১৯ জানুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৫০

এত অস্ত্র বৈধ নাকি অবৈধ

পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে না হতেই বৈধ-অবৈধ অস্ত্র দেখা যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জের রাজপথে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, অবৈধ অস্ত্র শনাক্ত করে এর ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। তা ছাড়া অস্ত্র বৈধ হলেও ব্যবহারের নীতিমালা মানা না হলে বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। মঙ্গলবারের ঘটনায় অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শনের পাশাপাশি বৈধ অস্ত্র ব্যবহারের নীতিমালা লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।

২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনার পর নূর হোসেন ও তার সহযোগীদের বাসা ও আস্তানায় অভিযান চালিয়ে ১১টি অস্ত্র উদ্ধার করেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। অভিযোগ ছিল, নূর হোসেন ও তার সহযোগীরা অবৈধভাবে বৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে জনগণকে ভয়ভীতি দেখাত। কয়েক বছর পর গত মঙ্গলবার আবারও নারায়ণগঞ্জের রাজপথে অস্ত্রের মহড়া দেখা গেল। অভিযোগ উঠেছে, মেয়র আইভী ও এমপি শামীম ওসমান উভয়ের সমর্থকরাই রাজপথে অস্ত্র বহন ও ব্যবহার করেছে। হকার উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার সংঘর্ষের সময় অন্তত পাঁচজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। অনেকেই বলছেন, ওই দিন আরও অনেকে অস্ত্র বহন করছিল। এর অধিকাংশই অবৈধ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেকের হাতে বৈধ অস্ত্র থাকলেও তা ব্যবহারের নীতিমালার লঙ্ঘন বলে মনে করছেন তারা।

এদিকে গতকাল ঢাকায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, নারায়ণগঞ্জে যারা অস্ত্র দেখিয়েছে, তারা নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভিডিও ফুটেজ দেখে কারা কী করেছে, কেন করেছে, তার তদন্ত করা হচ্ছে। তাদের ধরার চেষ্টা চলছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মঈনুল হক সমকালকে বলেন, নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার হয়ে থাকলেও তা শনাক্ত করা হবে। ব্যবহারকারীদের আইনের আওতায় নেওয়া হবে। অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়ে থাকলে তাও খুঁজে বের করা হবে।

এখন পর্যন্ত কোনো অস্ত্রধারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, ঘটনার পরপরই তারা পালিয়ে গেছে। এখনও কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি।

গত মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জের যাদের হাতে অস্ত্র দেখা তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক যুবলীগ নেতা নিয়াজুল। তিনি সাংসদ শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তার ভাই নজরুল ইসলাম সুইট আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন তিনি। মেয়র আইভীর অভিযোগ, নিয়াজুল পিস্তল উঁচিয়ে তাকে মারতে আসেন। তিনি শামীম ওসমানের চার 'খলিফার' একজন।

তবে শামীম ওসমানের দাবি, তিন দফায় মারধরের শিকার হয়ে লাইসেন্স করা অস্ত্র বের করেন নিয়াজুল। তবে তার অস্ত্র থেকে কোনো গুলি বের হয়নি। তার অস্ত্রের ব্যালিস্টিক পরীক্ষার দাবি করেন এমপি শামীম। নিয়াজুলের অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার বিষয়ে তদন্তের কথাও বলেন তিনি। নিয়াজুলের কোনো অপরাধ হয়ে থাকলে ফুটেজ দেখে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেন এই এমপি।

মঙ্গলবার নিয়াজুলকে ছাড়াও অস্ত্র বহন করতে দেখা গেছে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সুফিয়ানকে। অস্ত্রসহ দেখা গেছে যুবদল নেতা সুমনকে। কাকে রক্ষা করতে যুবদল নেতা সুমন পিস্তল হাতে ছিলেন সেই প্রশ্ন তুলেছেন শামীম ওসমান। এছাড়া মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজামকে অস্ত্র হাতে দেখা যায়। তিনি শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, সংঘর্ষ চলাকালে নিজাম কয়েক রাউন্ড গুলিও ছোড়ে। ফুটেজে দেখা যায়, ঘটনার সময় তিনি জিন্স প্যান্ট ও জ্যাকেট পরা অবস্থায় ছিলেন। মঙ্গলবার সায়েম প্লাজার সামনে যে স্থানে মূল সংঘর্ষ হয়েছিল ওই ভবনের তিন তলায় তার কার্যালয় রয়েছে। বছর দুই-এক আগেও একবার চাষাঢ়া এলাকায় পিস্তল দিয়ে বিরোধী পক্ষকে গুলি করেছিল নিজাম। অস্ত্রধারী কয়েকজনের সঙ্গে এ বিষয়ে জানতে গতকাল মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি।

দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, কোনো ব্যক্তি কোন পরিস্থিতিতে অস্ত্র ব্যবহার করবেন অস্ত্র ব্যবহারের নীতিমালায় তার স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি নিজের লাইসেন্স করা অস্ত্র আত্মরক্ষায় নিজে বহন বা ব্যবহার করতে পারবেন। তবে অন্য কেউ ভীত বা বিরক্ত হতে পারেন, এমনভাবে অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। এ ছাড়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সধারী কেউ অন্য কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তির নিরাপত্তায় অস্ত্রধারী প্রহরী হিসেবে নিয়োজিত হতে পারবেন না। তা করলে তার অস্ত্রের লাইসেন্স তাৎক্ষণিকভাবে বাতিলযোগ্য হবে। প্রত্যক্ষদর্শী ও অন্যান্য একাধিক সূত্র বলছে, নারায়ণগঞ্জে অন্যকে ভয় দেখাতে অস্ত্র তাক করা হয়েছে। বৈধ অস্ত্র হলেও তা ব্যবহারের নীতিমালা মানা হয়নি।

২০১৫ সালে রাজধানীর ইস্কাটনে আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনি যানজটে পড়ে বিরক্ত হয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছিলেন। তাতে এক রিকশাচালক ও এক অটোরিকশাচালক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। গত বছরের ২ অক্টোবর গাইবান্ধায় এক সাংসদ শিশু সৌরভকে গুলি করেন।

নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের পর বেরিয়ে আসে প্রভাব খাটিয়ে নূর হোসেন ও তার সহযোগীরা অস্ত্রের লাইসেন্স নেন। অস্ত্রের লাইসেন্সধারীদের মধ্যে রয়েছে তার ভাই নূর উদ্দিন মিয়া, তার ভাতিজা শাহজালাল বাদল, তার সহযোগী শাহজাহান, আলী মোহাম্মদ, সানাউল্লাহ, জামালউদ্দিন ও আরিফুল হক হাসান। সাত খুনের পর নূর হোসেন ও তার সহযোগীদের ১১টি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল হয়। তখন প্রশ্ন উঠেছিল, কেন, কী কারণে, কোন বিবেচনায় নারায়ণগঞ্জে তারা এত অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছিল।

বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার ঠেকাতে ২০১৬ সালে একটি নীতিমালা করে সরকার। সেখানে বলা হয়, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন থাকলে ওই ব্যক্তি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাবেন না। কেউ ফৌজদারি আদালত থেকে চূড়ান্ত সাজাপ্রাপ্ত হলে ১০ বছরের মধ্যে লাইসেন্স পাবেন না। আগ্নেয়াস্ত্রের ক্ষেত্রে প্রতিবছর সর্বোচ্চ ১০০টি গুলি কেনার অনুমতি দেওয়া যাবে।

ফুটপাত দখলমুক্ত করার নির্দেশনা মানেননি সাবেক ওসি : নারায়ণগঞ্জে গিয়ে সংশ্নিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে বঙ্গবন্ধু সড়ককে হকারমুক্ত করার সবচেয়ে বড় বাধা ছিলেন স্থানীয় থানার পুলিশ সদস্যরা। অবৈধ সুবিধা নিয়ে তারা ওই সড়কে হকারদের বসার ব্যবস্থা করে দেন। গত ২৪ ডিসেম্বর 'বড়দিনে' বঙ্গবন্ধু সড়ককে হকারমুক্ত করতে নারায়ণগঞ্জ সদর থানার ওসি শাহীন শাহ পারভেজকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা। সে নির্দেশনা আমলে নেননি তিনি। নগরীর ফুটপাত অবৈধ দখলমুক্ত করতে ব্যর্থ হওয়ায় ২৫ ডিসেম্বর তাকে প্রত্যাহার করা হয়।

 

http://samakal.com/whole-country/article/1801969