১৬ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ২:০৪

মুক্তিকামী মানবতার জন্য একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ও প্রকাশ্য আদর্শ আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা.)

-ড. মুহা. নজীবুর রহমান

 
 
বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক মহান আল্লাহ তায়ালা নিজেই তাঁর সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রশংসা করে ঘোষণা করেছেন, ‘আর নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত।’ (সূরা আল কলম : ৪)। অন্যত্র তিনি আরো ঘোষণা করেছেন, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ, তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকালের সাফল্য প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।’ (সূরা আল আহযাব : ২১)।
 
ইসলামের সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর জামানার লোকের সম্মুখে ছিল এবং তাঁর ইন্তিকালের পর বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় তা পুরোপুরি সংরক্ষিত হয়েছে। তাঁর জীবনের সামান্যতম অংশও এমন নেই যে, ঐসময়ে তিনি তাঁর দেশবাসীর দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ভবিষ্যতের প্রস্তুতিতে লিপ্ত ছিলেন।
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের সকল বিষয়ই লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষিত আছে
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্ম, দুগ্ধপান, শৈশব, কৈশোর, যৌবন, ব্যবসায়ে যোগদান, চলাফিরা, বিয়ে, নবুওয়ত-পূর্বকালের বন্ধু-বান্ধব, কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ ও চুক্তিতে অংশগ্রহণ, আল আমিন উপাধি লাভ, কা’বাগৃহে প্রস্তর স্থাপন, ধীরে ধীরে নির্জন প্রিয়তা, হেরাগুহায় নিঃসঙ্গ অবস্থান, অহি অবতরণ, ইসলামের দাওয়াত দান, প্রচার অভিযান, বিরোধিতা, তায়েফ সফর, মি’রাজ, হিজরত, যুদ্ধ, হুদায়বিয়ার সন্ধি, বিভিন্ন দেশে ইসলামের দাওয়াতনামা প্রেরণ, দ্বীনকে পূর্ণতা প্রদান, বিদায় হজ ও মৃত্যু-এর মধ্যে কোন সময়টি দুনিয়াবাসীর দৃষ্টিসীমার আড়ালে ছিল? তাঁর কোনো অবস্থানটি সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ বেখবর ছিলেন? সত্য-মিথ্যা, ভুল-নির্ভুল, প্রত্যকটি বিষয়ই পৃথক পৃথক লিখিত আছে এবং প্রত্যকেই তা জানতে পারে।
 
মহানবী (সা.) এর ওঠাবসা, নিদ্রা-জাগরণ, বিয়ে-শাদী, সন্তান-সন্তুতি, বন্ধু-বান্ধব, নামাজ-রোজা, দিবা-রাত্রের ইবাদত, যুদ্ধ-সন্ধি, চলাফেরা, সফর ও অবস্থান, গোসল, আহার-বিহার, হাসি-কান্না, বস্ত্র পরিধান, হাসি-ঠাট্টা, আলাপ-আলোচনা, নির্জনে ও জনসমাজে বিহার, মেলামেশা, আচার-ব্যবহার, দেহের বর্ণ ও গন্ধ, আকৃতি-প্রকৃতি, লম্বা-চওড়া; এমনকি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, একত্রে শয়ন ও পবিত্রতা অর্জন প্রভৃতি প্রত্যেকটা বিষয় সম্পূর্ণ প্রকাশিত, সর্বজনবিদিত ও সংরক্ষিত আছে। এখানে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আচার-ব্যবহার সম্পর্কিত মাত্র একটি প্রাচীনতম কিতাব ‘শামায়েলে তিরমিযী’র বিভিন্ন অধ্যায়ের শিরোনাম উল্লেখ করছি। এ থেকে আন্দাজ করা যায়, আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-এর সম্পর্কিত অতি তুচ্ছ বিষয়ও সংশ্লিষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
 
