১৬ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ৬:০০

ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষার দিন যা ঘটেছিল

এক বুক আশা নিয়ে ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে গত ১২ই জানুয়ারি ঢাকায় আসেন চুয়াডাঙ্গার মোর্শেদ আলী। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করা এ পরীক্ষার্থীর কেন্দ্র ছিল শাহ আলী মহিলা কলেজের ২০৪ নম্বর কক্ষে। পরীক্ষা ৩টা ৩০ মিনিটে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তিনি উপস্থিত হন ৩টার আগেই। এ কেন্দ্রের ব্যাংক পরীক্ষায় নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থার অভিযোগে ব্যাপক ভাঙচুর আর বিক্ষোভের মুখে পরীক্ষা বাতিল হয়ে যায়। সেদিন আসলে কী ঘটেছিল তার প্রত্যক্ষদর্শী মোর্শেদ বলেন, এ কেন্দ্রে ব্যাগ, মোবাইল ফোন আর ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস নিয়ে ঢুকতে কোনো পরীক্ষার্থীকে বাধা দেয়া হয়নি। কক্ষে কোনো ধরনের আসন বিন্যাস ছিল না।

ছিল না পর্যাপ্ত হল পরিদর্শকের উপস্থিতি। প্রত্যক্ষদর্শী এ শিক্ষার্থী বলেন, পরীক্ষার হল কোনো নিয়মের আওতায় না থাকায় পরীক্ষার্থীরা গ্রুপিং করে মোবাইল, ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে পরীক্ষা দিয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে পরিদর্শকের নিষ্ক্রিয়তা আর দুজনের বেঞ্চে ৫ থেকে ৬ জন পরীক্ষার্থী গাদাগাদি বসার কারণে। আসন বিন্যাস না থাকায় কোনো কোনো কক্ষে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত পরীক্ষার্থী প্রবেশ করায় অনেককে পরীক্ষার হলে ও হলের বাইরে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ না হওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থীরা ভাঙচুর ও বিক্ষোভ শুরু করে এবং পরীক্ষা বয়কট করেন।
ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে রাষ্ট্র মালিকানাধীন আট ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে হতাশ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সজিব, ইব্রাহীম, ইকবাল হোসেন ও সুমন। সেদিনের পরীক্ষা হলে তারা যে অনিয়ম দেখেছেন ইতিপূর্বে এ চিত্র তারা কখনো দেখেননি বলে জানান। তিতুমীর কলেজ পরীক্ষা হলে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার বর্ণনা করতে গিয়ে সজিব মানবজমিনকে বলেন, ব্যাগে মোবাইল ফোন নিয়ে কেন্দ্রে ঢুকতে কাউকে বাধার মুখে পড়তে হয়নি। একই বেঞ্চে ৬ জন বসে গ্রুপ স্টাডি করে মোবাইল ও ডিভাইসের সহায়তা নিয়ে নিশ্চিত হয়ে উত্তর ভরাট করতে দেখা গেছে অনেককে। এতে কাউকে হল পরিদর্শকের বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষার্থী। ড. মাহবুবুর রহমান মোল্যা কলেজ কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী ঢাবির আরেক শিক্ষার্থী ইব্রাহিম একই অভিযোগ করে বলেন, হলে মোবাইল সেট ব্যবহারের সুযোগ থাকায় উত্তরপত্র এসএমএসের মাধ্যমে সবার কাছে ছড়িয়ে পড়ে। কক্ষে আসন বিন্যাস না থাকায় ধারণ ক্ষমতার চেয়ে পরীক্ষার্থী ছিল অনেক বেশি। সে তুলনায় পর্যাপ্ত সংখ্যক হল পরিদর্শক না থাকায় অনেকে দেখাদেখি ও মোবাইল ব্যবহার করে দেখে দেখে উত্তর দিয়েছে। ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি কলেজ কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী ঢাবির আরেক শিক্ষার্থী ইকবাল হোসেন বলেন, আমার পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা হইচই শুরু করলে একটু দেরিতে পরীক্ষা নেয়ার কথা জানান হল পরিদর্শক। ৪০১ নং কক্ষের এই পরীক্ষার্থী বলেন, অন্যান্য হলের মতই আমার হলে আসন বিন্যাস না থাকায় খেয়ালখুশি মতো গাদাগাদি করে বসে আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে বেশিরভাগ পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছেন। একে স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিয়েছিলেন ঢাবির শিক্ষার্থী সুমন। তিনি বলেন, পরীক্ষা শুরুর আগের রাতে প্রশ্ন ফাঁসের কথা জেনেছি। পরের দিন পরীক্ষা হলে এসে তুঘলকি কাণ্ড দেখতে পেলাম। এক বেঞ্চে গণহারে বসায় অনেকে বসতে পারে নি। সিট নাম্বার না থাকায় বিশৃঙ্খল অবস্থায় কোনো কোনো কক্ষে পরীক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল মাত্রাতিরিক্ত। সবচেয়ে বড় কথা, সবাই মোবাইল ফোন সঙ্গে নিয়ে ইন্টারনেট থেকে উত্তর বের করে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পেয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো চার শিক্ষার্থী হাসান, রাসেল, রূপচাদ কুমার মণ্ডল ও মোশাররফ হোসেন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার চিত্র দেখেছেন। লালবাগকেল্লা মডেল হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের চিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে হাসান বলেন, প্রশ্ন ও ওএমআর পত্রে কোনো সেট নাম্বার ছিল না। এমনকি একই প্রশ্নপত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্ন ছিল। এ ছাড়া প্রশ্নপত্র ফটোকপি ও অস্পষ্ট থাকায় বিপাকে পড়তে হয়েছে পরীক্ষার্থীদের। এ কেন্দ্রে আসন নাম্বার ছিল তবে বিন্যাস মতো না বসায় দেখাদেখি করে মোবাইল ফোনে উত্তর খুঁজে বৃত্ত ভরাট করা হয়েছে। এমন অনিয়মে পরীক্ষা হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী কেন্দ্রের বাইরে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা বাতিলের দাবি করেন বলে জানান এ জবি শিক্ষার্থী। মিরপুর বাংলা কলেজে ৫১২ নং কক্ষের পরীক্ষার্থী জবি শিক্ষার্থী রাসেল বলেন, অনিয়মের দিক থেকে অন্যান্য হল থেকে ব্যতিক্রম ছিল না আমার কেন্দ্র। আমার কক্ষে পরীক্ষার্থীরা ছিল খুবই স্বাধীন। সবাই মোবাইল, ডিভাইস, ব্যাগ নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছে। গেটে কোনো চেকিং ছিল না। এমনকি পরীক্ষা শুরুর আগে এসব বিষয় নিষিদ্ধ হওয়ার কোনো ঘোষণা ছিল না। এ ছাড়া কক্ষে প্রয়োজনের তুলনায় হল পরিদর্শক ছিল খুবই কম। ফলে পরীক্ষার্থীরা পাস্পরিক আদান প্রদানের মাধ্যমে পরীক্ষা দিতে কারো সমস্যা হয়নি।

