১৬ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ৬:১৭

সমঝোতা ছাড়া বিকল্প নেই

নির্বাচন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত

সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকারের কোনো বিধান নেই জানিয়ে সংবিধানবিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, যে ফর্মুলাতেই করা হোক না কেন, রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে আস্থায় নিয়ে সমঝোতার মাধ্যমেই নির্বাচন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। সে জন্য দুই দলের সংলাপ বা সমঝোতা খুবই জরুরি। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে যেমন আন্তরিক হতে হবে, তেমনি বিএনপিকেও নমনীয় হতে হবে। না হলে দেশের রাজনৈতিক, আর্থিক ও কূটনৈতিক সঙ্কট আরো ঘনীভূত হবে। নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে তারা এসব কথা বলেন।
রাজনৈতিক দলগুলো দেশের এবং নিজেদের স্বার্থে সমঝোতায় আসবে বলে আশা প্রকাশ করে তারা বলেন, রাজনৈতিক কারণে বর্তমানে দুই দলই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলেও ভোটের সময় ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে উভয় দলের মধ্যে বরফ গলতে পারে।

শুক্রবার জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। সরকারের চার বছর পূর্তি উপলক্ষে দেয়া ওই ভাষণে তিনি আরো বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষ দিকে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা আমাদের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে।’
প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরপরই আলোচনায় উঠে আসে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের বিষয়টি। বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে হতাশা ব্যক্ত করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে অবিলম্বে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছে। অন্য দিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপির সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বলছে, নির্বাচন ইস্যুতে সংলাপের কোনো প্রয়োজন নেই, যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও এ ইস্যুতে নানা মত দিচ্ছেন। কেউ বলছেন সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকারের কোনো বিধান নেই। তবে দুই পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে বর্তমান সংবিধানের আলোকেই সমস্যার সমাধান সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ৫৬ এবং ১১৯ অনুচ্ছেদ অনুসরণ করা যেতে পারে। এই দুই অনুচ্ছেদেই সমাধানের পথ দেখানো আছে।
খন্দকার মাহবুব হোসেন
সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমাদের সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার বলে কোনো বিধান নেই। অথচ প্রধানমন্ত্রী এক দিকে বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী সব কিছু হবেÑ আবার অন্য দিকে বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকার গঠন হবে। এ বক্তব্য সম্পূর্ণ স্ববিরোধী। তবে যা কিছুই করা হোকনা কেন দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতেই করতে হবে। এর বাইরে কোনো কিছু চিন্তা করা ঠিক নয়। এখন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতার জোরে যদি মনে করেন তার অধীনেই নির্বাচনকালীন সরকার হবে এবং সেই সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে তবে সেটা রাজনৈতিক সঙ্ঘাত বয়ে আনবে, যা দেশ এবং ক্ষমতাসীন দলের জন্যও ক্ষতির কারণ হবে।
তিনি বলেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বিএনপি নমনীয় অবস্থানে রয়েছে। তারা চায় সংলাপ বা সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক, যাতে দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। আর আওয়ামী লীগ যদি বিএনপিকে বাইরে রেখে এককভাবে নির্বাচন করতে চায় সেটা অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। বিএনপি সেটা চায় না বলেই বারবার সংলাপ বা সমঝোতার কথা বলছে। শেষ পর্যন্ত সেটা না হলে বিএনপি জনগণের ভোটাধিকার আদায়ে জনগণের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিবে। এতেও যদি সরকার একগুঁয়ে অবস্থানে থাকে তবে যে পরিস্থিতি হবে তার দায়ভার আওয়ামী লীগকেই বহন করতে হবে।
দিলারা চৌধুরী

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার বলে কিছু নেই। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিয়ম অনুযায়ী সংসদ ভাঙবে এবং রাষ্ট্রপতি নতুন করে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন। আর প্রধানমন্ত্রী নতুন করে মন্ত্রিসভা গঠন করবেন। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যেটাকে নির্বাচনকালীন সরকার বলে চালিয়ে দিতে চাচ্ছেন তা হলো তিনিই প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থেকে হয়তো মন্ত্রিসভা একটু ছোট করবেন। কিন্তু সব ক্ষমতা থাকবে প্রধানমন্ত্রীর ওপর। এটা কখনো নির্বাচনকালীন সরকার হতে পারে না।
তিনি বলেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রথমত সংসদ ভেঙে দিতে হবে। কারণ, কেউ বর্তমানে এমপি থাকা অবস্থায় তার সাথে আরেকজনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা খুব সহজ নয়। কিন্তু জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তেমন কোনো আভাস বা আশ্বাস দেননি। সরকার যদি তার এ অবস্থানে অটল থাকে তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। আর সরকার যদি তার অবস্থান পরিবর্তন না করে এবং বিএনপিও আবার নির্বাচন বর্জন করে তবে তা দেশের জন্য বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি করবে। সে জন্য নির্বাচনকালীন সরকার যে আঙ্গিকেই করা হোকনা কেন তা দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির সাথে সমঝোতা করেই করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। সে জন্য দুই দলের সংলাপ বা আলোচনা খুবই জরুরি। না হলে দেশের রাজনৈতিক, আর্থিক ও কূটনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হবে।
ড. শাহদীন মালিক

