১৬ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৩০

জাতীয় নির্বাচন কি নিরপেক্ষ হবে ?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১২ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে চলতি বছরের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষ দিকে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কী ভাবে অনুষ্ঠিত হবে তা আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে এবং সেই সরকার সর্বতোভাবে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা দিবে। তিনি আরো বলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। এই কমিশন ইতোমধ্যে দু’টি সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় পর্যায়ের বেশ কিছু নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন।”

প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মহল বিশেষ কর্তৃক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির আশংকা প্রকাশ করে আরো বলেছেন যে, নির্বাচন বয়কট করে আন্দোলনের নামে জানমালের ক্ষতি কেউ মেনে নেবে না। তিনি তার ভাষণে আওয়ামী লীগ শাসনের আমলে গত কয়েক বছরে দেশে অভাবিত উন্নয়নের কাহিনীও তুলে ধরেন। পাশাপাশি তিনি বিএনপি জামায়াতের “ধ্বংসাত্মক” তৎপরতা সম্পর্কেও দেশবাসীকে হুশিয়ার করেছেন।
এদিকে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরানুযায়ী সরকারী দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি প্যাকেজ কর্মসূচী নিয়ে মাঠে তৎপরতা শুরু করেছে। এই প্যাকেজে প্রাথমিকভাবে ১৭০টি আসনে জয়লাভকে লক্ষ্যমাত্রা হিসাবে ধরা হয়েছে। প্যাকেজে রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ফেব্রুয়ারির মধ্যে চার সিটিসহ ছয় জেলায় জনসভা অনুষ্ঠান, অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন নিশ্চিত করার জন্য তফসীল ঘোষণার আগেই প্রার্থীদের জানিয়ে দেয়া, ব্যক্তি নয় নৌকার পক্ষে প্রচারণা, সরকারের উন্নযন ও বিএনপি জামায়াতের ‘অপরাজনীতি’ তুলে ধরা, কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন ও সার্বিকভাবে আওয়ামী পরিবারভুক্ত সকল নেতা-কর্মীর মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও প্রণোদনা সৃষ্টি। দলীয় সূত্র অনুযায়ী একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা তৃণমূল পর্যায়ে জরীপ কাজও সম্পন্ন করেছেন। একটি সরকারী ও দু’টি বেসরকারী সংস্থা পরিচালিত এই জরীপ অনুযায়ী তারা ইতোমধ্যে ১২টি গ্রুপ গঠন করে মাঠে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

তবে পর্যবেক্ষক মহল নির্বাচনের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা এবং তার দলের একতরফা মাঠে নামা নিয়ে নির্বাচনী ময়দানে বৈষম্য সৃষ্টির কিছু আভাস দিয়েছেন। তারা এর মধ্যে নির্বাচনী ব্যবস্থায় সরকারী দলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসও লক্ষ্য করেছেন এবং বলেছেন যে, নির্বাচনের ঘোষণা নির্বাচন কমিশনই দেয়ার কথা, এটা তাদেরই এখতিয়ার, প্রধানমন্ত্রীর নয়, প্রধানমন্ত্রী যদি এই ঘোষণা দেন তা হলে তার অর্থ তিনি এবং তার দলই নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করবেন, যা কোন প্রকারেই সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন নির্বাচনী ব্যবস্থার অংশ হতে পারে না। ২০১৪ সালে বিরোধী দলগুলো আওয়ামী লীগের অধীনে এজন্যই নির্বাচনে অংশ নেয়নি যে ঐ নির্বাচনে ভোটারদের নিরপেক্ষভাবে ভোট দানের পরিবেশ ছিল না, সরকারী দলই তা নিয়ন্ত্রণ করেছে, জাল ভোট দিয়েছে, বুথের বাইরে ব্যালট পেপারে সীল মেরেছে, বাক্স ভর্তি করেছে, সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষ ভোট দিতে আসেনি, ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনের এমপি প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিনা ভোটে নির্বাচিত বলে ঘোষিত হয়েছিলেন। বাকী ১৪৬টি আসনে ভোটের নামে যে প্রসহন হয়েছিল তাতে ভোটার উপস্থিতি ছিল শতকরা ০৪-০৫ শতাংশ। মানুষ এই নির্বাচন ও নির্বাচনী পদ্ধতির উপর অনাস্থা প্রদর্শন করেছিল। কিন্তু এই জনরায়ের প্রতি ক্ষমতাসীন দল সম্মান প্রদর্শন করেনি।

