২০ জানুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ৯:৫১

যে দাবানলের আভায় তিমিরাচ্ছন্ন হৃদয় উদ্ভাসিত হচ্ছে

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : আল্লাহতায়ালার কুদরত বা মহিমা বোঝা মুশকিল। অনেক সময় ইসলামের ঘোর দুশমনকেও দীনের পথে টেনে আনেন তিনি। রাসূলুল্লাহ (সা:) এর যুগেও এমন হয়েছিল। কেউ কেউতো ইসলামের নামোচ্চারণ করতোই না, অন্যদেরও তা করতে দিতো না। এমনকি আল্লাহ্র রাসূল (সা:) এর জীবননাশের ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করেছেন। কিন্তু পরে ইসলামের অনুসারী হয়ে দীনের একনিষ্ঠ খাদিমে পরিণত হয়েছেন।
অযোধ্যার ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসকারীদের অন্যতম করসেবক বলবীর সিংহ এখন মসজিদ বিনির্মাণে নিয়োজিত। তিনি ভেঙেপড়া মসজিদগুলোতো মেরামত করছেনই, নতুন মসজিদও নির্মাণ করে দিচ্ছেন। এ কাজে তাঁকে সহযোগিতা করছেন মুসলিমরাও। আল্লাহর কী শান! বাবরিভাঙা করসেবক এখন মসজিদনির্মাতার ভূমিকায় নিবেদিত।

কলকাতার আনন্দবাজারপত্রিকা, যুগান্তর ও মুম্বই মিরর সম্প্রতি জানায়, ২৫ বছর আগে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের গম্বুজে উঠে শাবলের প্রথম আঘাত মেরেছিলেন বলবীর। তিনি এখন লম্বা দাড়ি আর আলখেল্লাধারী আস্ত মওলিবী সাহেব। ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভেঙেপড়া শ’খানেক মসজিদ মেরামত করে দিয়েছেন তিনি ইতোমধ্যে। নতুন মসজিদও স্থাপন করছেন মুসলিম মহল্লায় মহল্লায়। এভাবেই অপরাধের দায় থেকে মুক্তি খুঁজে ফেরেন নওমুসলিম বলবীর। বলতে দ্বিধা নেই, সেই করসেবক বলবীর এখন পোশাক-আশাকে এমনকি অবয়বেও পুরোদস্তুর মুসলিম।
এক সময় শিবসেনার সক্রিয় কর্মী বলবীর সিংহ এখন নতুন নাম ধারন করেছেন মুহাম্মদ আমির। আল্লাহ্র নাম সবসময় থাকে তাঁর মুখে। আযান দেন নিয়মিত।
উল্লেখ্য, বাবরি মসজিদের গম্বুজে শাবলের ঘা দেবার পর সব খুইয়েছিলেন বলবীর। বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন তাঁকে। কারণ হিন্দু হলেও মসজিদ ধ্বংসের কাজটি বলবীরের বাবা পছন্দ করেননি। এতে বিপদ গুণছিলেন তিনি। স্ত্রীও সেই সময় তাঁর হাত ধরে বেরিয়ে আসেননি।

