১৫ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ১:৪৩

দীন প্রতিষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কর্মকৌশল

-ডা. শিরিন আক্তার রুনা

আল্লাহ তায়ালার পরিচয় আমার পুঁজি,

পরিশুদ্ধ জ্ঞান আমার দীনের ভিত্তি

ভালোবাসা আমার মূলনীতি

আগ্রহ আমার বাহন

মহান আল্লাহর স্মরণ আমার সঙ্গী

আল্লাহর ওপর নির্ভরতা আমার ভাণ্ডার

নামাজের মধ্যে রয়েছে আমার দৃষ্টির প্রশান্তি

জ্ঞান আমার হাতিয়ার

ধৈর্য আমার ভূষণ,

আল্লাহর সন্তুষ্টি আমার গণিমত

বিনম্রতা আমার গৌরব

বিশ্বাস আমার শক্তি,

ন্যায়-পরায়ণতা আমার সহচর

আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যেই আমার মর্যাদা

সত্যের পথে সংগ্রাম আমার প্রকৃতি।

হজরত আলী (রা.) নবী করীম (সা.)-এর কাছে তার রীতিনীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এভাবে চমৎকার উত্তর দেন রাসূল (সা.)। সুবহানাল্লাহ! কী অসাধারণ, কী চমৎকার চারিত্রিক মাধুর্য। হ্যাঁ, মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী নিছক সাধারণ কোনো ব্যক্তি জীবনী নয়, বরং তা হচ্ছে এমন এক ঐতিহাসিক শক্তির জীবন বৃত্তান্ত যা একজন মানুষের আকারে আবির্ভূত হয়েছিল। এটা জনজীবন বিচ্ছিন্ন এমন এক দরবেশের কাহিনী নয়, যিনি লোকালয়ের এক প্রান্তে বসে শুধু নিজের সংশোধন ও আত্মগঠনের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বরং এই হচ্ছে এমন এক ব্যক্তির জীবন কাহিনী, যিনি ছিলেন একটা সামষ্টিক আন্দোলনে চালিকাশক্তি। এটা শুধু একজন মানুষের নয়, বরং এ হচ্ছে নতুন মানুষ গড়ার কারিগর এ জীবন কাহিনী। এই জীবন কাহিনীতে রয়েছে এক নতুন বিশ্ব নির্মাতার কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের বিস্তারিত বিবরণ। প্রখ্যাত লেখক নঈম সিদ্দিকী রাসূলের বৈশিষ্ট্য এভাবে তুলে ধরেছেন:

‘রাসূল (সা.)-এর জীবনের প্রতিটি দিক অন্যান্য দিকের সাথে পুরোপুরি ভারসাম্যপূর্ণ এবং প্রতিটি দিক একইরকম পূর্ণতা ও উৎকর্ষতা দ্বারা শোভিত। যেখানে গুরুগম্ভীরতার প্রতাপ রয়েছে যেখানে সৌন্দর্যের চমকও রয়েছে। সেখানে আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি রয়েছে বৈষয়িকতার সমন্বিত অবদান। পরকালের চর্চার পাশে হাত ধরাধরি করে রয়েছে অর্থনৈতিক চিন্তা ধারাও। দীনের সাথে আছে দুনিয়াও। এক ধরনের আত্মনিবেদিত ভাব থাকলেও সেই সাথে আত্মমর্যাদাবোধও  রয়েছে অম্লান।

‘আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী পাশাপাশি বিরাজ করছে আল্লাহর বান্দাদের প্রতি স্নেহ মমতা ও তাদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। কঠোর সামষ্টিক শৃঙ্খলার সাথে রয়েছে ব্যক্তির অধিকারের প্রতি সম্মানও। প্রগাঢ় ধর্মীয় চেতনা ও আবেগের সাথেই অবস্থান করতে সর্বাত্মক রাজনীতিও। জাতির নেতৃত্ব প্রদানে অষ্টপ্রহর ব্যস্ত থাকলেও সেই সাথে দাম্পত্য জীবনের কর্মকা-ও সম্পাদিত হচ্ছে সুচারুভাবে। মজলুমদের সাহায্যের পাশাপাশি জালেমদের প্রতিরোধের ব্যবস্থা রয়েছে সমানভাবেই।’

