২০ জানুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ৯:৫৮

ঝুঁকিতে সাড়ে ১০ কোটি নাগরিকের তথ্যভাণ্ডার

বিভিন্ন কারিগরি ত্রুটির কারণে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে দেশের ১০ কোটি ৪০ লাখ নাগরিকের ভোটার তথ্যভাণ্ডার। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আওতাধীন এ তথ্যভাণ্ডারের (ডাটাবেজ) হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার আপডেট না করা এবং প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার না থাকায় এমন ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে। ইসির ওরাকল এক্সাডাটা সিস্টেমের (oracle exadata system) স্টোরেজ ক্ষমতা শেষ হওয়ায় সেখানে নতুন কোনো ডাটা সংযোজন করা যাচ্ছে না। এমনকি পুরাতন ডাটার আপডেট করাও সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া আটটি ডাটাবেজ সার্ভারের তিনটি ক্রিটিক্যাল ওয়ার্নিং (সতর্কবার্তা) দিচ্ছে। এএফআইএস-সহ (অটোমেটেড ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম) সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সফটওয়্যারও আপডেট না করায় নাজুক অবস্থায় রয়েছে।

স্টোরেজ সার্ভারের ত্রুটির কারণে গত ১ জানুয়ারি সব ভোটারের তথ্য নষ্ট হয়ে যায়। পরে ব্যাকআপ ডাটাবেজ থেকে তা পুনরুদ্ধার করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে নাগরিকদের ভোটার তথ্য সম্বলিত ডাটা ফাইল ‘হারানোর ঝুঁকি’র মধ্যে পড়েছে। এসব গুরুতর পরিস্থিতির কথা ইসিকে জানিয়েছে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ। এখনই পদক্ষেপ নেয়া না হলে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ নিয়ে সমস্যা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এসব সমস্যা ঠেকাতে আপাতত ইসির কাছে ৩৭২ কোটি জরুরি বাজেট চাওয়া হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে বৃহস্পতিবার কমিশন সভায়ও আলোচনা হয়েছে। ইসি ও জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে সার্ভার নিয়ে কারিগরি ঝুঁকি থাকলেও নিরাপত্তাগত ঝুঁকি নেই বলে জানিয়েছেন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের একজন আইটি বিশেষজ্ঞ।

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুল ইসলাম এসব বিষয়ে শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের কারিগরি দিকগুলোর সমস্যা ও সার্ভার সুরক্ষার বিষয় নিয়ে কমিশনে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, সার্ভার শক্তিশালী করা ও এর সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। কমিশন ডাটাবেজ আপডেট করার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছে।
এ বিষয়ে ইসির অন্তত পাঁচজন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, প্রধান সার্ভারের সমস্যার কারণে তা প্রায়ই ডাউন থাকে। প্রধান সার্ভার ডাউন থাকলে ওই সময় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সেবা দিতে পারেন না ইসির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা। এতে নাগরিকরা ভোগান্তির শিকার হন। তারা বলেন, সার্ভারের সমস্যার বড় প্রভাব পড়েছে খসড়া ভোটার হালনাগাদ তালিকায়। গত ২ জানুয়ারি সারা দেশে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে নানা অসঙ্গতি ও ত্রুটি রয়েছে। ২০১৫ সালে ১৮ বছরের কম বয়সীদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। এর মধ্যে যাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে তাদের নাম খসড়া তালিকা প্রকাশের কথা। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের নাম আসেনি। এমনকি ২০১৭ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদে সংগ্রহ করা অনেকের তথ্যও খসড়া তালিকায় ওঠেনি। একজন কর্মকর্তা উদাহরণ দিয়ে বলেন, একটি জেলার ২০১৫ সালের ও ২০১৭ সালের তথ্য নেয়া হয়েছে এমন ১০ হাজার ভোটারের নাম খসড়া তালিকায় থাকার কথা, কিন্তু প্রকাশিত তালিকায় নাম রয়েছে ছয় হাজারের মতো।

আরেকজন সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বলেন, খসড়া তালিকার এমন ত্রুটির কথা লিখিত আকারে ইসিকে জানিয়েছেন। ত্রুটি নিয়ে উপজেলা ও থানা পর্যায়ে প্রচুর দাবি-আপত্তি জমা পড়ছে। বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ে দাবি-আপত্তি নিয়ে শুনানি চলছে। বিষয়টি নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছি।
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের একজন আইটি বিশেষজ্ঞ বলেন, নির্বাচন কমিশনের আওতাধীন জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগ জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সেবা প্রদান এবং ডাটাবেজ রক্ষণাবেক্ষই করছে। এ অনুবিভাগের আওতায় দেশে স্মার্টকার্ড উৎপাদন ও বিতরণ চলছে। বর্তমানে সিটি কর্পোরেশন এলাকা ছাড়াও ৩৭টি জেলায় স্মার্টকার্ড দিচ্ছে। ২০১২ সালের ভোটার তালিকা হালনাগাদে যুক্ত হওয়া প্রায় এক কোটি নাগরিককে এক ফেব্রুয়ারি থেকে লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্র দেবে অনুবিভাগ। কিন্তু সার্ভারের এসব ত্রুটির কারণে এবং এএফআইএস সার্ভার বারবার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভোটারের বায়োমেট্রিক ম্যাচিং রেজাল্ট সঠিকভাবে যথাসময়ে করা যায়নি। ফলে খসড়া ভোটার তালিকায় ভুল-ভ্রান্তি রয়ে গেছে। তিনি বলেন, সার্ভার নিয়ে কারিগরি ঝুঁকি থাকলেও নিরাপত্তাগত ঝুঁকি নেই। আমাদের ডাটা সার্ভার প্রতিদিনই হ্যাকিংয়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার থাকায় হ্যাকাররা সুবিধা করতে পারছে না।

