১৭ জানুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ১০:০৫

অধিকার রক্ষায় আমাদের জয়ী হতে হবে

হার্ভার্ড প্রফেসর Steven Levitsky ও Daniel Ziblatt-এর অতি সাম্প্রতিক ‘HOW DEMOCRACIES DIE’ নামের বইটির প্রসঙ্গ টেনে আজকের লেখাটি শুরু করা শ্রেয় মনে করছি। বইটিতে যে ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে তা হল, সামরিক শাসন বা বিপ্লবের মাধ্যমে গণতন্ত্রের যত না মৃত্যু হয়, তার চেয়ে বেশি মৃত্যু হয় তাদের হাতে যারা প্রাথমিকভাবে নির্বাচনের পথে ক্ষমতায় আসে। বইটির রচয়িতারা বিভিন্ন দেশের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, Democratic backsliding today begins at the ballot box, অর্থাৎ বর্তমান সময়ে নির্বাচনী কারসাজি করেই গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটানো হচ্ছে।
পাঠকরা দেখবেন কীভাবে আমাদের দেশে একই নিয়মে ব্যালট বক্স কারসাজি করে গণতন্ত্রের পতন ঘটানো হচ্ছে। যার যা মুখে আসছে, তা-ই বলে যাচ্ছে; কিন্তু সত্য সত্যই থাকবে। আমাদের দেশেও প্রথমে যারা নির্বাচনী পন্থায় ক্ষমতায় এসেছিলেন, তাদের দ্বারা গণতন্ত্র বিপদগ্রস্ত হয়েছে।

স্বাধীনতা অর্জনের সময় যেমন আমাদের সম্মিলিতভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে হয়েছিল, ঠিক তেমনি নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায়ও আমাদের সম্মিলিত সাহস ও চারিত্রিক দৃঢ়তা দেখাতে হবে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমরা একযোগে সেই সাহস দেখাতে পারছি না এবং শোচনীয়ভাবে ব্যর্থতার স্বাক্ষর রেখে চলেছি। আমরা অধিকার সচেতন নই বলেই সর্বত্র দায়িত্বহীনতা ও নীতিহীনতা বেড়েই চলেছে। বেড়ে চলেছে জনগণের অসহায়ত্ব ও নিরাপত্তাহীনতা। সরকারও দায়িত্ব সচেতন থেকে কোনো তাগিদবোধ করছে না। ক্ষমতাসীনদের কাছে নীতিহীন চাটুকাররাই দেশের সবকিছু। মানিক মিয়ার ভাষায়, ‘ভদ্রলোকরা দরজা বন্ধ করে ভদ্রতা রক্ষা করে চলছে।’
একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র আমরা দিয়েছিলাম। ব্যক্তিস্বাধীনতাও নিশ্চিত করা হয়েছিল। এখন সবকিছুই হারাতে বসেছি। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার শাসনতান্ত্রিক ভারসাম্যতাও ভাঙা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতাও বাধাগ্রস্ত করা হল। জনগণের জন্য কতটা গণতন্ত্র অবশিষ্ট আছে এবং কত শিগগির সেটুকুও উধাও হয়ে যাবে, তা নিয়েই আমাদের যত উদ্বেগ। আসছে সাধারণ নির্বাচন কতটা স্বাধীন হবে বা কতটা সংঘাতময় হবে, তা নিয়েও জনমনে দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতার যে ক্ষতি হয়েছে, সেটা গভীর উৎকণ্ঠার বিষয়। কারণ এ ক্ষতি সবাইকে স্পর্শ করবে। এর সূচনা হয় প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে, যাকে বিব্রতকর অবস্থায় বিদেশে গিয়ে ইস্তফা দিতে হয়। তার বিরুদ্ধে কত মামলার কথা শোনানো হল। এখন সবাই নীরব।