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-এর চেহারা ও গঠনাকৃতির আলোচনা, কেশ, পাকা কেশ, চুল আঁচড়ানো, চুলে খেজাব লাগানো, চোখে সুরমা লাগানো, পোশাক, জীবনযাপন, মোজা, পাপস, আংটি, মোহর, তলোয়ার, লৌহবর্ম, লৌহশিরস্ত্রাণ, পাগড়ি, পায়জামা, চলা, মুখে কাপড় ঢাকনা, বসা, বিছানা-বালিশ, হেলান দেয়া, আহার করা, রুটি, খাবার গোশত ও তরকারি, অজু করা, আহারের আগে ও পরে দোয়া পাঠ, পেয়ালা, ফল, কী কী পান করতেন, কীভাবে পান করতেন, খোশবু লাগানো, কীভাবে কথা বলতেন, কবিতা পাঠ, রাতে কথাবার্তা, নিদ্রা, ইবাদত, হাসি, রসিকতা, চাশতের নামাজ, গৃহে নফল নামাজ পড়া, রোজা, কুরআন পাঠ, রোনাজারি, বিছানা, নম্রতা, আচার-ব্যবহার, ক্ষৌরকাজ, নামসমূহ, জন্মতারিখ ও বয়স, মৃত্যুর বিষয়, মীরাস ও পরিত্যক্ত বস্তুর আলোচনা। এগুলো রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যক্তিগত অবস্থার বিবরণ। এর মধ্যে প্রত্যেকটি শিরোনামে কোথাও মাত্র কতিপয় এবং কোথাও বহু ঘটনা বিবৃত হয়েছে। এ ঘটনাগুলোর প্রত্যেকটি দিক স্বচ্ছ ও দ্ব্যর্থহীন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের কোনো একটি মুহূর্ত পর্দারান্তরালে ছিল না। অন্তঃপুরে তিনি থাকতেন স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের মধ্যে এবং বাইরে আত্মীয়-বান্ধব ও ভক্তদের মজলিসে। দুনিয়ার বিরাট প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিও নিজের ঘরে সাধারণ মানুষই থাকেন। তাই ভল্টেয়ারের কথায় বলা যায়, ‘কোনো ব্যক্তি নিজের ঘরে হিরো হতে পারে না।’ বসওয়ার্থ স্মিথের মতে, ‘এ নীতিটি কমপক্ষে ইসলামের পয়গাম্বরের ক্ষেত্রে সত্য নয়।’
 
প্রখ্যাত দার্শনিক গীবন বলেছেন, ‘মুহাম্মদের মতো অন্য কোনো পয়গাম্বর তার অনুসারীদের এমন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি করেননি। যারা তাঁকে মানুষ হিসেবে খুব ভালোভাবেই জানতেন, তাদের সম্মুখে তিনি হঠাৎ নিজেকে পয়গাম্বর হিসেবে পেশ করলেন। নিজের স্ত্রী, নিজের গোলাম, নিজের ভাই এবং নিজের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের সম্মুখে নিজেকে পয়গাম্বর হিসেবে পেশ করলেন এবং তারা বিনাদ্বিধায় তার দাবি মেনে নিলেন।’
মানুষের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার খবর স্ত্রীর চেয়ে অধিক আর কেউ জানতে পারে না। কিন্তু এটি কি একটি বাস্তব সত্য নয় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুয়্যতের ওপর সর্ব প্রথম তাঁর স্ত্রী ঈমান এনেছিলেন? নবুয়্যত লাভের পূর্বে পনের বছর তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে জীবনযাপন করেছেন। তাঁর সম্পর্কে প্রতিটি বিষয় ব্যক্তিগতভাবে জানতেন। এসব সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুয়্যত দাবি করার পর সর্বপ্রথম তিনিই তাঁর দাবির সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন।
 