ব্যাংক পরীক্ষার দিনের একই ঘটনার কথা বললেন জবির পরীক্ষার্থী রূপচাদ কুমার মণ্ডল ও মোশাররফ হোসেন। ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও তেজগাঁও কলেজের এই দুই পরীক্ষার্থী বলেন, অনেকে ওএমআর পত্র নিয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল। কেউ কেউ প্রশ্ন ছাড়াই মোবাইলের এসএমএস দেখে দেখে উত্তর করেছে বলেন তারা। জবির এই ছাত্র আরো বলেন, পরীক্ষা শুরুর আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে পড়ার কথা শুনি। তারপর হলে গিয়ে দেখতে পাই আরেক বিশৃঙ্খল অবস্থা। কোনো নজরদারি ছিল না। ইচ্ছামতো আসনে বসে মোবাইল দেখে দেখে গ্রুপিংয়ের মাধ্যমে পরীক্ষা দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। অনেকে এ পরীক্ষার বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানান।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তেজগাঁও গভ. গার্লস স্কুল, শনির আখড়া দনিয়া কলেজ, সেন্ট্রাল মহিলা কলেজ ও মিরপুর আইডিয়াল কলেজের পরীক্ষা কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী শাফায়েত হোসেন, আশিক জাহান, বিপুল ভট্টাচার্য ও পলাশ। শাফায়েত বলেন, কেন্দ্রে এসে আসন বিন্যাসের চার্ট দেখতে না পেরে আমার কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীরা আন্দোলন করে। একপর্যায়ে আসন সংখ্যার ঘাটতি দেখা দেয়। এক কক্ষে মাত্রাতিরিক্ত পরীক্ষার্থীর কারণে আমার কেন্দ্রে গণহারে মোবাইল ও ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে উত্তর আদান প্রদান করে পরীক্ষার ঘটনা ঘটেছে।
ব্যাংক পরীক্ষায় একই অনিয়ম হওয়ার কথা বলেছেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আবিদ, ফজলুর রহমান ও আফজাল হোসেন। একে স্কুল এ্যান্ড কলেজে পরীক্ষা দিনের ঘটনার বর্ণনায় আবিদ বলেন, ৩টা ৩০ মিনিটে পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও আমার কেন্দ্রে শুরু হয়েছে ৩টা ৪০ মিনিটে। আসন বিন্যাস ছিল না। গেটে ও কক্ষে নজরদারি না থাকায় প্রশ্নের উত্তর নিশ্চিত হতে গিয়ে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বলেন তিনি। ঢাকা কলেজের ফজলুর রহমান বলেন, শান্তিনগর হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ ছিল আমার কেন্দ্র। সেখানে ছিল না সবার জন্য আসন বিন্যাস। পরীক্ষা শুরু হয়েছে দেরিতে। কক্ষে হইচই ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি শুরু হয়। তন্মধ্যে ছিল না কোনো হল পরিদর্শক। এদিকে হলে ঢোকার সময় কোনো কড়াকড়ি না থাকায় ভেতরে মোবাইল ফোন সেট ব্যবহার করার সুযোগ ছিল বলে জানান ঢাকা কলেজের এ শিক্ষার্থী।
আফজাল বলেন, মিরপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৬০৩নং কক্ষ আমার কেন্দ্র ছিল। পরীক্ষা ২০ মিনিট দেরিতে হয়েছে। তারপরও অনেক পরীক্ষার্থী বসার আসন পাচ্ছিলেন না। এ নিয়ে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে হইচই শুরু হয়। আসন নম্বর থাকলেও এর বিন্যাস ছিল না। এক বেঞ্চে গাদাগাদি বসে অনেকে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিশ্চিতভাবে প্রশ্নপত্রের উত্তর করেছে।

৮ ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে জরুরি বৈঠক আজ: রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আজ মঙ্গলবার জরুরি সভা ডেকেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বেলা ১১টায় বাংলাদেশ ব্যাংকে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগের দায়িত্বে থাকা ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি এবং ১৪টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির প্রধান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন খান বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ব্যাপারে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সভা ডাকা হয়েছে। সভায় এ ব্যাপারে ইতিবাচক কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন আট ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে গত রোববার প্রার্থীরা বিক্ষোভ করেন। তারা নয় দফা দাবি জানিয়েছেন। এসব দাবি মানা না হলে তারা আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। গত বছর সোনালী, রূপালী ও জনতা ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে নিয়োগ পরীক্ষাসহ পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা না করতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন। গত বৃহস্পতিবার চেম্বার বিচারপতি সে আদেশ স্থগিত করেন। এই আদেশের ফলে ওই তিন ব্যাংকসহ আট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষা হয়। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার (সাধারণ) ১ হাজার ৬৬৩টি শূন্য পদে ২ লাখ ১৩ হাজার ৫২৫ জন পরীক্ষার্থী আবেদন করেছিলেন। গত শুক্রবার আট ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ পাওয়া যায়।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=100765