বিচার বিভাগ হচ্ছে গণতন্ত্র ও সুশাসনের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। শাসনতন্ত্র আমাদের যেসব অধিকারকে অলঙ্ঘনীয় করেছে, সেসবের প্রয়োগ নিশ্চিত করে থাকে স্বাধীন বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে শাসনতন্ত্র রক্ষার অভিভাবক হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। সেই বিচার বিভাগের ক্ষমতা ও মর্যাদা সম্পর্কে সরকারের কোনো ভাবনা নেই।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে কোথাও কোনো গণতান্ত্রিক সরকার সংঘাতে যায় না, কারণ আইনের শাসন এবং আইনানুগ বিচারের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এ স্বাধীনতা অপরিহার্য। অধস্তন আদালত সম্পর্কিত নীতিমালা সুপ্রিমকোর্ট এক চরম অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে মেনে নিয়েছে এবং সরকারের এ লক্ষ্য সহজেই পূরণ হয়েছে, বেশি বেগ পেতে হয়নি। এখন নিন্ম আদালতগুলো কার্যত আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে এসে গেছে। আইনমন্ত্রী যথার্থই বলে দিয়েছেন, সুপ্রিমকোর্টের জন্য স্বতন্ত্র সেক্রেটারিয়েট প্রয়োজন নেই।
আবুল কাশেম ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতারা কখনও বিচার বিভাগকে খাটো করে দেখেননি। কারণ তারা জানতেন বিচার বিভাগ দুর্বল হলে সরকার দুর্বল ও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। দুর্নীতিপরায়ণরা বেশি মাত্রায় দুর্নীতি করার স্বাধীনতা পেয়ে যায়।
আমলাতান্ত্রিক সরকার এভাবেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে। যাকে আমরা বেসামরিক পোশাকে সামরিক শাসনের সঙ্গে তুলনা করতে পারি।

রাজনীতিকরা চালিত হবেন, নেতৃত্ব দিতে পারবেন না। এরকম পরিস্থিতিকে জনগণের শক্তির জনপ্রতিনিধিত্ব বলা যাবে না। রাজনীতিকদের শক্তি ও নেতৃত্ব নির্ভর করে জনসমর্থনের শক্তির ওপর। জনসমর্থনপুষ্ট সরকারকে অবশ্যই সহনশীল হতে হয়। রাজনৈতিক সমঝোতা করে দেশে হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে হয়।
দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও হিংসা-প্রতিহিংসার অসহনশীল রাজনীতির কারণে অবাধ নির্বাচনের বিষয়টি যে অত্যন্ত জটিল হয়েছে, তা আমরা সবাই বুঝি। এ সমঝোতা শুধু বিএনপির সঙ্গেই হতে হবে, তা বলছি না। ভবিষ্যৎ রাজনীতির ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনসহ অন্যদের নিয়েও জাতীয় সমঝোতা তৈরি হতে পারে। আমরা নির্বাচন চাচ্ছি দেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক নিয়মকানুন ও সহনশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য। নির্বাচন-পরবর্তী অবস্থায় যাতে প্রতিহিংসার নৈরাজ্য সৃষ্টি না হতে পারে, তা-ও সমঝোতার মাধ্যমে রোধ করা সম্ভব।

শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, দেশ শাসনের ব্যাপারেও ভয়ভীতি ও আতঙ্কের যে পরিস্থিতি গড়ে উঠেছে, তারও অবসান হতে হবে। কোনো কোনো সংবাদপত্রের মনোভাব এরকম যে, কাউকে পুলিশ সন্ত্রাসী বললে তাকে ক্রসফায়ারে দিতে বাধা নেই। তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া যাবে না। অর্থাৎ বিচারের আগেই তাকে সন্ত্রাসী বলে শাস্তি দিতে হবে। অন্যের শাসনতান্ত্রিক অধিকারগুলোকে তুচ্ছ করে দেখার প্রবণতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এভাবেই দেশে অন্যায়-অবিচার করার সাহস বাড়ছে। দেশ শাসনের ক্ষেত্রে সৃষ্ট সংকট রাজনৈতিকভাবে বা সুবিচারের মাধ্যমে সমাধান করতে হয়। শুধু পুলিশি ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে নয়। ভিন্নভাবে হলে কিন্তু নেতৃত্ব চলে যাবে অন্যদের হাতে। আমলাতান্ত্রিক বুদ্ধি-পরামর্শ থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ এখনও রাজনীতিকদের পক্ষে নেয়া সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস।
বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে যে ধরনের আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হল, তা রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য একেবারেই সহায়ক হবে না। মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য যে মূল গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গৃহীত হয়, সে শাসনতন্ত্রের ১১৬ অনুচ্ছেদে নিন্ম আদালতের নিয়োগ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুর এবং শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করার ভার ছিল সুপ্রিমকোর্ট এবং একমাত্র সুপ্রিমকোর্টের ওপর। কিন্তু এখন যে নীতিমালা তৈরি করে সুপ্রিমকোর্টের অনুমোদন নেয়া হল, সেখানে এসব ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে এবং তিনি এসব ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োগ করবেন। ১১৬ অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রে সামরিক সরকার যে পরিবর্তন এনেছিল, তার ওপর নির্ভর করে এ নতুন নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে।