অতি মহান ব্যক্তিও যিনি মাত্র একটি স্ত্রীর স্বামী, তিনিও স্ত্রীকে এই মর্মে ব্যাপক অনুমতি দানের হিম্মত রাখেন না যে, তুমি আমার প্রত্যেকটি কথা, প্রত্যেকটি অবস্থা ও ঘটনা জনসমক্ষে বিবৃত কর এবং যা কিছু গোপন আছে, তা-ও সকলের নিকট প্রকাশ করে দিও। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একই সঙ্গে ৯ জন স্ত্রী ছিলেন এবং তাদের প্রত্যেককে তিনি এ অনুমতি দিয়েছিলেন, নির্জনে আমার মধ্যে যা কিছু দেখ তা বিনাদ্বিধায় জনসমক্ষে বিবৃত কর। কপাটবদ্ধ ঘরের ভেতরে যা কিছু দেখ, খোলা ময়দানে তা সবাইকে শুনিয়ে দাও। এহেন চারিত্রিক দৃঢ়তা ও আত্মপ্রত্যয়ের নবী কি আর কোথাও পাওয়া যাবে?
 
এগুলো হলো রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যক্তিগত অবস্থা বর্ণনার শিরোনামসমূহ। হাদীস গ্রন্থসমূহ তাঁর পবিত্র চরিত্র, উন্নত গুণাবলী ও উত্তম আচার-ব্যবহারের বিস্তারিত বর্ণনায় ভরপুর। বিশেষ করে ‘কাযী ইয়ায আন্দালুসী’র কিতাব ‘আশ্শিফা’ এ বিষয়ে সর্বোত্তম। ফ্রান্সের জনৈক ইউরোপীয় প্রাচ্যবিদের মতে, ‘কাযী ইয়ায আন্দালুসী’র ‘আশশিফা’ কিতাবটিকে কোনো ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ করা প্রয়োজন, তাতে ইসলামের পয়গাম্বরের প্রকৃত গুণাবলী সম্পর্কে আরো অধিক মানুষ অবহিত হবে। এ প্রয়োজনে সীরাতুন্নবী দ্বিতীয় খ-ে ‘শামায়েল’ অধ্যায়ে নিম্নলিখিত শিরোনামসমূহ সংযোজন করা হয়েছেÑ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ‘পবিত্র চেহারা, নবুয়্যতের মোহর, পবিত্র কেশ, চলার ভঙ্গি, কথাবার্তা, হাসি, পোশাক, আংটি, বর্ম ও লৌহ শিরস্ত্রাণ, খাদ্য ও আহার পদ্ধতি, দৈনন্দিন আহার, উত্তম পোশাক, পছন্দনীয় রঙ ও অপ্রিয় রঙ, খোশবু ব্যবহার, সৌন্দর্যপ্রিয়তা ও সওয়ার হবার আগ্রহ ইত্যাদি।
 
‘নিয়মিত কার্যধারা’ অধ্যায়ে নিম্নলিখিত শিরোনামসমূহ সংযোজন করা হয়েছে : সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত যা করতেন, নিদ্রা, নৈশ ইবাদত, নিয়মিত নামাজসমূহ, বক্তৃতার ধরন, সফর, জিহাদ,পীড়িতদের খোঁজখবর নেয়া, সাধারণ সাক্ষাৎকার এবং সকলের সঙ্গে লেন দেন ও আদান-প্রদান ইত্যাদি।
 
‘নবীর মজলিস’ অধ্যায়ে নিম্নলিখিত শিরোনামসমূহ সংযোজন করা হয়েছে : নবীর দরবার, নসিহতের মজলিস, মজলিসের আদব-কায়দা, মজলিসের সময়সূচি, মহিলাদের জন্য বিশেষ মজলিস, নসিহত করার ধরন-পদ্ধতি, মজলিসের অনন্দঘন পরিবেশ, সঙ্গ লাভের সুফল, কথা বলার ভঙ্গিমা, বক্তৃতাসমূহের ধরন, বক্তৃতাসমূহের প্রভাব।
 
‘ইবাদত’ অধ্যায়ে সংযোজিত শিরোনামসমূহ : দোয়া ও নামাজ, রোজা, জাকাত, সদকা, হজ, সর্বক্ষণ আল্লাহর স্মরণ, আল্লাহ প্রেমের আনন্দ, যুদ্ধক্ষেত্রে আল্লাহর স্মরণ, আল্লাহভীতি, রোনাজারি, আল্লাহপ্রেম, আল্লাহর ওপর নির্ভরতা, ধৈর্য ও শোকর।’
 
