১৭ জানুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ১০:১০

‘নির্বাচনকালীন সরকার’ প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রী এমপি পদ ও সংসদ বহাল রেখেই?

সরদার আবদুর রহমান : সংবিধানে চলমান জাতীয় সংসদ, দলীয় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভা এবং বর্তমান এমপি পদ বহাল রেখেই ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ প্রতিষ্ঠার করতে চাচ্ছে সরকার। আর নির্বাচনের প্রাক্কালে কোনপ্রকার ‘সহায়ক সরকার’ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের কোন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোন নিশ্চয়তা আদৌ না থাকায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

সরকারের সর্বশেষ এই মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত শুক্রবারের জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে। এসময় তিনি বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষদিকে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কীভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা আমাদের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। সেই সরকার সর্বতোভাবে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা দিয়ে যাবে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর সে নির্বাচন ‘সংবিধান অনুসারেই’ অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দেন, সংবিধান মেনে, অর্থাৎ তার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই চলতি বছর শেষে একাদশ জাতীয় নির্বাচন হবে। প্রধানমন্ত্রী জানান, ২০১৩ সালের মতই নির্বাচনের আগে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের মাধ্যমে একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ গঠন করা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর উল্লিখিত ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ সম্পর্কে সংবিধানে কোনপ্রকারের বিধানই নেই। ফলে তিনি সংবিধানেরই রেফারেনস দিয়ে কীসের ভিত্তিতে এই প্রক্রিয়া কথা বললেন তা বিশ্লেষকদের বোধগম্য হয়নি। তাহলে তাঁর কথার কি এই অর্থ দাঁড়াচ্ছে যে, বর্তমান দলীয় সরকার অর্থাৎ মহাজোট সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে? প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ হওয়ার বিষয়েও কোন নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়নি।

সংবিধানের বিধান যা বলে : বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা বাতিলের পর যে সংশোধনী সংযোজিত হয়েছে তাতে বিদ্যমান সংসদ ও মন্ত্রীসভা পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ ও মন্ত্রীসভা দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত বহাল থাকবে। যদি রাষ্ট্রপতি পূর্বেই তা ভেঙে না দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ আসন্ন যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে তাতে চলমান জাতীয় সংসদ, দলীয় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভা এবং বর্তমান এমপিগণের পদ বহাল থাকছেই। এবিষয়ে সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই অযোগ্য করিবে না।’ আর ৫৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদ ভেঙ্গে যাওয়া অবস্থায় যেকোন সময়ে কোন মন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকতে এই অনুচ্ছেদের (১) দফার (ক), (খ) ও (ঘ) উপ-দফার কোন কিছুই অযোগ্য করবে না। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিলে বা স্বীয় পদে বহাল না থাকিলে মন্ত্রীদের প্রত্যেকে পদত্যাগ করেছেন বলে গণ্য হবে; তবে এই পরিচ্ছদের বিধানাবলী-সাপেক্ষে তাঁদের উত্তরাধিকারীগণ কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তাঁরা স্ব স্ব পদে বহাল থাকবেন।’
এছাড়া সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে (ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গে যাবার ক্ষেত্রে ভেঙ্গে যাবার পূর্ববর্তী নববই দিনের মধ্যে এবং (খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভেঙ্গে যাবার ক্ষেত্রে ভেঙ্গে যাবার পরবর্তী নববই দিনের মধ্যে। তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।’

প্রধানমন্ত্রী ‘সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে’ বলে তাঁর যে নীতিনির্ধারণী বক্তব্য দিয়েছেন তাতে মনে হতে পারে যে, সংবিধানে সে ব্যবস্থা হয়তো বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু ভাষ্যকাররা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর এ ভাষণের পর সংবিধান খুঁজে কোথাও নির্বাচনকালীন সরকার গঠন সম্পর্কে কোন অনুচ্ছেদ বা উপ-অনুচ্ছেদ পাওয়া যায়নি। কীভাবে কোন সূত্রে প্রধানমন্ত্রী এই কথা বললেন সে কথাও পরিষ্কার হয়নি। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রীসভা গঠন ব্যতিত কোন বিকল্পও দেখা যাচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন পর্যবেক্ষগণ।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সর্বসাম্প্রতিক ভাষণে ২০১৩ সালের মতই নির্বাচনের আগে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের মাধ্যমে একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন। তাঁর এই ঘোষণা মোতাবেক সম্ভাব্য যেটুকু করা হতে পারে তা হলো, এই নির্বাচনকালীন সময়ে জাতীয় সংসদ বহাল থাকলেও অধিবেশন বসবে না। মন্ত্রীসভা থাকবে, তবে কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেবে না। কিন্তু পর্যবেক্ষরা বলছেন, ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের সময় যে অভিজ্ঞতা জাতি অর্জন করেছে তাতে এধরণের নির্বাচনকালীন দলীয় সরকারের অতি উৎকট রূপেরই প্রকাশ ঘটেছে।

এটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নয় : রাজনৈতিক মহলের অভিযোগ, মহাজোটের শাসন ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে সংবিধানকে ইচ্ছেমত কাটাছেড়া করার পর এখন এই সংবিধানের দোহাই দেয়া হচ্ছে। অথচ সরকার যদি নিজেদের সুবিধার পথ সুগম রাখার জন্য সংবিধানে ব্যাপক রদবদল ঘটাতে পারে তাহলে বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতার স্বার্থে সামান্য পরিবর্তন মেনে নিতেই পারে। এদিকে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার বাস্তবায়ন ঘটলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপিদের নিজ নিজ পদে বহাল রেখেই আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ বর্তমান সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী পরিষদ সদস্যদের আসন শূন্য ঘোষণা না করেই বর্তমান সংবিধানের বিধান অনুযায়ী তিনশ’ আসনে নির্বাচন করতে হবে। আর এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে সংসদের মেয়াদ শেষের ৯০ দিন আগে। নতুন সংসদের নির্বাচিত সদস্যরা আগের সংসদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্বও নিতে পারবেন না। এমতাবস্থায় নির্বাচনের তফশীল ঘোষণা এবং তার পরেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীগণ, প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীগণ স্ব স্ব পদে বহাল থাকবেন, আইন প্রয়োগ করবেন, পুলিশ-র্যা বকে হুকুম দেবেন, প্রশাসনে রদবদল করবেন, সমগ্র প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করবেন, উন্নয়ন কাজে অর্থ বরাদ্দ করবেন এবং সেগুলোর উদ্বোধন করবেন, ত্রাণ বিতরণ করবেন ইত্যাদি। প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কাজের অসিলায় তাঁরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় যাবেন, বক্তব্য দেবেন, মিডিয়ায় প্রচারের অগ্রাধিকার পাবেন। এসব কাজ নিশ্চয়ই সামগ্রিক নির্বাচনী আবহ ও পরিবেশকে প্রভাবিত করবে। সংবিধানের বিধানের জোরেই তাঁরা এসব কাজ অব্যাহত রাখবেন। অন্যকোন বিষয়ই তাঁদেরকে এ থেকে বিরত রাখতে পারবেনা।

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য ভারতসহ বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু ভারতের সংবিধানে অনির্বাচিত ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া ভারতের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার পর। যে কারণে সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন, রাষ্ট্রপতি তখন প্রধানমন্ত্রীকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনার অনুরোধ জানান। তবে ওই সরকার দৈনন্দিন কাজ ছাড়া নীতি-নির্ধারণীমূলক কোন কাজে অংশ নেয় না। এটা মূলত কেয়ারটেকার সরকারই। এছাড়া নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত সকল সরকারি কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনের অধীন থাকে। এই সরকারকে ভারতের আদলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলারও কোন সুযোগ নেই। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশেই নির্বাচন পরিচালনা করে থাকে একটি কেয়ারটেকার কিংবা অন্তর্বর্তী অথবা অস্থায়ী সরকার। কিন্তু বাংলাদেশের মহাজোট সরকার আগামী জাতীয় নির্বাচন করতে যাচ্ছে ¯্রফে একটি দলীয় সরকারের অধীনে। এর সঙ্গে গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের কোন মিল পাওয়া যাবে না বলেও পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।

লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড-এর প্রশ্ন : জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলো একটি দেশের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। সব বৈধ রাজনৈতিক দল ও সকল বৈধ ভোটার তথা নাগরিক অবাধে এই প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারেন। এজন্য প্রয়োজন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তথা সমতল নির্বাচনী মাঠের। এটি নিছক কোন শ্লোগান নয়- একটি অপরিহার্য বিষয়। পর্যবেক্ষরা বলে আসছেন, সংসদ বহাল থাকলে এবং এমপি পদ অব্যাহত থাকলে তা হবে নির্বাচনী মাঠের জন্য এক অসম অবস্থা। একজন নির্বাচিত ব্যক্তি হিসেবে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নির্বাচনী মাঠে থাকবেন এবং অন্য প্রার্থীরা তার বিপরীত অবস্থানে থেকে নির্বাচন করবেন। এতে কী করে নির্বাচনী মাঠ সমতল হবে- সে প্রশ্নও উঠছে।
সংবিধান ও প্রচলিত রীতি অনুযায়ী দেশের রাষ্ট্রপতি তাকেই প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন যিনি বিদ্যমান সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন হন। কিন্তু সংসদ ভেঙে গেলে তো প্রধানমন্ত্রী আর সেই সংসদের আস্থাভাজন থাকার প্রশ্ন আসে না। এছাড়া যে সকল মন্ত্রী নির্বাচনকালে বহাল থাকবেন সংসদ কার্যকর না থাকার কারণে তারাও আর নির্বাচিত বলে গণ্য হবেন না। ফলে ‘নির্বাচিত’ সরকারের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ধারণারও কোন যুক্তি নেই। সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ যেহেতু সংবিধানেই বিদ্যমান রয়েছে ফলে এই কার্যকর করতেও কোন সমস্যা দেখা যাচ্ছে না। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়ররা পদত্যাগ করেই নির্বাচন করেন। সেখানে কোন সমস্যাও হয় না। তাহলে সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমস্যা কেন হবে- সে প্রশ্ন তুলছেন রাজনীতির বিশ্লেষকরা।

http://www.dailysangram.com/post/315516