যদিও শাসনতন্ত্রের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অধস্তন বিচার বিভাগের ওপর সুপ্রিমকোর্টের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা বহাল রয়েছে। তবে আলোচ্য অনুচ্ছেদটির ব্যাখ্যা সুপ্রিমকোর্ট কীভাবে করবে, তার ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দিয়ে মাসের পর মাস বিচার ব্যবস্থা চালানোর অদ্ভুত দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। মোটকথা, বিচার বিভাগকে গুরুত্ব না দেয়াটা রেওয়াজে পরিণত হতে যাচ্ছে। অবশ্য বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের বিরোধ ও সংঘাতের সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে।
শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের শাসনতান্ত্রিক দাবি পূরণে সময় লাগে ৩৫ বছর এবং এ মহতী কাজটি করা হয় ২০০৭ সালের সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে।
স্বাধীন বিচার বিভাগকে কোনো রাজনৈতিক সরকার সহ্য করার সদিচ্ছা দেখায়নি; কারণ অনুগত বিচার ব্যবস্থা ছাড়া আমলাতান্ত্রিক সরকার চলতে পারে না। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করেই গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটানো হয়।
নির্বাচনকালীন অনির্বাচিত তদারকি সরকার শাসনতন্ত্রের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী- এ যুক্তিতে যদি তা বাতিল করা হয়ে থাকে, তাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করাটাও শাসনতন্ত্রের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। অথচ এ বিষয়টি সরকার বিবেচনায় নিচ্ছে না।

এভাবে সরকারের আশপাশের সুবিধাবাদীদের কাছে চিন্তা ও কর্মের সঙ্গতি রক্ষা মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন রাখতে পারলেই তাদের লাভ।
দেশ স্বাধীন করে আমরা একের পর এক যেভাবে গণতান্ত্রিক অধিকার হারিয়েছি, তার জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা আমাদের মধ্যকার কিছু লোকের লাগামহীন লোভ-লালসা সুস্থ চিন্তার পরিবেশকে দূষিত করেছে। দুর্নীতির যারা শীর্ষে, তারাই আজ অবাধ নির্বাচনের ব্যাপারে সর্বাধিক শঙ্কিত। এ ব্যাপারে কোনোরূপ ছাড় দিতে সরকারের সুবিধাবাদীরা একেবারেই রাজি নয়। অবাধ নির্বাচন থেকে জনগণকে বঞ্চিত করলে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। সরকারের পক্ষে সবাইকে নিয়ে রাজনৈতিক সহিংসতার বিরুদ্ধে সমঝোতা সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা সরকারকেই পালন করতে হবে। সেটাই হবে রাজনৈতিক সরকারের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। কিন্তু সেটা আশা করার সুযোগ কোথায়? ক্ষমতাসীন সরকার ক্ষমতা ছাড়ার জন্য নির্বাচন দেবে না।
মুষ্টিমেয় নীতিহীনদের কারণে আমরা সমগ্র দেশবাসীর জন্য সংঘাতময় দুর্যোগ বয়ে আনতে পারি না। আমরা সবাই যে এক ভয়ংকর অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি, তা কারও পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। অন্যায়-অবিচারের কাছে আমরা যতই অসহায় হচ্ছি, ততই অন্যায়-অবিচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনগণের অধিকার ও সার্বভৌম সত্তার মর্যাদা রক্ষায় আমাদের সম্মিলিত সাহস ও চারিত্রিক দৃঢ়তার প্রমাণ রাখতে হবে।

সবাই মিলে শান্তি ও নিরাপদে বসবাস করার পরিস্থিতি সহজেই সৃষ্টি করা সম্ভব। রাজনীতিকদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে তাদের ইট-সুরকির মেগা প্রকল্পের ওপর নির্ভর না করে জনগণের ওপর নির্ভর করে জননেতা হতে মনোযোগী হতে হবে। মানুষের সুখ-শান্তি বিধানে যোগ্যতা দেখাতে হবে। জনগণ যে তাদের সার্বভৌম ভোটাধিকার স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করার ক্ষমতা রাখে, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন হবে তারই অগ্নিপরীক্ষা।
গণতন্ত্র রাজনীতিকদের জন্য নয়, গণতন্ত্রের রক্ষক রাজনীতিকদের হতে হবে, তা-ও নয়। গণতন্ত্র জনগণ প্রদত্ত জনগণের স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা। জনগণের সেবক হতে পারাটাই একজন সত্যিকার রাজনীতিকের পরম সাফল্য। রাজনীতি কারও রাজত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয় নয়। তাই অন্যান্য দলের কাতারে এসে একই সমতলে অবস্থান নিয়ে সরকারের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নিতে ভয় পাওয়ার অর্থ জনগণকে ভয় পাওয়া। এতে লজ্জা আছে, বাহাদুরি নেই।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ

https://www.jugantor.com/todays-paper/window/7749