১৯ জানুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৪৯

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সময় লাগবে ৯ বছর!

বাস্তুচ্যুত প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে ‘সম্ভব হলে’ দুই বছরে রাখাইনে ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। সম্প্রতি সই হওয়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ক দ্বিপক্ষীয় চূড়ান্ত চুক্তি ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্টে ২০১৬ সালের পরে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরাতে ওই সময়সীমা নির্ধারিত হয়েছে। শুরুর দিকে দৈনিক ৩০০ করে সপ্তাহের ৫ দিনে ১৫’শ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয় মিয়ানমার। অবশ্য চুক্তিতে তিন মাসের মধ্যে পর্যালোচনা করে এই সংখ্যা বাড়ানোর অপশন বা সুযোগ রাখা হয়েছে। চুক্তি সইয়ের প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ঢাকার অন্তত দু’জন কর্মকর্তা বিদ্যমান টাইমলাইনকে ‘অবাস্তব’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তারা চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে এখনো সংশয়ে থাকার কথা জানিয়েছেন মানবজমিনকে।

অবশ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা গতকাল সন্ধ্যায় মানবজমিনকে বিষয়টি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন। তার মতে, প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়া পর্যন্ত সংশয় থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। শুরুতে ফেরত যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের সংখ্যাও কম থাকবে। কারণ যেভাবে নির্যাতন করে তাদের তাড়ানো হয়েছে তাতে ফেরতে এখনো অনেকে আগ্রহী নন। কিন্তু মিয়ানমার যদি তার অঙ্গীকার রাখে এবং নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করে তা হলে ফিরতে আগ্রহী রোহিঙ্গার সংখ্যা বাড়বে। এটি ৩ মাস পর বিদ্যমান সংখ্যার দ্বিগুণ বা ৩ গুণও হতে পারে বলে ধারণা দেন চুক্তি সইয়ের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীল ওই কর্মকর্তা। কর্মকর্তাদের ব্যাখ্যা যাই হোক সরকারের ভেতরে-বাইরে থাকা সচেতন ব্যক্তিদের মধ্যে এ নিয়ে এখনো সংশয় রয়েছে। তাদের যুক্তি হচ্ছেÑ বিদ্যমান চুক্তি ধরে প্রথম ৩ মাস বা ১৩ সপ্তাহে পাঠানো যাবে ১৯ হাজার ৫০০ জনকে (যদি মিয়ানমার রাজি থাকে)। সে হিসেবে ৫২ সপ্তাহ বা এক বছরে যাবে ৭৮ হাজার। দু’বছরে যেতে পারবে ১ লাখ ৫৬ হাজার। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাব মতে ’১৬ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ৭ লাখ ৪২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এখনো সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাস্তুচ্যুতদের প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। বিদ্যমান চুক্তির পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলেও বিশাল সংখ্যক ওই রোহিঙ্গাকে ফেরাতে কমপক্ষে ৯ বছর সময় লাগবে! এটি যে দু’বছরে অসম্ভব সেটি এক বাক্যেই বলছেন সমালোচকরা। তারা এ-ও বলছেন, রাষ্ট্রদূত স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দৈনিক ৩ হাজার করে সপ্তাহে (৫ দিনে) ১৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার তাতে রাজি হয়নি। বাংলাদেশের প্রস্তাবে মিয়ানমারের সায় পাওয়া গেলে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরাতে এক বছরের খানিক বেশি এবং দু’বছরের কম সময় লাগতো। কিন্তু মিয়ানমার কোনো রকম যৌক্তিক ব্যাখ্যা ছাড়াই বাংলাদেশের প্রস্তাবের এক দশমাংশে অর্থাৎ সপ্তাহে ১৫ হাজারের প্রস্তাবের বদলে সপ্তাহে ১৫’শ ফেরানোর প্রস্তাব করে। জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা দৈনিক ও সপ্তাহে প্রত্যাবাসনের সংখ্যা বাড়াতে দেন-দরবার করলেও শেষ পর্যন্ত মিয়ানমারের অনড় অবস্থানের কারণে তাদের প্রস্তাবেই সম্মতি দিতে হয়েছে। ৩ মাস পরে বিদ্যমান সংখ্যা দিগুণ বা ৩ গুণ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে যে ব্যাখ্যা এসেছে তার পাল্টা ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন একজন। ৩ মাসে ১৯ হাজার ৫শ’ রোহিঙ্গা গেলে বাকি থাকবে ৭ লাখ ২২ হাজার ৫০০ জন। ৩ মাস পর দরকষাকষিতে দৈনিক ৩’শ-এর বদলে তা দ্বিগুণ করে ৬০০ করা হলেও ন্যূনতম ৫ বছর সময় লাগবে! আর এটি ৩ গুণ হলে বছরে যাবে ২ লাখ ৫২ হাজার। সেটি হলেও ৩ মাসের পর অবশিষ্ট ৭ লাখ ২২ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরাতে সময় লাগবে কমপক্ষে ৩ বছর। সেটি কোনো অবস্থাতেই নির্ধারিত দু’বছরে সম্ভব হবে না! উল্লেখ্য, মিয়ানমারের তরফে প্রথম ধাপে হিন্দু-মুসলিম মিলে ১২৫৮ জনকে ফেরানোর আগাম ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আর রাখাইনে প্রাথমিকভাবে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা ধারণের ক্যাম্প বা খোয়াড় তৈরি করা হচ্ছে। তাদের বাড়িঘরে ফেরানোর ঘোষণা এখনো স্পষ্ট নয়। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশও চায় না রোহিঙ্গাদের তড়িঘড়ি করে ফেরাতে। তাদের স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে রাখাইনে শান্তিপূর্ণ বসবাসের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন ঢাকার কর্মকর্তারা। গত বৈঠকেও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রত্যাবাসনের শুরুতে সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে আটকে পড়া কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়া আর প্রত্যাবাসন শুরুর আগে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠানো বন্ধ করা নিশ্চিত করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গারা অতীতেও ফিরে গিয়ে আবার বাংলাদেশে চলে এসেছে জানিয়ে দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, এবারে রোহিঙ্গাদের অধিকাংশ ঘরবাড়িই গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাই প্রথম দফায় যেসব রোহিঙ্গা ফিরে যাবে তারা যেন দ্রুত নিজেদের আদি আবাসের কাছাকাছি কোথাও গিয়ে থাকতে পারে, নিরাপত্তাহীনতায় না ভোগে সেটি নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছে ঢাকা। প্রথম দফায় যারা ফিরবে, রাখাইনে তাদের ইতিবাচক অবস্থান অন্যদের উৎসাহিত করবে।

