১৯ জানুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৪২

২৭ বছর ধরে অচল ডাকসু

শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই

প্রতিষ্ঠার পর থেকে অদ্যাবধি দেশের প্রায় সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। এ নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে রাজনীতির সূতিকাগারখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) থেকে। সঙ্কটময় মুহূর্তে দেশ-জাতির অধিকারের পে দাঁড়ালেও দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে অচল দেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্টখ্যাত এই ডাকসু। ডাকসু যত দিন সক্রিয় ছিল তত দিন শিার্থীদের যেকোনো গণতান্ত্রিক দাবি আদায়ে কণ্ঠস্বরের ভূমিকা রাখত। বর্তমানে তা বন্ধ থাকায় শিার্থীদের প্রতিনিধিত্বমূলক ছাত্ররাজনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। এমনকি কোনো গ্রাউন্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিার্থীদের পে কথা বলার পথটিও রুদ্ধ হয়ে গেছে। সেই সাথে গড়ে উঠছে না সৎ, মেধাবী এবং যোগ্য নেতৃত্বও। শিার্থীদের প্রতিনিধিত্বমূলক-শিার্থীবান্ধব নেতৃত্ব না থাকায় তাদের কথা বলতে পারছেন না তারা। ফলে হারাচ্ছেন নিজেদের ন্যায্য অধিকার। সংশ্লিষ্টদের অভিয়োগ, ডাকসু তথা শিক্ষার্থী প্রতিনিধি না থাকায় তাদের দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ফলে বন্ধ হচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা। সে জন্য বহু দিন ধরে ডাকসু নির্বাচনের দাবি করে আসছেন শিক-শিার্থী এবং ছাত্রনেতারা।

২৭ বছর ধরে অচল ডাকসু
তথ্যমতে, দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে অচল ডাকসু। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈর শাসনামলে নির্বাচন হলেও গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে ব্যাহত হচ্ছে নির্বাচন, যা সরকারগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, সিন্ডিকেট, শিক সমিতি, অফিসার্স কাব, কর্মচারী কাবসহ সব নির্বাচন হলেও দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে হচ্ছে না শুধু ডাকসু নির্বাচন। বিগত সময়গুলোতে সরকারের কর্তৃত্ব হারানোর ভয় এবং সরকারগুলোর প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নতজানু অবস্থার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক-শিার্থী, সচেতন নাগরিকসমাজ, শিাবিদ, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতৃবৃন্দের দাবি সত্ত্বেও ব্যাহত হচ্ছে ডাকসু নির্বাচন। এ জন্য প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাবকেই দায়ী করছে সব মহল।
জানা যায়, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরে ১৯২২-২৩ শিাবর্ষে ডাকসুর জন্ম। ১৯২৪-২৫ শিবর্ষে এর প্রথম নির্বাচন হয়। এ পর্যন্ত ৩৬ বার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। স্বাধীনতার পর হয়েছে ছয়বার। স্বাধীনতার পর সর্বপ্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালে এবং সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ৬ জুন। ১৯২১ সালে উপমহাদেশের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাবি প্রতিষ্ঠার পরে ১৯২২-২৩ শিাবর্ষে ডাকসু সৃষ্টি হয়। তখন এক টাকা চাঁদা দিয়ে শিার্থীদের এর সদস্য হতে হতো। ১৯৭০ সালে ডাকসুতে পরো নির্বাচনের বদলে প্রত্য নির্বাচনপদ্ধতি চালু হয়। প্রথম সাধারণ সম্পাদক (জিএস) হিসেবে ১৯২৪-২৫ শিাবর্ষে নির্বাচিত হন যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।