বাংলাদেশে এখন স্বৈরাচারী শাসনের নিকৃষ্টতম নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার প্রতিদ্বন্দ্বী সকল রাজনৈতিক দলকে দেশ থেকে উৎখাত করার সর্বাত্মক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বামপন্থী রাজনৈতিক এতিমদের এবং এক সময়ের স্বৈরশাসক এরশাদের দলকে ক্ষমতা ও অর্থ-বিত্তের উচ্ছিষ্টের অংশীদার বানিয়ে বাগে এনেছে। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার চার দশক পর যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে তাদের ফাঁসি দিয়ে দলটিকে পঙ্গু করেই তারা ক্ষ্যান্ত হয়নি শীর্ষ, মধ্যম ও তৃণমূল পর্যায়ের অবশিষ্ট নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও হামলা মামলা করে তাদের স্তব্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করেছে এবং তা অব্যাহত আছে। নির্বাচন কমিশনে দলটির রেজিস্ট্রেশনও বাতিল করা হয়েছে। জামায়াত-শিবিরের দশ লাখ নেতাকর্মীর উপর বর্তমানে মামলা আছে। জামায়াতের নবনির্বাচিত আমীর বয়োবৃদ্ধ নেতা জনাব মকবুল আহমদ, সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান, নায়েবে আমীর অধ্যাপক গোলাম পরওয়ারসহ সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশই এখন বিনা অপরাধে জেল খাটছেন। যারাই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধাচরণ করবেন তারা সকলেই এখন স্বাধীনতা বিরোধী বলে চিহ্নিত হচ্ছেন। ২০ দলীয় জোট নেত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়ার একাধিক ঘোষণাও সরকারের মন্ত্রীরা দিয়েছেন। তারা শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের সকল পথ ও পন্থা রুদ্ধ করে দিয়েছেন। বিরোধী দলগুলো তাদের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক মানবিক এবং সংবিধান প্রদত্ত অধিকারগুলোও ভোগ করতে পারছেন না। তারা মিটিং মিছিল করতে পারেন না, গণসংযোগ করতে পারেন না, এক সাথে ৪ জন মিলে ঘরোয়া মিটিংয়ে বসলেও বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এ অবস্থায় সব দলকে পঙ্গু করে দিয়ে অসমান মাঠে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী খেলা কত দূর সফল হয় তা অবশ্যই দেখার বিষয়। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী সরকারের কথা বলে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কেননা, নির্বাচনী সরকারের কোনো রূপরেখা সংবিধানে নেই। দেশে এখন ভয়ংকর স্বৈরশাসন চলছে। সরকারের দুঃশাসন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও জীবনযাত্রার দুরাবস্থা, গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংকট, রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট, রাজপথ ও নৌপথের দুরবস্থা, জনমানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও পরিসেবার মূল্য বৃদ্ধি, দুর্নীতি, সরকারী দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সন্ত্রাস, দুর্নীতি, হত্যা, গুম, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জবরদখল, ভর্তি বাণিজ্য প্রভৃতির বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোকে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব ও অধিকার অনুযায়ী রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নেও বাধা দেয়া হচ্ছে। দেশে বর্তমানে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং বিরোধী দলসমূহের উপর জুলুম নির্যাতন আরো ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে এবং এমন অবস্থার সৃষ্টিও হতে পারে যে, নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ ও তার অনুগত দলগুরো ছাড়া আর কাউকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া তার ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বিএনপি জামায়াতকে যে ধোলাই দিয়েছেন তার জবাব বিএনপি জামায়াতের কাছ থেকে দেশবাসী শুনতে চায়। তাদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এ প্রেক্ষিতে তাদের উপর থেকে সকল রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া উচিত। গত কয়েক বছরে সরকারের বিভিন্ন দফতর ও অধিদফতর, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে যেসব লোক নিয়োগ পেয়েছেন তাদের শতকরা ৯০ ভাগ আওয়ামী লীগ ঘরানার লোক, সরকারের দেয়া ছয়টি শর্ত পূরণ করেই তারা চাকরি পেয়েছেন মন্ত্রী, এমপিদের সন্তুষ্ট করে। আনসার ভিডিপি ও পুলিশ বাহিনীতে লক্ষাধিক লোক নেয়া হয়েছে এবং ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহ এদের সরবরাহ করেছেন আওয়ামী চরিত্র দেখে এবং অর্থমন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী পয়সা নিয়ে। প্রশাসন সরকারের হাতে, দলীয় প্রভাবে। সরকার বিচার বিভাগকেও নিয়ন্ত্রণ করছেন। রায় সরকারের বিরুদ্ধে গেলে কি অবস্থা হতে পারে, প্রধান বিচারপতির অপমানজনক অবস্থায় বিদেশ যাত্রা ও পদত্যাগ তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

