১৮ জানুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৮:৩৬

দায় কার :সরকারের, না ইসির

তফসিল ঘোষণাই ছিল ত্রুটিপূর্ণ

আশঙ্কাই সত্যি হলো। আইনি জটিলতায় আটকে গেল ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র পদের উপনির্বাচন; একই সঙ্গে সম্প্রসারিত ১৮ ওয়ার্ডের সাধারণ নির্বাচনও। তফসিল স্থগিত হওয়ায় এবার শুরু হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্ক। বিএনপির পক্ষ থেকে এ জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করা হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, এতে তাদের হাত নেই।

বেশ কয়েকটি আইনি বিষয় অমীমাংসিত রেখেই গত ৯ জানুয়ারি এই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিল ইসি। নির্বাচন-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ইসি ঘোষিত এই তফসিলই ছিল ত্রুটিপূর্ণ। বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা ব্যক্ত করার পর জটিলতা এড়িয়ে তফসিল ঘোষণার সুযোগ থাকলেও ইসি তা করেনি। ইসির এমন আচরণে জনমনে আস্থাহীনতা তৈরি হবে।

ইসি ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন এবং নবগঠিত ১৮ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও ছয়টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে সাধারণ নির্বাচনের ভোট হওয়ার কথা ছিল। গতকাল আদালত ঘোষিত তফসিলের ওপর তিন মাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। আজ ১৮ জানুয়ারি ছিল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সম্প্রসারিত ১৮ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচন নিয়েও আদালতে রিট হয়েছে, যা আদেশের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।

আদালতের আদেশের পর গতকাল বুধবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন করা ইসির দায়িত্ব। স্থানীয় সরকার থেকে এসব নির্বাচন করার জন্য অনুরোধ পেয়েছে ইসি। সেভাবেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। আইনি বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো বাধা নেই। এর পরিপ্রেক্ষিতেই তফসিল ঘোষণা করা হয়।

ইসি সচিব বলেন, হাইকোর্টের আদেশের ব্যাপারে কমিশন গণমাধ্যম থেকে জানতে পেরেছে। কমিশন সব সময় আদালতের নির্দেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আদেশের লিখিত কপি পাওয়ার পর নির্বাচন কমিশন পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে। তবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৮টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ছয়টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের কার্যক্রম চলবে। এক প্রশ্নের জবাবে হেলালুদ্দীন বলেন, ভোটার তালিকা প্রস্তুত ছিল। ভোটার তালিকার সিডিও প্রকাশ করা হয়েছে।

বিদ্যমান ভোটার তালিকা ও নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলোর কাউন্সিলরদের মেয়াদ নিয়ে আইনি জটিলতার আশঙ্কা ছিল শুরু থেকেই। এ নিয়ে গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদনও হয়েছে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরাও তাদের আশঙ্কার কথা বলে আসছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন (ইসি) শুরু থেকেই তা আমলে নেয়নি। তারা বারবার বলে এসেছে, নির্বাচন করার ক্ষেত্রে আইনি কোনো জটিলতা নেই।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল কাশেম বলেন, হাইকোর্টে রিট আবেদনকারী গত সোমবার মনোনয়নপত্র নিতে এসেছিলেন নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে। তাকে ভোটার তালিকার সিডি দেওয়া হয়েছিল। ভোটার তালিকায় তার নামও আছে।

তফসিল ঘোষণার আগে একাধিক নির্বাচন কমিশনার আইনি জটিলতার কথা স্বীকার করেছিলেন। তাদের মত ছিল, আইনি জটিলতা রেখে তফসিল দিয়ে দায় নিজেদের ঘাড়ে নিতে চায় না ইসি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। আইনি জটিলতা রেখেই তফসিল দেওয়া হয়। তফসিল ঘোষণা করে সিইসি কে. এম. নুরুল হুদা বলেছিলেন, এ নির্বাচনে আইনগত বাধা নেই।

ইসি সূত্র জানায়, ইসির সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যেও এই জটিলতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। গত ডিসেম্বরে তফসিল ঘোষণার আগে এই নির্বাচন নিয়ে বৈঠকে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা ভোটার তালিকা, নতুন ওয়ার্ডের সীমানা নির্ধারণ, নতুন ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের মেয়াদ সম্পর্কিত জটিলতাসহ ছয়টি বিষয় বিবেচনা করার কথা বলেছিলেন লিখিত আকারে। কিন্তু সেসব বৈঠকে এ বিষয়গুলো পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে।

এদিকে, আদালতের আদেশের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, '২০১১ সালের আগে সংবিধানের ১২৫(গ) অনুচ্ছেদ ছিল না। পরে এটা সংযোজন করা হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পরে আদালতের আদেশের কারণে ওই সময় ইসিকে ২৮ লাখ ব্যালট পেপার পোড়াতে হয়েছিল। এরপর এই ১২৫(গ) অনুচ্ছেদ সংযোজিত হয়েছে।' কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, 'তফসিল এভাবে স্থগিত হয়ে গেলে নির্বাচন কমিশন কার্যকর হবে না। এতে সরকারের অর্থ অপচয় হবে। একদিনের নোটিশে আদেশ দিলে নির্বাচন কমিশন কীভাবে কাজ করবে।'

সংবিধানে ১২৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও (গ) কোন আদালত, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হইয়াছে এইরূপ কোন নির্বাচনের বিষয়ে, নির্বাচন কমিশনকে যুক্তিসংগত নোটিশ ও শুনানির সুযোগ প্রদান না করিয়া, অন্তর্বর্তী বা অন্য কোনরূপে কোন আদেশ বা নির্দেশ প্রদান করিবেন না।'