প্রত্যাবাসন ফরমে যা থাকছে: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ায় একটি আবেদনপত্র চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। কয়েক পৃষ্ঠার ওই আবেদনপত্রের প্রথমে পরিবারের প্রধানের তথ্য দিতে হবে। এতে পরিবার প্রধানের নাম, লিঙ্গ, জন্মস্থান, বাবা-মায়ের নাম, স্ত্রীর নাম, জন্ম তারিখ, মিয়ানমারে ঠিকানা, মিয়ানমারে বাবার ঠিকানা, মিয়ানমারে মায়ের ঠিকানা, মিয়ানমারে স্ত্রীর ঠিকানা, পেশা, বিশেষ শারীরিক চিহ্ন, বাড়ির নম্বর (যদি থাকে) এবং পরিবারের সদস্য সংখ্যা উল্লেখ করতে হবে। আবেদনপত্রে তার ছবি, পরিবারের অন্য সদস্যের ছবি (ঐচ্ছিক), একটি পুরো পরিবারের ছবি, পাঁচ বছরের ওপরে প্রত্যেকের দুই হাতের বুড়ো আঙুলের ছাপ দিতে হবে। একই আবেদনপত্রে পরিবারের বাকি সদস্যদের বিস্তারিত তথ্য দিতে হবে। এই আবেদনপত্র পূরণ করে মিয়ানমারকে দেবে বাংলাদেশ। সম্ভব হলে দুই মাসের মধ্যে মিয়ানমার তা যাচাই শেষ করে বাংলাদেশকে ফেরত দেবে। এর চার সপ্তাহের মধ্যে পরিবার অনুযায়ী তাদের প্রত্যাবাসন হবে। আবেদনপত্র এবং রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর সহায়তা নেবে। এ নিয়ে সংস্থাটির বাংলাদেশস্থ প্রতিনিধিদের সঙ্গে ঢাকার কর্মকর্তাদের আলোচনাও শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=101178