‘নবী চরিত্র’ অধ্যায়ে বিস্তারিত শিরোনামসমূহ : নবী-চরিত্রের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা, কর্মের দৃঢ়তা, সদ¦্যব্যবহার, সদাচার ও ইনসাফ, দানশীলতা, ত্যাগ, মেহমানদারি, ভিক্ষাবৃত্তির প্রতি ঘৃণা, সাদকা গ্রহণের অসম্মতি, তোহফা গ্রহণ, কারো অনুগ্রহভাজন না হওয়া, বলপ্রয়োগ বিরোধনীতি, আত্মপীড়ন অপছন্দনীয়, অপরের প্রচার ও অযথা-প্রশংসার প্রতি বিরূপ মনোভাব, সারল্য ও অনাড়ম্বরতা, কতৃত্বের বড়াই ও লোক দেখানো ভাব থেকে দূরে অবস্থান, সাম্য, নম্রতা, অপাত্রে সম্মান ও প্রশংসার প্রতি বিরূপতা, লজ্জাশীলতা, স্বহস্তে কাজ করা, হিম্মত ও দৃৃঢ়তা, সাহসিকতা, সত্যবাদিতা, প্রতিজ্ঞা পালন, মিতাচার ও অল্পে তুষ্টি, ক্ষমা ও ধৈর্য, শত্রুদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন ও সদ্ব্যবহার, কাফের ও মুশরিকদের সাথে ব্যবহার, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সাথে ব্যবহার, গরিবদের প্রতি ভালোবাসা ও সমবেদনা, জানের দুশমনের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন, শত্রুদের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া, ছোটদের প্রতি স্নেহ, মহিলাদের প্রতি ব্যবহার, পশুর প্রতি দয়া, সাধারণভাবে সকলের জন্য করূণা ও ভালোবাসার প্রকাশ, অন্তরের কোমলতা, পীড়িতদের দেখাশোনা, মৃতের আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি সহানুভূতি, নম্রমেজাজ, সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা ও নিজের স্ত্রীদের সঙ্গে ব্যবহার।’
 
