শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বোরো ধানের বীজতলা কোল্ডইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওষুধ ছিটিয়ে বা অন্যভাবে চেষ্টা করেও কৃষক রক্ষা করতে পারছেন না তাদের বীজতলা। ফলে চলতি মওসুমে বোরো ধান আবাদে চারা সঙ্কট দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। তাদের অভিযোগ মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা তাদের এই দুর্যোগে সে রকম কিছু করছেন না। এমতাবস্থায় বোরো আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক। যদিও স্থানীয় কৃষি অফিস থেকে বলা হচ্ছে, তারা কৃষকদের পাশে রয়েছেন এবং তাদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। শৈত্যপ্রবাহ কেটে গেলেই বীজতলা স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। এতে সার্বিক বোরো উৎপাদনে কোনো প্রভাব পড়বে না বলেও জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা।
যশোর অফিস জানায়, তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশায় যশোরে বীজতলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে জেলায় এবার বোরো ধানের চারার সঙ্কট দেখা দিতে পারে। আবাদও পড়তে পারে হুমকির মুখে। কৃষকরা বলছেন, শৈত্যপ্রবাহ ফলে এ অঞ্চলের বেশির ভাগ বীজতলা কোল্ডইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছে।
সাম্প্রতিক শৈত্যপ্রবাহে যশোরের তাপমাত্রা নেমে আসে ৫-৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। সেইসঙ্গে প্রকৃতি ঢেকে যায় ঘন কুয়াশায়। শীত-কুয়াশায় প্রকৃতি যখন বৈরী হয়ে ওঠে তখন মাঠে রয়েছে বোরোর বীজতলা। তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশা সহ্য করতে পারেনি ধানের চারা। বেশির ভাগ স্থানেই তা নষ্ট হয়ে গেছে কোল্ডইনজুরিতে।
কৃষকেরা বলছেন, বিগত আমন মওসুমে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে তারা লাভের মুখ দেখতে পারেনি। বোরো আবাদ করে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতেই তাই তারা ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়। গত বছরের চেয়ে বেশি দামে ধান বীজ কিনে বীজতলা তৈরি করেন তারা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাপমাত্রার এ বিরূপ প্রভাবে ধান চাষ নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। বীজতলা নষ্ট হওয়ায় দ্বিতীয় দফা চারা তৈরি নিয়ে শঙ্কিত চাষি।
এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কাজী হাবিবুর রহমান বলেন, জেলায় এ বছর ১ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ধান আবাদকে টার্গেট করে কৃষকরা বীজতলা তৈরি করেছেন। ইতোমধ্যে কিছু এলাকায় ধান রোপণের কাজও শুরু করেছেন কৃষক। তবে সাম্প্রতিক শৈত্যপ্রবাহে কিছু কিছু বীজতলা নষ্ট হলেও বেশির ভাগ এলাকার কৃষক কোল্ডইনজুরি থেকে রক্ষা পেতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি বলেন, এ বছর বোরো আবাদকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। জেলার অধিকাংশ এলাকায় কৃষক আদর্শ বীজতলা তৈরি করেছেন। যারা আদর্শ বীজতলা তৈরি করেছেন তাদের ক্ষতি কম হচ্ছে।
তিনি বলেন, বীজতলাকে কোল্ডইনজুরি থেকে রক্ষা করতে কৃষককে জমিতে সেচ এবং পলিথিং দিয়ে বীজতলা ঢেকে রাখার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, দুই-এক দিনের মধ্যে তাপমাত্রা বাড়লে কৃষকের চিন্তার কোনো কারণ থাকবে না।
খানসামা (দিনাজপুর) থেকে সংবাদদাতা জানান, প্রতিদিন ঘন কুয়াশা, প্রচণ্ড শীত ও হিমেল বাতাসে কাঁপছে খানসামা উপজেলা। আর এ কারণে কোল্ডইনজুরিতে পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বীজতলার বোরো ধানের চারা। গত কয়েক সপ্তাহে শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশায় চার দিক ঢাকা ছিল। বৈরী আবহাওয়ার কারণে বীজতলায় ধানের চারা হলুদ বর্ণ হয়ে মরে পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ডাঙ্গাপাড়ার পাঁচপীর ও দেবীডুবা দলবাড়ির বীজতলায়, আঙ্গারপাড়ার বেলান নদীর বীজতলা,মানিকগঞ্জ বাজারের ইছামতি নদীর বীজতলা, কাচিনিয়ার বীজতলাসহ উপজেলায় বিভিন্ন বীজতলায় কোল্ডইনজুরি ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছে।
ডাঙ্গাপাড়ার কৃষক সামিউল ইসলাম বলেন, আমি পাঁচ ধারা ২৮ ধানের বীজধান ছিটিয়ে বীজতলা তৈরি করেছি। ধানের চারা এবার ভালোই হয়েছিল কিন্তু কুয়াশার কারণে অনেক চারা হলুদ বর্ণ হয়ে পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ওষুধ প্রয়োগ করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। কৃষি কর্মকর্তারা কেউই কোনো পরামর্শ দিতে মাঠে নেই বলে তিনি অভিযোগ করেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আফজাল হোসেন জানান, ধানের বীজ তলা কোল্ডইনজুরিতে আক্রান্ত হলে বীজতলার পানি প্রতিদিন পরিবর্তন করে নতুন পানি প্রবেশ করাতে হবে। সম্ভব হলে রাতে বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা সম্ভব না হলে সকালে বীজতলায় রশি টেনে শিশির ঝেড়ে ফেলতে হবে। আবার ইউরিয়া ও জিপসাম সীমিত পরিমাণে দেয়া যেতে পারে। শীতে বীজতলা হলুদ বর্ণ ধারণ করলে চাষিদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। আবহাওয়া অনুকূলে এলে এ সমস্যা বীজতলা কাটিয়ে উঠবে।
আগৈলঝাড়া (বরিশাল) সংবাদদাতা জানান, শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশার কারণে মওসুমের শুরুতেই বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলায় বোরো ধানের কোল্ডইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন চাষিরা।
জানা গেছে, উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে চলতি ইরি-বোরো মওসুমে ১০ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত বছরের চেয়ে চলতি বছর ১৫ হাজার ৬৬৩ মেট্রিক টন চাল বেশি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসেই কৃষকেরা বিভিন্ন ধানের বীজতলা তৈরি করে থাকেন। যা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে জমিতে রোপণ করার কথা রয়েছে। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে অব্যাহত শৈত্যপ্রবাহ ও ঘনকুয়াশার কারণে ধানক্ষেত হলুদ বর্ণ ধারণ করে নষ্ট হওয়ার পথে। অনেক কৃষক তাদের নিচু জমিতে ভালো ফলন পাওয়ার আশায় ইতোমধ্যেই আগাম ইরি-বোরো ধানের চারা রোপণ করেছেন। কয়েক দিনের শৈত্যপ্রবাহের কারণে কোল্ডইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে অনেক চারা নষ্ট হয়ে গেছে।
উপজেলা কৃষি অফিসের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র মণ্ডল জানান, কোল্ডইনজুরিতে আক্রান্ত রোপিত ধানের সঠিক কোনো হিসাব তাদের কাছে নেই।