বাবার মৃত্যুর পর বাড়ি ফিরে শুনেছিলেন, বাবা নাকি বলে গিয়েছিলেন, তাঁর দ্বিতীয় সন্তান বলবীরের মুখ যেন বাড়ির কেউ আর না দেখেন। এমনকি বলবীরকে যাতে তাঁর বাবার মুখাগ্নি করতে না দেয়া হয়।
পরিবর্তনের আরেক নাম যোগেন্দ্র পাল। বলবীরের বন্ধু। ২৫ বছর আগে তিনিও বলবীরের সঙ্গেই উঠেছিলেন বাবরির গম্বুজে। শাবলের ঘা মেরে ভেঙেছিলেন মসজিদ। বহুদিন আগে তিনিও হয়ে গিয়েছেন পুরোদস্তুর মুসলিম।
বলবীর বলেন, সেটাই ছিল স্বাভাবিক। কারণ, তাঁর পরিবার কোনওদিন উগ্র হিন্দু ছিলেন না। ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর ইংরেজি--এই তিনটি বিষয়ে এমএ ডিগ্রি পাওয়া বলবীর তাঁর মা, বাবা, ভাই, বোনদের নিয়ে ছোটবেলায় থাকতেন ইতিহাসখ্যাত পানিপথের কাছে খুব ছোট্ট একটা গ্রামে। বলবীরের বয়স যখন ১০ তখন তিনি ও তাঁর ভাইদের পড়াশোনার জন্য বলবীরের বাবা দৌলতরাম তাদের নিয়ে চলে যান পানিপথে।
বলবীরের কথায়, “আমার বাবা বরাবরই গান্ধীবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি দেশভাগ দেখেছিলেন। তার যন্ত্রণা বুঝেছিলেন। তাই আমাদের আশপাশে যে মুসলিমরা থাকতেন, তিনি তাদের আগলে রাখতেন সবসময়। কিন্তু পানিপথের পরিবেশটা ছিল অন্যরকম। হরিয়ানার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা লোকজনরা তেমন মর্যাদা পেতেন না পানিপথে।”
এজন্য একটা গভীর দুঃখবোধ সবসময় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো বলবীরকে। সেই পানিপথেই একেবারে অচেনা, অজানা আরএসএস’র একটি শাখার কর্মীরা বলবীরকে দেখা হলে ‘আপ আপ’ (আপনি, আপনি) বলে সম্বোধন করতেন। সম্মান দেখাতেন।

বলবীর বলেন, “সেটাই আমার খুব ভালো লেগেছিল। সেই থেকেই ওদের (আরএসএস) সঙ্গে আমার ওঠবোস শুরু। শিবসেনা করতে করতেই বিয়ে করি। এমএ করি রোহতকের মহর্ষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ওই সময় প্রতিবেশীরা ভাবতেন আমি কট্টর হিন্দু। কিন্তু বাবা কোনওদিনই মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করতেন না। আমরা কোনওদিনই যেতাম না মন্দিরে। বাড়িতে একটা গীতা ছিল ঠিকই, কিন্তু আমি বা আমার ভাইয়েরা কেউ সেটা কখনও পড়িনি। পানিপথে কেউ বাঁ হাতে রুটি খেলেও তখন তাকে ‘মুসলিম’ বলে হেয় করা হয়।”*
শিবসেনার লোকজনদের কাছ থেকে ‘সম্মান’ পেয়ে ভালো লেগে যায় বলবীরের। শিবসেনাই তাঁকে অযোধ্যায় পাঠিয়েছিল বাবরি ভাঙতে। পাঠিয়েছিল বলবীরের বন্ধু যোগেন্দ্র পালকেও। তাঁরা হয়ে যান করসেবক।
বলবীর জানান, বাবরি ভেঙে পানিপথে ফিরে আসবার পর সেখানে তাঁকে ও যোগেন্দ্রকে অভূতপূর্ব সংবর্ধনা জানানো হয়। তাঁরা দু’জনে যে দু’টো ইট এনেছিলেন বাবরির মাথায় শাবল চালিয়ে, সেগুলো পানিপথে শিবসেনার স্থানীয় অফিসে সাজিয়ে রাখা হয়।