১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রথম ডাকসু নির্বাচন হয়। তারপর নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৯৭৯-৮০ সেশনে পুনরায় ডাকসু নির্বাচন দেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। যার পরিপ্রেেিত ভিপি হিসেবে বিজয়ী হন মাহমুদুর রহমান মান্না। জিএস হিসেবে নির্বাচিত হন আকতারুজ্জামান।
সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ৬ জুন। এ নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেলে আমান উল্লাহ আমান ভিপি এবং খায়রুল কবির খোকন জিএস নির্বাচিত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী প্রতি বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও এরপর আর ডাকসু নির্বাচন হয়নি। একে একে নেতৃত্বহীনতায় কেটে গেছে ২৬ বছর। এর মধ্যে অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা, অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ও অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী ভিসি থাকাকালে নির্বাচনের উদ্যোগ নিলেও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তা সফল করতে পারেননি তারা।
শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই
ডাকসু না থাকায় দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অধিকার ুণœ হলেও প্রশাসনের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার মতো নেই কোনো ছাত্র প্রতিনিধি। বিভিন্ন স্থানে মার খেতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তায় কোনো কার্যকরী পদক্ষেপের জন্য কথা বলার মতো কেউ নেই। ফলে উত্তরণ হচ্ছে না আবাসন সঙ্কট, শ্রেণিকক্ষ সঙ্কট, গ্রন্থাগারে আসন সঙ্কট প্রভৃতি। পুষ্টিকর খাদ্যের নিশ্চয়তাও পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সেশনজটে রেখেও একের পর এক বিভাগে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু হচ্ছে। অবৈধভাবে দেয়া হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ শিক্ষকদের। সরকারের লেজুড়বৃত্তিমূলক ছাত্ররাজনীতির কারণে ুণœ হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার। সিনেটে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি না থাকায় সেখানে তাদের পক্ষে কথা বলার কেউ থাকে না। ফলে হচ্ছে না শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীবান্ধব বাজেট। গণরুম-গেস্টরুমের নোংরা রাজনীতির বলি হচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এভাবে শিক্ষার্থীদের একের পর এক অধিকার ুণœ হলেও ডাকসু না থাকায় তাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই।
৬ মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের নির্দেশ
দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে ডাকসু বন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ছয় মাসের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ওই নির্বাচনের সময় যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তার প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ শিার্থীর এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো: আতাউর রহমান খানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ গত ১৭ জানুয়ারি এ রায় দেন।

আদালত সে সময় রুল দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ডাকসু নির্বাচন করার ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না। শিা সচিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার ও প্রক্টরের কাছে এই জবাব চাওয়া হয়েছিল। সেই রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্টের ওই বেঞ্চ এ রায় দেন। আদালতে রিটের পে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
রায়ের পরে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেন, হাইকোর্ট ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপকে এই নির্দেশনা কার্যকর করতে বলেছেন। একই সঙ্গে ডাকসু নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও নির্দেশ দেন আদালত।
ডাকসু নিয়ে শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতাদের অবস্থান
সর্বশেষ ২৫ নভেম্বর ২০১৭ ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে অনশন করেন সান্ধ্যকালীন কোর্সের ছাত্র ওয়ালিদ আশরাফ। এর আগেও বেশ কয়েকবার সিনেটে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। গত বছরের ২৯ জুলাই ছাত্র প্রতিনিধি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নির্বাচনের প্রতিবাদে বিােভ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিার্থীরা। বিভিন্ন সময় ডাকসুর দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উন্মুক্ত আলোচনা, উন্মুক্ত বিতর্ক, উন্মুক্ত সংলাপ, প্রতিবাদী গানের আয়োজন, মোমবাতি প্রজ্বলন, মুখে কালো কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ প্রদর্শন প্রভৃতি বিভিন্ন আয়োজন করেন তারা।
ডাকসু নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতাদের মধ্যে আগ্রহের কমতি নেই। নির্বাচনের পে জোর দাবি তুলে ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি তুহিন কান্তি দাস বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হ-য-ব-র-ল অবস্থা। সঠিক নেতৃত্ব না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা চাই ডাকসুর মাধ্যমে ছাত্ররা গণতান্ত্রিকভাবে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করুক। আমরা তার সাথেই থাকবো।
ডাকসু নির্বাচনের পে সমর্থন দিয়ে ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি আবিদ আল হাসান বলেন, নির্বাচন হওয়া উচিত। আমরাও চাই নির্বাচন হোক।

ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর সহাবস্থান নিশ্চিত করার মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচনসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি রাজিব আহসান বলেন, শিাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যথাযথ পরিবেশ এবং ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর রাজনীতি করার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তারপর নির্বাচনের কথা বলা যেতে পারে। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করে নির্বাচন দিতে হবে। আমরাও অংশগ্রহণ করব। আমরা চাই ছাত্ররাই তাদের নেতৃত্ব নির্বাচন করুক।
ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কতগুলো উপাদান রয়েছে। সেগুলোর সমন্বয় করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচন করতে পারে। হাইকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার পর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করা হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/286246