একথাগুলো এ জন্য বলছি যে, বিদ্যমান অবস্থায় যেখানে সিভিল প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও বিচার বিভাগ সরকারের নিয়ন্ত্রণে সেখানে নিরপেক্ষ অবাধ ও স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ কোথায়? নির্বাচন কমিশন তো সরকারের গৃহপালিত কমিশন হিসাবে কাজ করারই কথা। প্রশাসনের নির্দেশেই তারা চলবেন, চালাবেন। রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইটিং অফিসার ও পোলিং অফিসার হিসেবে যারা নিয়োগ পাবেন তারা তো আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ তথা লীগ পরিবারেরই সদস্য। তাদের জনগণ চিনে এবং তাদের আচার আচরণ ও জনগণের জানা। এরপর আসে ভোটার তালিকা। এ তালিকা গত কয়েক বছরে প্রায় ৭ বার সংশোধন হয়েছে এবং এই সংশোধনের কাজে ছাত্রলীগ যুবলীগ কর্মীদেরও ব্যবহার করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে যে, তারা বিরোধীদলীয় লোক শনাক্ত করে যোগ্য লোকদের তালিকাভুক্ত করেননি এবং আওয়ামী ঘরানার নাবালকদেরও তালিকাভুক্ত করেছেন। ভুয়া ভোটার তো আছেই। এই অভিযোগগুলোর তদন্ত হওয়া উচিত এবং ভোটার তালিকা অবিলম্বে জনসমক্ষে প্রকাশ করে তার সত্যাসত্য যাচাই কারা দরকার।
সরকারী দলের নিজের অথবা প্রতিবেশী কোনও দেশের ব্ল প্রিন্ট অনুযায়ী নির্বাচন হোক দেশবাসী তা চায় না। তারা নির্বাচন চায়, তবে সে নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে নিরপেক্ষ অবাধ ও সুষ্ঠু পন্থায় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। নির্বাচন মাঠ সকলের জন্য সমান সমৃণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। নির্বাচনের পূর্বে অবশ্য অবশ্যই সকল রাজবন্ধীর নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। রেজিস্ট্রেশনের শর্ত তুলে নিয়ে সকল দলকে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। সর্বোপরি রাজনৈতিক ও নির্বাচনী কর্মকাণ্ডের উপর থেকে সকল বাধা অপসারণ করতে হবে। তা না হলে নির্বাচন কোন সুফল বয়ে আনবে না।

http://www.dailysangram.com/post/315451