২০ জানুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ৯:৫৫

সাত কলেজ ইস্যুতে উত্তাল ঢাবি

একের পর এক আন্দোলনে নাজেহাল প্রশাসন

স¤প্রতি সাত কলেজ ইস্যুতে উত্তাল হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি)। ঢাবি থেকে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে করা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পণ্ড করে দেয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ইঙ্গিতেই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন নস্যাৎ করেছে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। সর্বশেষ আন্দোলনকারীদের সমন্বয়ক মশিউর রহমান সাদিককে ছাত্রলীগের নির্যাতন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক তাকে থানায় সোপর্দ করা এবং অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাদের বিচার না করায় ক্রমান্বয়ে এ আন্দোলন জোরালো হতে থাকে। সাত কলেজ ইস্যুকে কেন্দ্র করে লাগাতার আন্দোলনে নাজেহাল ঢাবি প্রশাসন।

স¤প্রতি দায়িত্ব নেয়ার পরে প্রথমবারের মতো অধিভুক্ত সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষা নেয় ঢাবি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই ভর্তীচ্ছুদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। সাক্ষাৎকার উপলক্ষে কয়েক দিনে বিপুলসংখ্যক (প্রায় ৪০ হাজার) শিক্ষার্থীর সমাগম ঘটে ক্যাম্পাসে। এ দিকে অধিভুক্ত কলেজের এ ভর্তীচ্ছুদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকের শাখা ব্যবহার করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যাহত হয় বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। ক্যাম্পাসে এসে অধিভুক্ত কলেজের এক ছাত্রীর প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়া নিয়ে কথা বললে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হেনস্থা করেন ওই ছাত্রী। ক্যাম্পাসে অধিভুক্ত শিক্ষার্থীর এ ধরনের আচরণের ভিডিও ভাইরাল হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত ফেসবুক গ্রæপ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’-এ। এ ছাড়াও অধিভুক্ত শিক্ষার্থীরা নিজেদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয় দেয়ার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন ব্যবহার করছেন এমন অভিযোগ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের। এ থেকে অধিভুক্তি বাতিলের আন্দোলন ত্বরান্বিত হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ১১ জানুয়ারি সকালে অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এর পরে শুক্র ও শনিবার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় গত রোববার ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দিয়ে দ্বিতীয় দিনের আন্দোলন স্থগিত করেন শিক্ষার্থীরা। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে জানানো হয়, অধিভুক্ত শিক্ষার্থীদের কোনো কার্যক্রম এখন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হবে না। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তখনো অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে অনড় ছিলেন। গত সোমবার সকালে একই দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে নামেন পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী। তাদের আন্দোলন দমন করতে প্রশাসন ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেয় বলে অভিযোগ। এ সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের হুমকি-ধমকি দিয়ে আন্দোলন থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এতেও কোনো কাজ না হলে আন্দোলন সমন্বয়কারী মশিউরকে ভিসির কক্ষে নিয়ে মারধর করে ছাত্রলীগ। পরে তাকে পুলিশে দেয় প্রশাসন। এ দিকে ছেলেদের হুমকি-ধমকি দিয়ে সরিয়ে দিলেও মেয়েদের আন্দোলন থেকে সরাতে ব্যর্থ হয়ে তাদের উত্ত্যক্ত করার পন্থা বেছে নেয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। পরে বিভিন্ন হল শাখার নেতাদের উপস্থিতিতে তাদের উত্ত্যক্ত করে উঠিয়ে দিয়ে আন্দোলন পণ্ড করে ছাত্রলীগ।

এ দিকে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে আন্দোলন পণ্ড করা হলেও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়া এবং সমন্বয়ক মশিউরকে পুলিশে দেয়ার প্রতিবাদে ১৭ জানুয়ারি আন্দোলনে নামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনে পাঁচ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখা হয় প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানীকে। এ সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে বাম সংগঠনের নেতাকর্মী এবং তাদের সাথে বহিরাগত কিছু লোক এ আন্দোলনে ঢুকে পড়ে ভাঙচুর চালান। একপর্যায়ে বাম সংগঠনের বহিরাগত নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে উদ্দেশ্য করে উচ্চবাক্য করেন এবং অশালীন ভাষায় কথা বলেন। নানা ধরনের কথা বলে প্রক্টরকে ‘¯েøজিং’ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় ১৮ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে অজ্ঞাত ৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রব্বানী। এর প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার রাতে তাৎক্ষণিক আন্দোলনে নেমে পড়েন বাম সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ গতকাল রাতে ‘নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ এই ব্যানারে মশাল মিছিল বের করেন তারা। এ সময় অবিলম্বে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারসহ অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাদের বহিষ্কার ও প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেন তারা।

এ দিকে বৃহস্পতিবার সকালে পরীক্ষার এক বছর পরে ফল না হওয়ায় অবিলম্বে ফল প্রকাশের দাবিতে বিক্ষোভ করেন অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। পরে ভিসি কর্তৃক ২৫ ফেব্রæƒয়ারির মধ্যে ফল ঘোষণার আশ্বাস দিলে আন্দোলন প্রত্যাহার করেন তারা
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, একের পর এক আন্দোলন চললেও সেগুলো সামাল দিতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সম্প্রতি সংগঠিত কোনো ঘটনাই সুষ্ঠুভাবে সমাধান করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত ‘প্রক্টরিয়াল বডি’। শিক্ষার্থীদের দ্বারা প্রক্টরের কার্যালয় ভাঙচুর, ছাত্রলীগের কাছে এক ধরনের দায়িত্ব হস্তান্তর নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দ্বারা মেয়েরা হয়রানির শিকার হলেও সেখানে ছিলেন না প্রক্টরিয়াল টিমের কোনো সদস্য। নিজ ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের এমন অসহায়ত্ব প্রশাসনের ওপর আস্থাহীনতা সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ অজ্ঞাত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন বলে অভিযোগ তাদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের এক ঐতিহ্যবাহী বিভাগের একজন সিনিয়র অধ্যাপক বলেন, অজ্ঞাত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে পুলিশ। এটি বিশ্বের কোনো দেশে নেই। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা একটি বিশ্রী রকমের আপত্তিকর বিষয়। ঢাবি প্রশাসন এ ধরনের কাজ কেন করল সেটি আমার বোধগম্য নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। কোনো নামেও না, শিক্ষার্থী উল্লেখ করেও না।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/286518