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার জানান, তফসিল স্থগিত হওয়ায় নাগরিক হিসেবে তিনি বিভ্রান্ত। এটা সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। কারণ, সেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে স্থানীয় সরকার পরিচালনার কথা বলা রয়েছে। তিনি বলেন, এর জন্য দায়ী কে- ইসি, নাকি সরকার? আদালত তড়িঘড়ি করে আদেশ দিল কেন- সেটাও বোধগম্য নয়। এটা জনস্বার্থে হয়নি।

আদালতের এমন আদেশে নিজে সংক্ষুব্ধ জানিয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার ইসিকে নোটিশ দিয়ে আদালতকে শুনতে হবে। সংবিধানের ১২৫ অনুচ্ছেদে সেটা নিশ্চিত করা আছে। তিনি বলেন, ত্রুটিপূর্ণ তফসিল ঘোষণার কারণে ইসির যেমন দায় রয়েছে, তেমনি সরকারও দায় এড়াতে পারে না। ইসির এমন আচরণে জনমনে আস্থাহীনতা তৈরি হবে। এমনকি আগামী সংসদ নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়বে।

ইসির আইন শাখা থেকে জানা গেছে, আদেশ দেওয়ার সময় নির্বাচন কমিশনের প্যানেলভুক্ত আইনজীবী তৌহিদুল ইসলামকে আদালত থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। ইসির প্যানেলভুক্ত নয় আইনজীবীর মধ্যে আট নম্বরে তৌহিদুল ইসলামের নাম রয়েছে। তিনি সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। কমিশন থেকে আগেভাগে তাকে কিছুই জানানো হয়নি।

এ বিষয়ে তৌহিদুল ইসলাম বলেন, আদালতে যেহেতু কমিশনকে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন, তাই তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন আদালত। তিনি সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। তবে ইসিকে আদালত থেকে কোনো নোটিশ দেওয়া হয়েছিল কি-না সেটা তিনি জানেন না। তবে পিটিশনার, অর্থাৎ আবেদনকারীর পক্ষ থেকে ইসি কার্যালয়ে নোটিশ পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল বলে তিনি শুনেছেন। আদেশ হওয়ার পর ইসির আইন শাখার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বলেও জানান তিনি।

আদেশের পর গতকাল বিকেলে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের কক্ষে কমিশনার রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম, শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী, ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ, ইসির আইন শাখার উপসচিব মতিয়ার রহমান ও উত্তর সিটির রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল কাশেম বৈঠক করেন। সিইসি কে. এম. নুরুল হুদা এ সময় কমিশনে ছিলেন না।

এ বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনার শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী বলেন, আদেশের কপি দেখার পরেই তারা পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। আদালত থেকে কোনো নোটিশ ইসি পেয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুব সম্ভবত না। কারণ, ইসির প্যানেলভুক্ত আইনজীবীকে আগে থেকে কিছু জানানো হয়নি।

এদিকে, নির্বাচন স্থগিতাদেশের পর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, উপনির্বাচন স্থগিত হলেও করপোরেশনে কোনো অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে না। এ জন্য সিটি করপোরেশনের কাজকর্মে ক্ষতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ, ডিএনসিসিতে প্যানেল মেয়র আছেন।

তিনি বলেন, মেয়র ছাড়া এত বড় সিটি চালানো সম্ভব নয়। তাই সঙ্গত কারণে তফসিল ঘোষণা করা হয়। এখানে মন্ত্রণালয়ের কর্তব্য হচ্ছে, মেয়র পদটি শূন্য ঘোষণা করা এবং নির্বাচন কমিশনকে তা অবহিত করা। ভোটার তালিকা, সীমানা নির্ধারণের বিষয়গুলো ইসির কাজ। ইসি সহায়তা চাইলে তা দেওয়া হয়। কিন্তু ইসি তা চায়নি।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচন নিয়ে আইনি অনেক নির্দেশনা পূরণ করা হয়নি। সম্প্রতি এ বিষয়গুলো নিয়ে গণমাধ্যমেও বেশ কথা হয়। সেখানে তফসিল ঘোষণা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ত্রুটিগুলোও তুলে ধরা হচ্ছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন আইনি ভুল শোধরানোর কোনো ব্যবস্থা করেনি। ফলে আইনগত দিক দিয়ে মামলার এই ফল প্রত্যাশিত ছিল।

তার প্রত্যাশা, নির্বাচন কমিশন ভুলগুলো শুধরে নিয়ে পুনঃতফসিল ঘোষণা করতে পারে। তবে তার প্রশ্ন- আইনের সূক্ষ্ণ দিকগুলো বোঝার মতো এবং কমিশনকে উপদেশ দেওয়ার মতো দক্ষতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো আইন কর্মকর্তা ইসিতে আছে কি-না।

আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম সমকালকে বলেন, আদালত যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে রুল জারিসহ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা স্থগিত করেছেন, তা আইন ও দালিলিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, সীমানা নির্ধারণ ও সম্ভাব্য নির্বাচিতদের মেয়াদ নির্ধারণ এবং আগে যারা নির্বাচিত ছিলেন, তাদের কার্যকালের বিষয়টিতে বেশ অসঙ্গতি উল্লেখ করেছেন রিট আবেদনকারীর আইনজীবী। তিনি মনে করেন, এ বিষয়গুলো আদালতে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

http://samakal.com/capital/article/1801917