নির্বাচনকালীন সরকার বলে সংবিধানে কিছু নেই জানিয়ে সংবিধানবিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, নির্বাচনের এখনো দেরি আছে। নির্বাচনের আগমুহূর্তে হয়তো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অবস্থানও খানিকটা পরিবর্তন হতে পারে। আর প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে সামান্য হলেও সমঝোতার একটা ইঙ্গিত করেছেন, যা ইতিবাচক। তবে এর মানে যে বিএনপির দাবিও মেনে নেয়া হচ্ছে তা কিন্তু নয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দুই দলকেই অনড় অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। কারণ, দেশের এবং দুই রাজনৈতিক দলের স্বার্থেই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দরকার। কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী অবস্থানে দুই পক্ষ অনড় থাকলে অংশীদারিত্বমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। আমি মনে করি ভবিষ্যতে উভয় দলই সমঝোতায় আসবে আসতে হবে। না হলে বিএনপি নির্বাচন বর্জন না করলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও স্বস্তিতে থাকবে না।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সংবিধানের ৫৬ এবং ১১৯ অনুচ্ছেদ অনুসরণ করা যেতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘(১) একজন প্রধানমন্ত্রী থাকিবেন এবং প্রধানমন্ত্রী যেরূপ নির্ধারণ করিবেন, সেইরূপ অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী থাকিবেন। (২) প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদিগকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করিবেন : তবে শর্ত থাকে যে, তাঁহাদের সংখ্যার অন্যূন নয়-দশমাংশ সংসদ-সদস্যগণের মধ্য হইতে নিযুক্ত হইবেন এবং অনধিক এক-দশমাংশ সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইবার যোগ্য ব্যক্তিগণের মধ্য হইতে মনোনীত হইতে পারিবেন। (৩) যে সংসদ-সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হইবেন, রাষ্ট্রপতি তাঁহাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করিবেন। (৪) সংসদ ভাংগিয়া যাওয়া এবং সংসদ-সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে এই অনুচ্ছেদের (২) বা (৩) দফার অধীন নিয়োগদানের প্রয়োজন দেখা দিলে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার অব্যবহিত পূর্বে যাঁহারা সংসদ-সদস্য ছিলেন, এই দফার উদ্দেশ্য সাধনকল্পে তাঁহারা সদস্যরূপে বহাল রহিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।’

ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘ওয়েস্টমিনস্টার মডেল গ্রহণের সময় সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করার বিষয়টি চিন্তায় ছিল না। আর এ কারণেই নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়ার প্রসঙ্গ আসে।’
তিনি বলেন, সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের উল্লিখিত দুই দফায় প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ এবং তিন দফায় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থাভাজন ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের কথা বলা আছে। সে কারণে আগামী নির্বাচনের আগে সংবিধানের আওতায় একটি অন্তর্বর্তীকালীন বা সর্বদলীয় সরকার হতে পারে।
ড. ইকতেদার আহমেদ
সংবিধানবিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ড. ইকতেদার আহমেদ বলেন, সংবিধানের বর্তমান ব্যবস্থায় নির্বাচনকালীন সরকার বলে কোনো বিধান নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বলবত থাকাকালে নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলা ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল থাকাকালে মেয়াদ অবসান বা মেয়াদ অবসানের কারণ ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান ছিল। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পরবর্তী সংসদে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে যে বিধান করা হয় তাতে বলা হয়, মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে দেয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এবং মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নবপ্রবর্তিত বিধানের ফলে সংসদ বহাল থাকাবস্থায় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের সংবিধানের বর্তমান ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যেরূপ সরকার গঠিত হয় নির্বাচন অনুষ্ঠানকালীনও একইরূপ সরকার কার্যকর থাকে। মন্ত্রিসভার আকার কিরূপ হবে এটি সম্পূর্ণরূপে প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষার ওপর নির্ভর করে। সুতরাং নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার সাংবিধানিক বিধানের অনুপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী যেরূপ আকাক্সক্ষা করবেন মন্ত্রিসভাও সেরূপ হবে। এমতাবস্থায় নির্বাচনকালীন সরকারের কলেবর ছোট করা হলেও এটিকে নির্বাচনকালীন সরকার বলার কোনো অবকাশ নেই।

 

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/285391