১৮ জানুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৮:৩০

রোহিঙ্গাদের এখনই ফেরৎ পাঠানোয় অ্যামনেস্টির আপত্তি

বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রত্যাবাসনের জন্য ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু চুক্তির পরও তাদের ফিরে যাওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। এ দিকে রোহিঙ্গাদের এখনই ফেরৎ পাঠানোয় আপত্তি জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটি মনে করছে, মিয়ানমারে নীতির পরিবর্তন না হলে নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সেখানে ফেরৎ পাঠানো নিরাপদ হবে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার জাতিসংঘকে রাখতে চায় না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক।

গত মঙ্গলবার সকালে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে দুই দেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম সভায় চুক্তিটি চূড়ান্ত হয়। গত সোমবার ওই সভা শুরু হয়। বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রসচিব এম শহীদুল হক ও মিয়ানমারের পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির পার্মানেন্ট সেক্রেটারি মিন্ট থো।
চুক্তির পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি বাংলা। তারা বলছে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক জানিয়েছেন, চুক্তি অনুযায়ী মিয়ানমার প্রতিদিন তিনশ করে প্রতি সপ্তাহে ১৫শ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে এবং দুই বছরের মধ্যে এই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শেষ করা হবে। তবে কবে থেকে এই প্রত্যাবাসন শুরু হবে, সেটি এখনও নিশ্চিত নয়।

গত বছর ২৫শে আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর এক অভিযান শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ছয় লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। তাদের কাছে শোনা গেছে হত্যা, ধর্ষণ, ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ভয়াবহ সব বর্ণনা।
জাতিসংঘ একে এথনিক ক্লেনজিং বা জাতিগত নির্মূল অভিযানের একটি দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেছে। মিয়ানমার অবশ্য তা অস্বীকার করেছে। এর পর ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এই রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নেবার জন্য বাংলাদেশ-মিয়ানমার আলোচনা শুরু হয় নভেম্বর মাসে। তবে এই চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে প্রধান সংশয় রয়েছে চারটি, বলছেন বিশ্লেষকরা।
চুক্তিতে কী আছে?
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকে বলেছেন, চুক্তিতে কি আছে তা নিয়ে তারা তেমন কিছুই জানেন না। বিবিসির সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, দু দেশই একমত হয়েছে যে এই প্রত্যাবাসন হবে স্বেচ্ছামূলক। মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব উ মিন্ট থু বলেছেন, প্রত্যাবাসন শুরু হবে ২৩শে জানুয়ারি।
পরিস্থিতি কি নিরাপদ?

মানবাধিকার সংস্থা এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গবেষক লরা হাই বলছেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের ফিরে যাবার মতো নিরাপদ নয়। বিবিসির সংবাদদাতা জোনাথন হেড বলেন, রোহিঙ্গারা বলছে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে, বাড়িঘর পুনর্নির্মাণ হলে এবং নিপীড়ন বন্ধ হলেই তারা মিয়ানমারে ফিরবে। তবে তেমন অবস্থা এখনো তৈরি হয় নি।
ত্রাণ সংস্থাগুলোরও এ নিয়ে গভীর সংশয় রয়েছে।
ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ এবং মানবাধিকার কর্মী রোজেনা এলিন খান বলছেন, উপযুক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো মানে তাদের মৃত্যুর মুখে আবার ঠেলে দেয়া।
রোহিঙ্গারা কি কখনো নাগরিকত্ব পাবে?

রোহিঙ্গা নেতা সিরাজুল মোস্তফা বলছেন, আমাদের প্রথম চাওয়া হলো নাগরিকত্ব। এটা কি কখনো হবে? বৌদ্ধ প্রধান মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয় না, এবং তাদের ২০১৪ সালের জনগণনাতেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাদেরকে আসলে মিয়ানমারের বাসিন্দা বলেই স্বীকার করা হয় না। তাদের বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী বলে মনে করা হয়। নতুন চুক্তিতেও তাদের নাগরিকত্ব পাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
বাংলাদেশও তাদের স্বীকৃতি দিচ্ছে না। শরণার্থী শিবিরে জন্মানো শিশুদের জন্মের সনদপত্র দেয়া হচ্ছে না। সিরাজুল মোস্তফার কথা, তাদেরকে আমাদের জমি ফিরিয়ে দিতে হবে।
রোহিঙ্গাদের এখনই ফেরত পাঠানো নিরাপদ হবে না: রোহিঙ্গাদের এখনই ফেরত পাঠানোয় আপত্তি জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটি মনে করছে, মিয়ানমারে নীতির পরিবর্তন না হলে নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সেখানে ফেরত পাঠানো নিরাপদ হবে না।
মঙ্গলবার নেইপিদোতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে চুক্তি সই হয়। এর পরই উদ্বেগ জানিয়ে এক বিবৃতিতে এ আপত্তির কথা জানায় সংস্থাটি।