কিন্তু দুর্ভাগ্য বলবীরের। বাড়িতে ঢুকতেই রে রে করে ওঠেন বলবীরের বাবা দৌলত রাম। বলবীরের কথায়, “বাবা আমাকে বললেন, হয় তুমি এ বাড়িতে থাকবে, না হলে আমি। এরপর আমিই বেরিয়ে গেলাম বাড়ি থেকে। আমার স্ত্রীও বেরিয়ে এলো না। থেকে গেল বাড়িতেই।”
সেসময় ভবঘুরের মতো জীবন কাটিয়েছেন বলবীর। জানিয়েছেন, লম্বা দাড়িওলা লোক দেখলেই ভয়ে আঁতকে উঠতেন তখন। বেশকিছু দিন পর বাড়িতে ফিরে জানতে পারেন, বাবা মারা গেছেন। তিনি বাবরি ভাঙায় যে দুঃখ পেয়েছিলেন তাতেই নাকি তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
এরপর পুরনো বন্ধু যোগেন্দ্রের খোঁজখবর নিতে গিয়ে আরও মুষড়ে পড়েন বলবীর। জানতে পারেন, যোগেন্দ্র মুসলিম হয়ে গিয়েছেন। যোগেন্দ্র নাকি তখন বলবীরকে বলেছিলেন, বাবরি ভাঙার পর থেকেই তার মাথা বিগড়ে গিয়েছিল। যোগেন্দ্রের মনে হয়েছিল পাপ করেছিলেন বলেই সেটা হয়েছে। প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে তাই মুসলিম হয়ে যান যোগেনও।

এরপরই আর দেরি না করে সোনেপতে গিয়ে ভারতের বিশিষ্ট আলেমে দীন মওলানা কালিম সিদ্দিকীর কাছে ইসলামগ্রহণ করেন বলবীর। নতুন নাম রাখা হয় মুহাম্মদ আমির।
‘প্রায়শ্চিত্ত’ করতে কী কী করতে চান বলবীর সিংহ ওরফে মুহাম্মদ আমির? এমন প্রশ্নের জবাবে বলবীর বলেন, “কম করে হলেও ভেঙেপড়া শ’খানেক মসজিদ মেরামত করতে চাই।”
বলবীর জানান, ১৯৯৩ থেকে ২০১৭ এই ২৪ বছরে উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে মেওয়াট অঞ্চলের বেশকিছু ভেঙেপড়া মসজিদ খুঁজে বের করে সেগুলো মেরামত করেছেন তিনি। উত্তরপ্রদেশের হাথরাসের কাছে মে-ুর মসজিদও সারিয়েছেন বলবীরই। মহৎ এ কাজে সেখানকার মুসলিমরাও তাঁকে এগিয়ে এসে সহযোগিতা করেন। এভাবে মুহাম্মদ আমিরসহ ভারতের নওমুসলিমদের সহযোগিতায় ইতোমধ্যে প্রায় ১৫০ টিরও বেশি মসজিদ নির্মিত হয়েছে বলে প্রকাশ।
নওমুসলিম মুহাম্মদ আমিরের শশ্রুম-িত দাঁড়ি আর আলখেল্লাসহ ছবি দিয়ে গত ১ জানুয়ারি কলকাতার আনন্দবাজারপত্রিকা, ২ জানুয়ারি সেখানকার দৈনিক যুগান্তর ফলাও করে এ খবর ছাপে। পরে মুম্বাই মিররেও একই নিউজ ফিচার ছাপা হয়। তার আগে মওলানা কালিম সিদ্দিকির পত্রিকাসহ আরও কয়েকটি কাগজ বলবীরের মুসলিম হবার খবর ছাপে।

অনেক দিন যাবৎ বলবীরের পরিবর্তনের খবর ভারতের নামিদামি মিডিয়াগুলো চেপে রাখলেও সেটা শেষ অবধি আর সম্ভব হয়নি। আগুন কি আর ছাইচাপা রাখা যায়? বাবরি ভাঙবার পর বলবীর এবং যোগেন্দ্রের হৃদয়ে যে দাবানলের সৃষ্টি হয়েছিল তা এখন অনেকের হৃদয়ই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই, বলবীর নিজেও এক দাবানল। আর এ দাবানলের সোনালী আভায় অনেক ভারতীয়ের তিমিরাচ্ছন্ন হৃদয়-মন উদ্ভাসিত হচ্ছে প্রতিদিন।

 

http://www.dailysangram.com/post/315890