি। এমনকি শামীম ওসমানের ক্যাডার বলে পরিচিত নিয়াজুল, যে শত শত মানুষের সামনে পিস্তল বের করেছিল, তাকেও গ্রেফতার করা হয়নি। অন্যদিকে এই প্রচন্ড সহিংসতার পর মেয়র আইভী অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। গুরুতর অসুস্থ আইভীকে নারায়ণগঞ্জের চিকিৎসকদের পরামর্শে ঢাকায় আনা হয় এবং ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অসুস্থ আইভী এখন ল্যাব এইডের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে আছেন। গত শনিবার তার অবস্থাকে হাসপাতাল থেকে স্থিতিশীল বলা হয়েছে।
এই হলো সংক্ষেপে তিনটি ঘটনা। প্রথম ঘটনাটি অর্থাৎ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থগিত ঘোষণাকে ঢাকা মহানগীর প্রায় সর্ব শ্রেণীর মানুষ সরকার ও সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলা অথবা ইচ্চাকৃত গাফিলতি বলে অভিহিত করছেন। তাদের মতে যে সব কারণে দুটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন স্থগিত হয়ে গেল সেই কারণগুলো এতো স্পষ্ট যে একজন সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন মানুষও নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেন যে, এই নির্বাচন হবে না। এমনকি আমার আত্মীয় স্বজনরাও আমার বাসায় বেড়াতে এলে অথবা আমি তাদের বাসায় বেড়াতে গেলে তারা সকলেই বলতেন যে, কেন সরকার খামাখা এই ইলেকশনের খেলা খেলছে। কারণ এই ইলেকশন তো কোন অবস্থাতেই হতে পারে না। এটি বাতিল হবেই। মাঝখানে ইলেকশন কমিশন এবং সরকার কেন যে ইলেকশনের এমন একটি নাটক মঞ্চস্থ করছে সেটি কারো বোধগম্য হচ্ছে না।

॥দুই॥
প্রথম কথা হলো মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর কারণে সেই পদটি শূন্য হয়। সেক্ষেত্রে আইনী বাধ্যবাধকতার কারণে তিন মাসের মধ্যেই ইলেকশন দিতেই হবে এবং মেয়রের পদটি যেদিন অফিসিয়ালি শূন্য ঘোষিত হবে সেদিন থেকে ৯০ দিনের ভেতর ঐ পদটি নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ হতে হবে। সুতরাং মেয়র নির্বাচনের যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় সেই ব্যাপারটিতে কোন ভুল ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কাউন্সিলরদের নির্বাচন নিয়ে। মরহুম মেয়র আনিসুল হক আড়াই বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। তার মেয়াদের অবশিষ্ট ছিল আরো আড়াই বছর। সুতরাং যদি মেয়রের নির্বাচন হতো তাহলে জেনেশুনে সরকারি বা বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা আড়াই বছর মেয়াদে দায়িত্ব পালনের জন্য মেয়র ইলেকশন করতেন। কিন্তু নতুন কাউন্সিলররা, অর্থাৎ ঐ সম্প্রসারিত ১৮টি ওয়ার্ডের ১৮ জন কাউন্সিলর আড়াই বছরের জন্য নির্বাচন করবেন কেন? তারা নির্বাচন করবেন ৫ বছরের জন্য। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে যখন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেরই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তখন মেয়রের সাথে সাথে কাউন্সিলরদের ইলেকশনও অনুষ্ঠিত হয় এবং তারা সকলেই ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। তাহলে ২৬ই ফেব্রুয়ারি যে ১৮ জনের নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল তারা কেন ৫ বছরের পরিবর্তে আড়াই বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন? এই পয়েন্টের কোন জবাব কারো কাছেই নাই। সুতরাং এই পয়েন্টে যে প্রস্তাবিত ইলেকশন টিকবে না সেটিতো জানাই ছিল। তাহলে জেনেশুনে তেমন একটি নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হলো কেন?
এক্ষেত্রেই বিরোধীদলের মন্তব্যসমূহ প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। বিরোধী দল অভিযোগ করছে যে, সরকার ইলেকশনের কথা যখন বলে তখনই তারা জনমত আন্দাজ করতে পেরেছিল। পরাজয় যে অবধারিত সেটি তারা জানতো। তাই মুখ রক্ষার কারণে এই ইলেকশনটি দেয়া হয়েছিল। এখন তারা বলতে পারবে যে, আমরা আর কি করবো? আমরা তো ইলেকশন দিতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু কোর্ট-কাচারীর রায়ে ইলেকশন বন্ধ হলে আমাদের কি করার আছে? তবে এই ধরনের যতই ঠুনকো যুক্তি দেওয়া হোক না কেন, জনগণ যা বোঝার সেটা তারা ঠিকই বুঝে গেছে। সরকার এবং ইলেকশন কমিশন যতই ছ্যাপ-ল্যাপ দিক না কেন, কঠোর সত্যকে তারা ঢাকবে কি ভাবে?
এই ধরনের আরো অনেকগুলো প্রশ্ন আছে। সবগুলো পয়েন্ট আলোচনা করতে গেলে একটা কলামে হবে না। অন্তত তিনটি কলামের প্রয়োজন হবে।

