১৬ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ৬:০৩

সিলেটবাসীর গলার কাঁটা ‘শিলং তীর’

‘শিলং তীর’ এখন সিলেটবাসীর গলার কাঁটা। ভিনদেশী এ লটারির খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ। দিনের রোজগার রাতে লুটে নিচ্ছে শিলং তীর সিন্ডিকেটরা। এখন শুধু চিহ্নিত এলাকায়ই নয়, সিলেটের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ছে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সিলেটে এ পর্যন্ত কম হলেও শিলং তীরের বিরুদ্ধে শতাধিক অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেটদের মূল উৎপাটন সম্ভব হয়নি।
এখন অভিযানের পাশাপাশি শিলং তীরের সিন্ডিকেটদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত রয়েছে পুলিশ প্রশাসন। সিলেট মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুধু সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমেই এই তীর সিন্ডিকেটদের থামানো সম্ভব। ‘বায়বীয়’ পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে শিলং তীর খেলা। প্রায় সময় সিন্ডিকেটরা ধরা পড়লেও তথ্য-প্রমাণের অভাবে তাদের আটকে রাখাও সম্ভব হয় না। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী হচ্ছে শিলং। সিলেট থেকে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরের এলাকা শিলং। পাহাড়ি বাসিন্দারা ওখানে শিলং তীর নামে প্রতিদিন একটি লটারির আয়োজন করেন। ওই লটারির ঢেউ অনেক আগেই এসে লাগে সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোতে। কিন্তু গত দেড় বছর আগে সিলেট নগরীতে প্রবেশ করে শিলং তীর। বিশেষ করে এজেন্ট তৈরির মাধ্যমে সিলেট নগরীতে ওই খেলা শুরু হয়। সিলেটে এ নিয়ে হুলস্থূল পড়ে যায়। রাতারাতি টাকাওয়ালা বনে যাওয়ার আশায় সিলেটে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েন শিলং তীর খেলায়। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থেকে প্রথমে শিলং তীরের বোর্ড পরিচালনা করা হয়। এরপরও ধীরে ধীরে গোটা নগরীতেই ছড়িয়ে বোর্ডের নিয়ন্ত্রকরা। এখন পাড়াভিত্তিক বোর্ড পরিচালনা করা হচ্ছে। সবমিলিয়ে সিলেট নগরীতে প্রায় ৫ শতাধিক বোর্ড রয়েছে বলে জানা গেছে। আর একেকটি বোর্ডের মালিক একেক জন সিন্ডিকেটরা। সিলেট নগরীর চৌকিদেখি এলাকার বাগান এলাকায় রয়েছে কয়েকজন ‘বিগবস’। লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে তারা এখন কোটিপতি। পুলিশের খাতায় তাদের নাম থাকলেও তারা বীরদর্পে শিলং তীরের বোর্ড পরিচালনা করছে। এছাড়া খাসদবির, হাউজিং এস্টেট, লেচুবাগান, পীরমহল্লা, পাঠানটুলা, মদিনা মার্কেট, কালিবাড়ি, বাগবাড়ি, মেডিকেল রোড, সুবিদবাজার, আম্বরখানা, শাহী ঈদগাহ. টিলাগড়, কাজিটুলা, শিবগঞ্জ, মেজরটিলা, পীরের বাজার, উপশহর, মেন্দিবাগ, বন্দরবাজার, সুবহানীঘাট, শেখঘাট, কলাপাড়া সহ কয়েকটি এলাকায় শিলং তীর সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বেশি। সিলেট পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সিলেটে শিলং তীর সিন্ডিকেটদের বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযান চালায়। আটক করা হয় সিন্ডিকেটদের। কিন্তু আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে বেরিয়ে যায় তারা। এ কারণে পুলিশ সামাজিকভাবে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে। ইতিমধ্যে পুলিশের মোটিভেশনে কাজ হচ্ছে। এদিকে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার তীর সিন্ডিকেটদের বিরুদ্ধে এলাকার মানুষ ক্ষুব্ধ। তারা ইতিমধ্যে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার সিন্ডিকেটের নাম প্রকাশ করে আবেদন করেছে। জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া স্মারকলিপিতে উল্লেখ করেন, দুষ্টচক্রের অপতৎপরতায় প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ‘শিলং তীর’র অভিশাপে অনেককে ভিটে-বাড়ি পর্যন্তও বিক্রি করতে হচ্ছে। লোভে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে দিনমজুর, গরিব আর সাধারণ মানুষ। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশে বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে সামাজিক ধস নামবে এবং এর পরিণতি হতে পারে অত্যন্ত মারাত্মক। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণে অবিলম্বে চরম ঘৃণিত এবং অভিশপ্ত এই ‘শিলং তীর জুয়া’র স্থানীয় এজেন্টদের গ্রেপ্তার এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় এলাকাবাসী। গত ৯ই জানুয়ারি সিলেটের জেলা প্রশাসক বরাবরে নগরীর ২৬নং ওয়ার্ডস্থ টেকনিক্যাল রোড সাধুরবাজারের বাসিন্দা আবদুল হাসিমের ছেলে মো. আবদুল করিম এক অভিযোগপত্রে এ দাবি জানান। দরখাস্তের অনুলিপি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী, পুলিশের আইজি এবং র্যা ব-৯-এর কমান্ডিং অফিসার বরাবরে পাঠানো হয়েছে। অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়, গণধিক্কৃত এই ‘শিলং তীর জুয়া’র স্থানীয় এজেন্টদের গ্রেপ্তারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বারবার অভিযান চালালেও কার্যত এদের দমন করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার কোনো কোনো সময় পুলিশ বা র্যা ব প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে না পেরে আশপাশ থেকে পথচারী বা নিরীহ লোকসহ অনেককে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে, যারা প্রকৃতপক্ষে দোষী নয়। তাই সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত এজেন্ট ও দালালদের গ্রেপ্তার করে আত্মঘাতী এ অপকর্মের মূলোৎপাটনে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানানো হয়। এদের মধ্যে রয়েছে নগরীর মোগলটুলার বাসিন্দা সুমন এবং মৃত রজাক মিয়ার ছেলে ইকবাল, কদমতলী বালুরমাঠের বাসিন্দা সাজাই মিয়া, ঝালোপাড়া চাঁদনীঘাট মাছবাজার সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা আবদুল কাইয়ুমের ছেলে কয়েছ ও আফরোজ মিয়ার ছেলে সুবেল, ভার্থখলা কুমিল্লাপট্টির রেনু মিয়ার ভাতিজা আকিল মিয়া, ভার্থখলা কমার্শিয়াল মার্কেটের কাজল মিয়ার স্ত্রী লাকী বেগম, ভার্থখলা নদীরপাড়স্থ জিঞ্জিরশাহ (রহ.) মাজার সংলগ্ন বাঁশপালা মার্কেটের মৃত কালু মিয়ার ছেলে আবুল কাশেম, বরইকান্দি গ্রামের ইন্তাজ মিয়ার ছেলে ফয়ছল মিয়া, স্থানীয় মকদ্দছ মার্কেটের মৃত মকবুল আলীর ছেলে ইউনুছ আলী, নানু মিয়ার ছেলে অপু মিয়া, লিলু মিয়ার ছেলে জাহেদ, বরইকান্দি গাঙ্গু মহল্লার রুটিওয়ালার বাড়ির নূর উদ্দিনের ছেলে নজমুল, খোজারখলা রেলওয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন মৃত মোস্তফা মিয়ার ছেলে শিপুল মিয়া, কিনব্রিজের নিচের কলোনির মৃত সমছু মিয়ার ছেলে তাহের ও মৃত ইবরাহিম আলীর পুত্র মরম আলী, ভার্থখলার দিলু মিয়ার ছেলে আবদুল মন্নান ও কামালবাজার ইউনিয়নের কুড়িগ্রাম নিবাসী জনৈক কামাল মিয়া। এদের বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে ‘শিলং তীর জুয়া’র এজেন্ট হিসেবে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এদের অনেকেই প্রভাবশালী বিধায় এসব অপকর্মের হোতাদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। তবে এদের অপকর্মে জনমনে ক্ষোভ বিরাজ করছে এবং ক্রমান্বয়ে সাধারণ মানুষ ফুঁসে উঠছেন।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=100684