এদিকে বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের ১৭তম সভায় ভোটার তালিকা ও এনআইডির ডাটাবেজের দুরবস্থা তুলে ধরা হয়। সভার কার্যপত্রে বিভিন্ন ধরনের কারিগরি ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে বলা হয়, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে (বিসিসি) অবস্থিত ইসির ওরাকল এক্সাডাটা সিস্টেমের স্টোরেজের জায়গা সম্পূর্ণ ব্যবহৃত হওয়ায় বর্তমানে কোনো নতুন ডাটা সংযোজন করা যাচ্ছে না। এমনকি পুরাতন ডাটার কোনো ধরনের আপডেটও করা যাচ্ছে না। ফলে এখন ইসলামিক ফাউন্ডেশনে অবস্থিত ইসির ওরাকল এক্সাডাটা মেশিনেই এনআইডি সিস্টেমের সব কার্যক্রম পরিচালনা ও ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। এই এক্সাডাটা মেশিনের আটটি ডাটাবেইজ সার্ভারের তিনটি ক্রিটিক্যাল ওয়ার্নিং দিচ্ছে। এ ছাড়া ১৪টি স্টোরেজ সার্ভারের ৫৬টি ফ্লাশ ড্রাইভের মধ্যে ৯টি ফ্লাশ ড্রাইভ বিকল হয়ে গেছে। এতে ডাটাবেজের পারফরমেন্স উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এ কারণে বিভিন্ন সেবাদান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

কার্যপত্রে আরও বলা হয়, ১ জানুয়ারি হঠাৎ করেই স্টোরেজ সার্ভার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ডাটাবেজের সব ভোটারের তথ্য সম্বলিত ডাটা ফাইল নষ্ট হয়ে যায়। ১২ ঘণ্টা পর ব্যাকআপ ডাটাবেজ থেকে সব ডাটা পুনরুদ্ধার করে সার্ভার চালু করা হয়।
এতসব সমস্যার কারণে যে কোনো সময় নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সেবা এবং ইসির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ব্যাংক, পাসপোর্টসহ ৮২টি প্রতিষ্ঠানের এনআইডি যাচাই সংক্রান্ত কার্যক্রম বন্ধের আশঙ্কা করছে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ। এ বিষয়ে কার্যপত্রে বলা হয়েছে, ওরাকল এক্সাডাটা মেশিনগুলোর সাপোর্ট সার্ভিস রিনিউ না হওয়ায় ২০১৬ সালের জুন থেকে ডাটাবেজের কোনো সিকিউরিটি প্যাচ আপডেট হয়নি। এক্সাডাটা মেশিনের কোনো স্পেয়ার পার্টস বর্তমানে মজুদ নেই। ফলে এক্সাডাটা সিস্টেমের কোনো হার্ডওয়্যার বিকল হলে দেশব্যাপী এনআইডি সংক্রান্ত সব সার্ভিস বন্ধ হয়ে যাবে। এতে ই-টিআইএন, পে-ফিক্সেশন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তথা ব্যাকিং কার্যক্রম, মোবাইল সিম নিবন্ধন, বৈদেশিক রেমিটেন্স উত্তোলন, অজ্ঞাত লাশ শনাক্ত করা, জঙ্গিসহ বিভিন্ন নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি শনাক্ত করাসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।
সার্ভার ডাউন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে কার্যপত্রে আরও বলা হয়, সর্বশেষ ১০ আঙ্গুলের ছাপ ও আইরিশ ম্যাচিং করে এই ‘এএফআইএস’ দিয়ে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। ডাটা সেন্টারের (ডিসি) সব ‘এএফআইএস’ সার্ভারের সার্ভিসের মেয়াদ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। যে কোনো সময় সার্ভার ডাউন হয়ে যেতে পারে।
আপদ ঠেকাতে দরকার ৩৭২ কোটি টাকা : ডাটাবেজের সংকট মোকাবেলায় জরুরিভিত্তিতে ৩৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ। এর মধ্যে স্টোরেজ বাড়ানো, ওরাকল সাপোর্ট সার্ভিস চুক্তি, এএফআইএস সার্ভিস চুক্তি নবায়ন, অতিরিক্ত প্রায় দুই হাজার লাইসেন্স ক্রয়সহ নানা কাজে এখনই বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ৮৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আর আগামী তিন মাসের মধ্যে পুরাতন ও সব সার্ভার প্রতিস্থাপন এবং এএফআইএসকে এবিআইএসে আপগ্রেড করা ও অন্যান্য কাজে ১৩৫ কোটি চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আগামী ৬ মাসের মধ্যে ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত কার্যক্রম পৃথকীকরণ এবং জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই ও বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ সংক্রান্ত সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার সংক্রান্তসহ বিভিন্ন কাজে ১৫৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা চেয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/8844