॥তিন॥
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ছাত্রের প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচিত সংগঠনের নাম হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। সংক্ষেপে ডাকসু। বছরের পর বছর ধরে সর্বশ্রেণীর মানুষের মাঝে এটি ডাকসু নামেই পরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৩ অনুযায়ী ডাকসু গঠিত। বছরের পর বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে। এই সংগঠনটির সর্বশেষ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালে। তারপর থেকে এই পর্যন্ত আর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। চরম পরিতাপের বিষয় এই যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিগত ৪৬ বছরে ডাকসুর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ৪৬টি ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু এই ৪৬ বছরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র ৬ (ছয়) বার। ১৯৯০ সালে ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন ভিপি ছিলেন, বিএনপি পন্থি ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের আমান উল্লাহ আমান এবং জিএস ছিলেন খায়রুল কবির খোকন। তারপর থেকে এই পর্যন্ত আর ডাকসু ইলেকশন হয়নি।

ডাকসু ইলেকশন নিয়ে কম লেখালেখি হয়নি। বিগত ২৭ বছরে যদি ২৭টি ডাকসু ইলেকশন হতো তাহলে অন্তত শুধু ডাকসুর মাধ্যমেই ৫৪ জন নেতা পাওয়া যেত। এছাড়া বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের ২জন করে প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি পাওয়া যেতো। এসব ছাড়াও রয়েছে হল ইউনিয়ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে এখন দেশে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং অর্ধ-শতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অসংখ্য নেতা বেরিয়ে আসতেন। কয়েক হাজার কলেজে যদি নিয়মিত নির্বাচন হতো তাহলে কয়েক হাজার নেতা বেরিয়ে আসতেন। সংক্ষেপে বলা যায় যে, যদি দেশে অহিংস, শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক, নিয়মিত ছাত্র রাজনীতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক নির্বাচন হতো তাহলে আজ বাংলাদেশ এই সহিংস, চাঁদাবাজি ও গুন্ডামির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতো এবং আইনের প্রতি নিষ্ঠাবান শত শত রাজনৈতিক নেতার উপহার দিতো এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
॥চার॥
সবশেষে নারায়ণগঞ্জে সশস্ত্র হামলা। বিষয়টি এতই সাম্প্রতিক এবং মিডিয়াতে এতো ব্যাপক কাভারেজ পেয়েছে যে, এই বিষয়ে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ঘটনা যা ঘটবার তা ঘটে গেছে। কিন্তু যে প্রশ্ন রেখে গেছে সেটি হলো, একটি সিটি করপোরেশনের দুই দুই বারের নির্বাচিত মেয়র শারীরিকভাবে আক্রান্ত হলেন, গুন্ডাদের হামলায় তিনি রাস্তায় মাটিতে পড়ে গেলেন, তার পরদিন প্রচন্ড টেনশনে তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলো, তারপর তাকে হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হলো- অথচ তারপরেও এই লেখার সময় পর্যন্ত একটি ব্যক্তিকেও গ্রেফতার করা হলো না। তাহলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোথায় গেছে? শামীম ওসমান যা কিছু করছেন সেগুলো রেখে ঢেকে করছেন না। যেখানে নাসিকের মত প্রতিষ্ঠান অফিসিয়াল সিদ্ধান্ত নিয়ে হকারদের উচ্ছেদের অভিযান চালায় সেখানে একই দলের এমপি সেই সিদ্ধান্ত অমান্য করার জন্য প্রকাশ্য নির্দেশ দেন। কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক দেশে কি এই ধরনের কাজ হতে পারে? এটিকেই তো বলা যায় জোর যার মুল্লুক তার। এটিকেই তো বলা হয় মগের মুল্লুক। শামীম ওসমান সাহেব সরকারি দলের এমপি। তিনি মেয়র আইভীর সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য অফিসিয়াল চ্যানেলে মুভ করতে পারতেন। তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী প্রভৃতি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে দেনদরবার করতে পারতেন। সেগুলো না করে তিনি তার বাহিনীকে মাঠে নামার নির্দেশ দেন। সরকার যদি এই ধরনের উচ্ছৃঙ্খলতা কঠোর হাতে দমন না করেন তাহলে দেশে আইনের শাসন কোনদিনও প্রতিষ্ঠিত হবে না।
Email: asifarsalan15@gmail.com

http://www.dailysangram.com/post/315992