হাফিজ ইবনে কাইয়্যেম ‘যাদুল মা’আদ’ গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাল অবস্থা আরো বেশি তথ্যবহুলরূপে পেশ করেছেন। কেবল ব্যক্তিগত বিষয়াবলী সম্পর্কে তার আলোচ্যসূচির তালিকা এখানে উল্লেখ করছি, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যোগাযোগ পদ্ধতি, তাঁর আহার ও পানীয় গ্রহণের পদ্ধতি, তাঁর বিবাহ ও দাম্পত্য সম্পর্কের পদ্ধতি, নিদ্রা ও জাগরণ পদ্ধতি, সওয়ার হওয়ার পদ্ধতি, দাস-দাসীকে নিজের খিদমতের জন্য পেশ করার পদ্ধতি, তাঁর লেনদেন ও বেচাকেনার পদ্ধতি, মলমূত্র ত্যাগের নিয়মাবলী, দাড়ি বানাবার পদ্ধতি, গোঁফ রাখা ও ছাঁটার পদ্ধতি, তাঁর কথা বলার পদ্ধতি, তাঁর নিরবতা, তাঁর হাসি, তাঁর কান্না, তাঁর বক্তৃতার পদ্ধতি, তাঁর অজুর পদ্ধতি, মোজার ওপর মাসেহ করার পদ্ধতি, তায়াম্মুম করার পদ্ধতি, নামাজ আদায়ের পদ্ধতি, দুই সিজদার মাঝখানে বসার পদ্ধতি, সিজদা করার পদ্ধতি, শেষ বৈঠকে বসার পদ্ধতি, নামাজে বসার ও তাশাহুদের সময় আঙুল ওঠাবার পদ্ধতি, নামাজে সালাম ফেরাবার পদ্ধতি, নামাজে দোয়া করা, তাঁর ছোহ্-সিজদা করার পদ্ধতি, নামাজে ‘সতর’ নির্ধারণ করার পদ্ধতি, সফররত ও স্থির অবস্থা, মসজিদে ও গৃহে তার সুন্নাত ও নফল নামাজ আদায়ের পদ্ধতি, তাহাজ্জুদ বা ফজরের সুন্নাতের পর বিশ্রাম করার পদ্ধতি, তাহাজ্জুদ পড়ার পদ্ধতি, রাতের নামাজ ও বেতের পড়ার পদ্ধতি, বেতেরের পর বসে নামাজ পড়ার পদ্ধতি, কুরআন পাঠের সময় তাঁর অবস্থা, তাঁর চাশতের নামাজ পড়ার পদ্ধতি, শোকরের সিজদা আদায় করার পদ্ধতি, তাঁর জুমার নামাজ পড়ার নিয়মাবলী, জুমার দিন তাঁর ইবাদতের পদ্ধতি, তাঁর খুতবাদানের পদ্ধতি, দুই ঈদের নামাজ আদায়ের পদ্ধতি, সূর্য গ্রহণের সময় নামাজ পড়ার পদ্ধতি, অনাবৃষ্টির কারণে নামাজ পড়ার পদ্ধতি, তাঁর সফরের পদ্ধতি, সফরে নফল নামাজ পড়ার পদ্ধতি, দুই নামাজকে এক সঙ্গে পড়ার পদ্ধতি, তাঁর কুরআন পড়ার ও শুনার পদ্ধতি, পীড়িতদের দেখার ব্যাপারে তাঁর পদ্ধতি, জানাজার ব্যপারে তাঁর পদ্ধতি, জানাজার সাথে তাঁর দ্রুতপদে চলার পদ্ধতি, তাঁর মৃতের ওপর কাপড় ঢাকা দেবার পদ্ধতি, কোনো লাশ আনা হলে সে সম্পর্কে তাঁর জিজ্ঞাসাবাদ করার পদ্ধতি, তাঁর জানাজার নামাজের পদ্ধতি, শিশুদের জানাজা পড়ার ব্যাপারে তাঁর নিয়ম, আত্মহত্যাকারী ও জিহাদে প্রাপ্ত গনিমাতের অর্থ আত্মসাৎকারীর জানাজা না পড়া, জানাজার আগে আগে তাঁর চলার পদ্ধতি, অদৃশ্য লাশের জন্য তাঁর জানাজা পড়ার পদ্ধতি, জানাজার জন্য তাঁর দাঁড়াবার পদ্ধতি, শোক প্রকাশ ও কবর জিয়ারতের ব্যাপারে তাঁর পদ্ধতি, রোজার ব্যাপারে তাঁর পদ্ধতি, রমজানে তাঁর অধিক ইবাদত করার ব্যাপারে তাঁর পদ্ধতি, চাঁদ দেখার সাথে সাথেই তাঁর রোজা ইফতার করার পদ্ধতি, চাঁদ দেখার সাক্ষী গ্রহণের ব্যাপারে তাঁর পদ্ধতি, সফরে রোজা না রাখার ব্যাপারে তাঁর পদ্ধতি, আরাফা দিবসে আরাফার কারণে তাঁর রোজা না রাখার এবং শুক্র, শনি ও রোববার রোজা রাখার পদ্ধতি, তার একাধিক্রমে রোজা রাখার পদ্ধতি, তার নফল রোজা রাখার ও তা ভেঙে যাবার পর আদায় করাকে ওয়াজিব না মনে করার পদ্ধতি, জুমার দিনটিকে রোজার জন্য বাছাই করার কারণে তাঁর পদ্ধতি, তাঁর এক বছরে দুটি ওমরা আদায় করার পদ্ধতি, তাঁর হজসমূহের অবস্থা, তাঁর স্বহস্তে কুরবানি করার পদ্ধতি, হজে তার কেশ মু-নের পদ্ধতি, হজের দিনগুলোয় তাঁর খুতবা দানের পদ্ধতি, ঈদুল আজহায় তাঁর খুতবা দানের পদ্ধতি, ঈদুল আজহায় তাঁর কুরবানি দানের পদ্ধতি, আকীকার ব্যাপারে তার পদ্ধতি, নবজাতকের কানে আজান দেয়ার এবং তাঁর নাম রাখার ও খাতনা করার ব্যাপারে তাঁর পদ্ধতি, নাম ও কুনিয়াত (ডাক নাম) রাখার ব্যাপারে তার পদ্ধতি, কথা বলার ক্ষেত্রে সতর্কতা এবং শব্দ নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁর পদ্ধতি, তাঁর গৃহে প্রবেশ পদ্ধতি, তাঁর পায়খানায় প্রবেশের ও সেখান থেকে নির্গমণের পদ্ধতি, তাঁর কাপড় পরার পদ্ধতি, অজুর দোয়ার ব্যাপারে তাঁর পদ্ধতি, প্রথম তারিখের চাঁদ দেখার পর তাঁর দোয়া করার পদ্ধতি, খাবার পূর্বে ও পরে তাঁর দোয়া করার পদ্ধতি, আহারের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপারে তাঁর পদ্ধতি, অন্যের গৃহে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করার ব্যাপারে তার পদ্ধতি, সফরে দোয়া পাঠের পদ্ধতি, বিবাহের দোয়ার ব্যাপারে তাঁর পদ্ধতি, কোনো কোনো শব্দের ব্যবহার অপছন্দ করার ব্যাপারে তাঁর পদ্ধতি, যুদ্ধ ও জিহাদে তাঁর পদ্ধতি, কয়েদিদের ব্যাপারে তার পদ্ধতি, গুপ্তচর-কয়েদি গোলামের ব্যাপারে তাঁর পদ্ধতি, সন্ধি করার, নিরাপত্তা দানের, জিযিয়া নির্ধারণ করার এবং আহলে কিতাব ও মুনাফিকদের সঙ্গে ব্যবহারের ব্যাপারে তাঁর পদ্ধতি, কাফের ও মুনাফিকদের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে তার ব্যবহারের পদ্ধতি, তাঁর দিল ও দেহের রোগ চিকিৎসার পদ্ধতি। এখানে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সামান্য ও খুটিনাটি ব্যাপার সমূহের একটি সংক্ষিপ্ত শিরোনামের তালিকা পেশ করলাম। এ থেকে আন্দাজ করা যায় যে, এ সমস্ত ছোট ছোট বিষয়কে যখন এভাবে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে, তখন বিরাট বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ কত বিস্তারিত বিবরণ এখানে বর্তমান। মোট কথা একটি মানুষের জীবনের যতগুলো দিক থাকতে পারে তার সব শিরোনামের তালিকা এখানে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষিত আছে।
 
