২০ জানুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ১০:০৫

গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কায় বিমান

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস আর বিনা পয়সায় বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব পাচ্ছে না। উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ফি দিয়ে তাদের এই দায়িত্ব নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব তাদের হাতছাড়া হওয়ারও শঙ্কা রয়েছে।
কেননা রাজধানীর শাহজালালসহ দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ফি নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে।
একটি উড়োজাহাজ বিমানবন্দরে অবতরণের পর সেই উড়োজাহাজ এবং তার যাত্রীদের যেসব সেবা দেওয়া হয় সেগুলোই গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং। এর আওতায় মালপত্র উড়োজাহাজ থেকে নামিয়ে যাত্রীদের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্বও রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে নানা অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির অভিযোগের মধ্যে বিমান এককভাবে গ্রাউন্ড কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

শাহজালাল বিমানবন্দর ব্যবহারকারী যাত্রীদের অভিযোগ, এই মালপত্র পেতে তাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। মালপত্র প্রায়ই খোয়া যাওয়ার অভিযোগও রয়েছে। গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংসহ বিভিন্ন কারণে এশিয়ার বিভিন্ন বিমানবন্দরের মধ্যে খারাপের দিক থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবস্থান শীর্ষ দশে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবুল হাসনাত মো. জিয়াউল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, অর্থ এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় যৌথভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং ফি নির্ধারণ করেছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ শিগগিরই এসংক্রান্ত অফিস আদেশ জারি করবে।
সব দেশেই বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা দেওয়ার দায়িত্ব বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের। বাংলাদেশেও এই সেবা দেওয়ার দায়িত্ব বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের থাকলেও এই সেবা দিচ্ছে বিমান। সংস্থাটি বাণিজ্যিকভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা পরিচালনা করলেও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে কোনো ফি দেয় না। অথচ এই কাজ করে তারা বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আয় করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা বিমান থেকে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু কখনোই তা বাস্তবায়ন হয়নি। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলেই বিমানবন্দরে অচলাবস্থার সৃষ্টি করা হয়। এই অবস্থায় গত ১ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা দেওয়ার জন্য ফি নির্ধারণ করেছে।

গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা দেওয়ার জন্য কম্পানি গঠন করতে হবে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে পরিচালিত উড়োজাহাজকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা দেওয়ার জন্য এই কম্পানির ২০০ কোটি টাকার মূলধন থাকতে হবে। শুধু অভ্যন্তরীণ রুটে পরিচালিত উড়োজাহাজকে এই সেবা দিতে হলে ৫০ কোটি টাকার মূলধন থাকতে হবে।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল সংস্থা (আইকাও) অনুমোদিত ‘বি’ ক্যাটাগরির বিমানবন্দর। এখানে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা দেওয়ার লাইসেন্স ফি ধরা হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। প্রতিবছর লাইসেন্স নবায়ন ফি আড়াই কোটি টাকা। কম্পানিকে মোট রাজস্ব আয়ের ওপর পাঁচ শতাংশ হারে রয়ালটি চার্জ দিতে হবে। শাহজালাল বিমানবন্দরকে আইকাও ‘এ’ ক্যাটাগরিতে উন্নীত করলে লাইসেন্স ফি এবং নবায়ন ফি দ্বিগুণ হবে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, বিমান যদি বিমানবন্দরগুলোতে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং পরিচালনা করতে চায় তাহলে বিমানকে উন্মুক্ত দরপত্রে অংশ নিতে হবে। এই দরপত্রে বিশ্বের নামি-দামি বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং পরিচালনাকারী কম্পানিগুলোও অংশ নেবে। বিমান তুলনামূলক বেশি দাম দিলেই কেবল বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা দিতে পারবে।