অ্যামনেস্টির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক পরিচালক জেমস গোমেজ বিবৃতিতে বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মনে এখনও ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের দগদগে ক্ষত থাকায় তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা উদ্বেগ সৃষ্টির মতো ‘অপরিণত সময়ে নেয়া পদক্ষেপ’। গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারে নিপীড়নের মুখে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে আরও প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা।
অ্যামনেস্টি বলছে, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই ওই সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং তারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফেরত যেতে পারবেন এমন কোনো নিশ্চয়তাও দেয়া হয়নি। এত দ্রুত রোহিঙ্গাদের ফেরা ‘ভয়ানক ভবিষ্যতের’ মুখে তাদের ফেলতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হবে স্বেচ্ছায়। যারা চাইবেন তাদেরই মর্যাদা ও নিরাপত্তার সঙ্গে ফেরত পাঠানো হবে। গত ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের সঙ্গে প্রথম চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ কথা বলা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই।
তবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরা এবং সেখানে বসবাসের অধিকার রয়েছে। তবে বিদ্বেষপূর্ণ একটি ব্যবস্থায় লোকজনকে পাঠাতে তাড়াহুড়া করা যাবে না। জোরপূর্বক কাউকে ফেরত পাঠানো আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হবে। বিদ্বেষপূর্ণ ব্যবস্থার অবসান এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জবাবদিহিসহ মিয়ানমারে মৌলিক পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত সেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরা নিরাপদ বা মর্যাদাপূর্ণ হতে পারে না।
জাতিসংঘকে নয়, রেডক্রসকে চায় মিয়ানমার: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার জাতিসংঘকে রাখতে চায় না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক। মিয়ানমার রেডক্রসের সঙ্গে বসতে চায়। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ চুক্তি চূড়ান্ত করা শেষে দেশে ফিরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তিনি এসব জানান পররাষ্ট্রসচিব।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রস্তাব অনুযায়ী জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারকে (ইউএনএইচসিআর) রাখতে চায় না মিয়ানমার। তারা চায় রেডক্রসকে সম্পৃক্ত করতে।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার বাংলাদেশে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হলেও নানা কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। একের পর এক অযুহাত দেখিয়েই যাচ্ছে মিয়ানমার।

প্রসঙ্গত গত বছরের ২৩শে নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে চুক্তি সই হয়। চুক্তি হলেও এখনো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় গড়িমসি চলছেই।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে হামলা শুরুর পর ইতিহাসের ভয়াবহতম এ জাতিগত নিধন শুরু করলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা। তাদের কক্সবাজারের উখিয়ায় আশ্রয় দেওয়া হলেও শুরু থেকেই বাংলাদেশের দাবি ছিল, নিরাপদে মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে হবে।
জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত আসছেন আজ: নিপীড়নের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে আসছেন জাতিসংঘের স্পেশাল র্যা পোর্টিয়ার (বিশেষ দূত) ইয়াংহি লি।
বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে ১৩ দিনের সফরের অংশ হিসেবে আজ বৃহস্পতিবার তিনি ঢাকায় পৌঁছাবেন বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
অং সান সু চির সরকার তার সঙ্গে অসহযোগিতা কথা ও তাকে মিয়ানমারে ঢুকতে দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর নিজের দায়িত্ব পালনে প্রতিবেশী এই দুই দেশ সফর করছেন তিনি।

ইয়াংহি লি সাত দিনের সফর শেষে ২৪ জানুয়ারি থাইল্যান্ড যাবেন এবং ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত সেখানে থাকবেন। লি তার বাংলাদেশ সফরের বেশির ভাগ সময় কাটাবেন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে।
সফর শুরুর আগে তিনি বলেছেন, আমাকে মিয়ানমারে ঢুকতে না দিয়ে এবং দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা না করে আমার কাজকে আরও কঠিন করে তোলা হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার থেকে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে সম্ভাব্য সব উপায়ে আমি তথ্য সংগ্রহ করব। আমার ওপর অর্পিত দায়িত্বের অংশ হিসেবে মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিপীড়নের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের সহযোগিতা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে তা পালনে আমি অঙ্গীকারবদ্ধ।
মিয়ানমারকে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে ইয়াংহি লি বলেন, নিপীড়িতদের পক্ষে কথা বলা আমার দায়িত্ব। আমি আমার দায়িত্ব পালন থেকে বিচ্যুত হব না।
সফরে প্রাপ্ত তথ্য মার্চ মাসে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে উপস্থাপন করবেন ইয়াংহি। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ ২০১৪ সালে তাকে স্পেশাল র্যা পোর্টিয়ার পদে নিয়োগ দেয়।

http://www.dailysangram.com/post/315641