অত্র আলোচনায় মুক্তিকামী বিশ্বমানবতার সামনে স্পষ্ট হয়েছে যে, ‘মানবিক গুণাবলীর পরিপূর্ণতার ক্ষেত্রে একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ও প্রকাশ্য আদর্শ’ বলতে আমরা কী বোঝাতে চেয়েছি। ফলে আমাদের দাবির (মুক্তিকামী মানবতার জন্য) একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ও প্রকাশ্য আদর্শ আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা.) কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনও তাঁর কোনো অবস্থা ও জীবনের কোনো ঘটনা পর্দারান্তরালে রাখার চেষ্টা করেননি। তিনি যেভাবে জীবনযাপন করতেন তা সবার নিকট প্রকাশিত ও পরিচিত ছিল এবং আজও আছে। তার প্রিয়তমা পতœী আয়েশা (রা.) ৯ বছর তাঁর সঙ্গে বসবাস করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে তোমাকে বলে যে, মুহাম্মদ আল্লাহর নির্দেশাবলীর মধ্য থেকে কিছু লুকিয়ে রেখেছেন এবং মানুষের নিকট তা প্রকাশ করেননি, তাকে সত্যবাদী মনে করো না।’ (সহীহ আল-বুখারী, নিম্নোক্ত আয়াতের তাফসীর)। কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘হে রাসূল! তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে তোমার প্রতি যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে, তা প্রচার করো; যদি না করো তবে তো তুমি তাঁর বার্তা প্রচার করলে না। আল্লাহ তোমাকে মানুষ হতে রক্ষা করবেন। আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে সৎ পথে পরিচালিত করেন না।’ (সূরা আল মায়েদা : ৬৭)।
 