বিমানের একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, বিমান গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা দেওয়ার সংস্থা নয়। দেশের প্রয়োজনে স্বাধীনতার পরপরই বিমান এ কাজ শুরু করেছিল। কাজেই বিমানকে এ দায়িত্বে রাখতে হবে। তাছাড়া এ দায়িত্ব হাতছাড়া হয়ে গেলে বিমানের পক্ষে দৈনন্দিন কর্মসূচি পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। কারণ এই গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা দিয়ে বিমান বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আয় করে। এত আয় বিমানের অন্য কোনো খাতেই সম্ভব হয় না। তা ছাড়া গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবার আয় নগদে আদায় করা হয়। যখন একটি এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ বিমানবন্দরে অবতরণ করে তখন তাদের নগদ টাকা দিয়ে এ সেবা নিতে হয়।
একজন ঋণখেলাপির কম্পানিকে এ দায়িত্ব দেওয়ার চক্রান্ত চলছে অভিযোগ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, বিমানকে সরিয়ে এ দায়িত্ব কোনো ঋণখেলাপি কম্পানিকে দিলে তা মানা হবে না।
এদিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে অর্থনৈতিক ও ব্যবস্থাপনাগত বিশৃঙ্খলা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বকেয়া পরিশোধ না করার কারণে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টানাপড়েন চলছে। আর অ্যাসেনশিয়াল সার্ভিস (অত্যাবশকীয় সেবা) ঘোষণার পরও বিমানে মিছিল সমাবেশ করায় সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এই অবস্থায় সরকার বিমানের হাত থেকে শাহজালালসহ বিভিন্ন বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ফি নির্ধারণ করেছে। এই গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা ধরে রাখার জন্য বিমানে আরো বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আসছে আকাশবীণা ও হংস বলাকা, যাবে গুয়াংজু ও কলম্বো : বিমান বহরে দুটি অত্যাধুনিক উড়োজাহাজ যুক্ত হচ্ছে। আগামী মার্চে এই দুটি উড়োজাহাজ বিমান বহরে যোগ দেবে। উড়োজাহাজ দুটির নাম ঠিক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ২৫ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকের পর তিনি উড়োজাহাজ দুটির নাম চূড়ান্ত করেন। এই উড়োজাহাজ দুটির নাম হচ্ছে আকাশবীণা ও হংস বলাকা। ২০১৯ সালে আরো দুটি উড়োজাহাজ বিমান বহরে যোগ দেবে। সেগুলোরও নাম চূড়ান্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ওই দুটি উড়োজাহাজের নাম হচ্ছে রাজহংস ও গাংচিল।
এর আগে ২০১২ সাল থেকে বিমান বহরে দফায় দফায় যোগ দেওয়া নতুন উড়োজাহাজগুলোর নামও প্রধানমন্ত্রী রেখেছেন। এসব উড়োজাহাজগুলো হচ্ছে পাল্কি, অরুণআলো, আকাশপ্রদীপ, রাঙা-প্রভাত, মেঘদূত ও ময়ূরপঙ্খী।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আকাশবীণা ও হংস বলাকা দিয়ে চীনের গুয়াংজু এবং শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে। ইতিমধ্যে দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তিও শেষ হয়েছে। একসময় বিমান কলম্বোতে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। এখনো শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস সপ্তাহে তিন দিন ফ্লাইট চালায়। উড়োজাহাজের অভাবে শ্রীলঙ্কায় ফ্লাইট বন্ধ করে দেয় বিমান। এ ছাড়া চীনের গুয়াংজুতেও যাবে এসব উড়োজাহাজ। বিমানে যুক্ত হতে যাওয়া উড়োজাহাজ দুটিতে অত্যাধুনিক সুবিধা থাকবে। যাত্রীরা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৪৩ হাজার ফুট উচ্চতায় ভ্রমণের সময়ও ওয়াইফাই সুবিধা পাবে। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলতে পারবে। একই সঙ্গে উড়োজাহাজ দুটিতে থাকছে বিশ্বমানের ইনফ্লাইট এন্টারটেইনমেন্ট। যাত্রীরা দেখতে পাবে ক্লাসিক থেকে রকস্টার মুভি। শুনতে পারবে বিভিন্ন ধরনের গান। ভিডিও গেমসসহ ৯টি টিভি চ্যানেলের রিয়াল টাইম লাইভ স্ট্রিমিং ও অনলাইন কেনাকাটার সুবিধা থাকছে। ২০ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয়ী এসব উড়োজাহাজে থাকছে ২৪টি বিজনেস ও ২৪৭টি ইকোনমি সিট।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2018/01/20/591758