দুনিয়ায় কোনো ব্যক্তিই তার সামান্যতম দুর্বলতার কথাও প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে চায় না। বিশেষ করে যে ব্যক্তি কোনো একটি জামায়াতের নেতৃত্ব এবং তাও আবার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব দান করেন তিনি কখনও এ কার্যে ব্রতী হন না। কিন্তু কুরআন মজিদে এমন অনেক আয়াত আছে যেগুলোতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বাহ্যিক ছোটখাটো ভুল-ত্রুটির জন্য তাঁকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। এ সত্ত্বেও কুরআনের প্রতিটি আয়াত তিনি লোকদের শুনিয়েছেন। লোকেরা সেগুলো কণ্ঠস্থ করেছে। প্রত্যেকটি মসজিদে ও মেহরাবে সেগুলোর আবৃত্তি হয়েছে। আজও যেখানে মুহাম্মদ (সা.)-এর নাম পরিচিত, সেখানে তাঁর অনুসারীদের মুখে ওগুলোও উচ্চারিত হচ্ছে। অথচ এ মামুলি ভ্রান্তিগুলোর উল্লেখ যদি কুরআনে না থাকতো, তাহলে আজ দুনিয়া এগুলোর কথা জানতেই পারতো না। কিন্তু একটি পবিত্র জীবনের প্রত্যেকটি বস্তুরই প্রকাশ্য দিবালোকে আসার প্রয়োজন ছিল এবং তাই হয়েছে।
 
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন-আচরণ আলোচনা করলেই আমরা দেখতে পাই যে, যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অবস্থা যত বেশি অবগত ছিলেন, তিনি তত বেশি শ্রদ্ধা ও অনুরক্তি প্রকাশ করেছেন। অন্যান্য সাধারণ নবীগণের ব্যাপারে এ নিয়ম ছিল না। সর্বপ্রথম অপরিচিত লোকেরাই তাঁদের ওপর ঈমান এনেছে। তারপর তাঁদের আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ক্ষেত্রে এর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাঁকে সর্বপ্রথম তারাই মেনে নিয়েছেন যাঁরা তাঁর অবস্থা, চরিত্র ও অভ্যাসসমূহ সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞাত ছিলেন এবং তাদের প্রত্যেকেই নিজেদের ঈমান ও আকিদার কঠোর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। খাদিজা (রা.) তিন বছর পর্যন্ত ‘শে’বে আবু তালিব’ নামক উপত্যকায় অবরুদ্ধ ছিলেন। সেখানে তাঁকে ক্ষুধা, অনাহার ও অর্ধাহারের সম্মুখীন হতে হয়। যখন চতুর্দিক থেকে দুশমনরা পশ্চাদ্ধাবন করছিল তখন রাতের অন্ধকারে আবুবকর সিদ্দিক (রা.) ভীষণ বিপদের ঝুকি মাথায় নিয়ে তার সহযাত্রী হন। আলী (রা.) এমন বিছানায় শয়ন করেন, যা পরদিন সকালে রক্তরঞ্জিত হতে যাচ্ছিল। যায়েদ (রা.) এমন ক্রীতদাস ছিলেন, যিনি পিতার সন্ধান পাবার পর তাঁর অত্যাধিক পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও নিজের আধ্যাত্মিক পিতাকে ত্যাগ করতে সম্মত হননি।
 
বিখ্যাত লেখক ক্যাডফ্রে হেগেল ‘অ্যাপলজি ফর মুহাম্মদ’ এ লিখেছেন, ‘খ্রিস্টানরা যদি একথা মনে রাখে, তাহলে খুব ভালোই হবে যে, মুহাম্মদ (সা.)-এর পয়গাম তার অনুসারীদের মনে এমন নেশার সৃষ্টি করেছিল, যা যীশুর প্রথম যুগের অনুসারীদের মধ্যে সন্ধান করা অর্থহীন। যীশুকে যখন শূলদ-ের ওপর চড়ান হলো, তখন তাঁর অনুগামীরা পলায়ন করল। তাদের ধর্মীয় নেশা কেটে গিয়েছিল এবং নিজেদের শ্রদ্ধেয় নেতাকে মৃত্যুর কবলে শৃঙ্খলিত রেখে তারা সরে পড়ল। অপরদিকে মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুসারীরা তাদের মজলুম পয়গাম্বরের চতুর্দিকে সমবেত হলো, তারা নিরাপত্তার জন্য নিজেদের জানমাল বিপদের মুখে নিক্ষেপ করে তাঁকে শত্রুদের ওপর বিজয়ী করলো।’ (উর্দু অনুবাদ, পৃষ্ঠা.৬৬-৬৭,১৮৭৩ সালে বেরিলিতে মুদ্রিত)।
উপসংহার
 
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্য ও তাঁর জীবনের অনুসৃতকে আল্লাহর ভালোবাসার মানদ-ে পরিণত করা হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্য দ্বীনের নেশায় বা আবেগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রাণ দান করা সহজ। কিন্তু সারা জীবন প্রত্যেকটি বিষয়ে প্রতিটি অবস্থায় তাঁর অনুসৃত পুলসিরাত এমনভাবে অতিক্রম করা- যেন কোনো পদক্ষেপেই সুন্নাতে মুহাম্মদী (সা.) থেকে সামান্য পরিমাণও এদিক-সেদিক না হতে পারে-এটা বড়ই কঠিন পরীক্ষা। এই অনুসৃত পরীক্ষায় সাহাবাগণ পূর্ণ সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং এ প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়েই সাহাবা, তাবেঈন, তাবই তাবেঈন, মুহাদ্দিসগণ, ঐতিহাসিক ও নবীচরিত রচয়িতাগণ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রত্যেকটি কথা, প্রত্যেকটি বিষয়, প্রতিটি কাজ সম্পর্কে জানা এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের জানানো নিজেদের বিশেষ কর্তব্য মনে করেছেন, যেন প্রত্যেকটি মুসলমান সে অনুসারে চলার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারে। এ থেকে প্রমাণিত হলো, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসারীগণের দৃষ্টিতে তাঁর জীবনে মানবিক গুণাবলীর পরিপূর্ণ ও প্রকাশ্য সমাবেশ ঘটেছিলো। এজন্যই তো তাঁরা একমাত্র তাঁর অনুগমনকে পরিপূর্ণ মানবিকতার মানদ- হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। ফলে চরম অরাজকতার মানব সমাজে সৃষ্টি হয়েছিল একটি পরম প্রশান্তির বেহেশতি পরিবেশ, যা মানবতার ইতিহাসে স্পষ্টভাবেই লিপিবদ্ধ আছে। আজকের অশান্ত পৃথিবীতে বসবাসরত মুক্তিকামী মানবতার জন্যও একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ও প্রকাশ্য আদর্শ আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন, এটা ঐতিহাসিকভাবেই প্রমাণিত সত্য।
 
ইতিহাস সাক্ষী, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের মতো পরিপূর্ণ কল্যাণময় ও সকল খুঁটিনাটি চারিত্রিক বিষয়ের প্রকাশ্য আদর্শের আর একটি উদাহরণ কোথাও পাওয়া যায় না। মানবসভ্যতার সার্বিক জীবনে পরিপূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব মানুষের জন্য বিশেষ করে মুসলমানদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরিপূর্ণ জীবন অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। অন্যথায় মানবতার জীবনে নেমে আসবে চরম অশান্তির জাহান্নামের পরিবেশ। আল্লাহ আজকের বিশ্বমানবতাকে উল্লিখিত বিষয়টির আসল শিক্ষা কার্যকরী করার তৌফিক দিন। আমিন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।
ই-মেইল : dr.mdnajeeb@gmail.com