রাসূল (সা.)-এর  জীবনচরিত আমাদের মধ্যে যথার্থ প্রতিফলন ঘটাতে পারে কেবল তখনই, যখন আমরা রাসূলের সমগ্র জীবন যে মহান কাজে নিয়োজিত ছিল এবং মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নের সর্বাত্মক সংগ্রামে উৎসর্গিত ছিল, সেই একই লক্ষ্যে একই সংগ্রামে আমাদের জীবনকেও উৎসর্গ করতে পারব।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রাসূল (সা.)কে প্রথম যে নির্দেশ দেন তা ছিল:

‘পড়! তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’

(সূরা আলাক : ১)।

এবং পরবর্তী নির্দেশনা ছিল:

‘হে চাদরাবৃত ব্যক্তি! জড়তা ছেড়ে ওঠ এবং মানবজাতিকে সতর্ক ও সাবধান কর’

(সূরা আল মুদ্দাসসির : ১-৩)।

রাসূল (সা.)কে দুনিয়ায় পাঠানোর উদ্দেশ আল্লাহ স্পষ্ট করে ঘোষণা করেছেন

‘তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত এবং দীনে হক দিয়ে পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি এ দীনকে অন্য দীনের ওপরে বিজয়ী করে দেন: মুশরিকদের নিকট তা যতই অপছন্দনীয় হোক না কেন।’  (সূরা তাওবা : ৩৩)।

উপরোক্ত আয়াতগুলোর দিকে খেয়াল করলেই খুব স্পষ্ট করেই বোঝা যায় রাসূল (সা.)কে এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে মানবজাতিকে সতর্ক করতে, পথ দেখাতে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পরিচয়, শ্রেষ্ঠত্ব মানব জাতির কাছে তুলে ধরতে তার আনুগত্য, হুকুম, নির্দেশের আলোকে পরিচালিত হতে। সর্বোপরি আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠা করতে, বিজয়ী করতে।

আর এই দীনকে বিজয়ী করতে, এই গুরুত্বপূর্ণ বিরাট দায়িত্ব পালন করতেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জ্ঞানার্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। যে জ্ঞান দীন আন্দোলন পরিচালনায় সহায়ক শক্তি, কাজের কৌশল নির্ধারণের হাতিয়ার, সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়নের মজবুত ভিত্তি। যে জ্ঞান রাসূল (সা.) অর্জন করেছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত আল কুরআনের মাধ্যমে। বুদ্ধি, বিবেচনা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, হিকমত, মেধা ও মননের অদ্ভুত এক সমন্বয় ছিল রাসূল (সা.)-এর চরিত্রে। নিজ জাতি ও সমাজের প্রতিটি সঙ্কটময় মুহূর্তে তিনি এই অনুপম বৈশিষ্ট্য, নৈতিকতা, বিচক্ষণতা, আধ্যাত্মিক ও মানবীয় গুণাবলীর দ্বারা সমাজকে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করেছেন। কা’বা গাত্রে কৃষ্ণ কালো পাথর স্থাপন সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে তার ওপর জনতার পূর্ণ আস্থা এবং তার প্রজ্ঞাপূর্ণ সমাধানের প্রতি গোটা আরব সম্প্রদায়ের সানন্দে সমর্থন ও অংশগ্রহণ থেকে মানুষ মহানবী (সা.)-এর সমাজসেবা ও সাংগঠনিক সমাজকল্যাণ কর্মসূচি এবং তার গণমুখী নীতির প্রমাণ পায়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত গোত্র, পর্যুদস্ত জনগোষ্ঠী ও অনাথ পিতৃহীনদের পুনর্বাসন সংস্কার ইত্যাদি সর্বপ্রথম তিনিই আরবদের শিখিয়েছেন। হিলফুল ফুযুল বা ফজলগণের অঙ্গীকার তার সামাজিক কর্ম সাধনারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিশ্বাস, আস্থা, জনপ্রিয়তার লাইম লাইটে উঠে আসাও কি একজন উদীয়মান জননেতা ও যুব ব্যক্তিত্বের সুনিশ্চিত কর্মকৌশলের প্রমাণ বহন করে না?

নবী করীম (সা.) চাচা আবু তালিবের ঘরে জীবনযাপন করলেও ব্যক্তিগত কর্ম ও দায়িত্ব পালন থেকে কখনোই পিছিয়ে যাননি। চাচার পরিবারের ঘরোয়া কাজে অংশগ্রহণ এবং তার পেশাগত দায়িত্বে সহযোগিতাই রাসূল (সা.)-এর মানবিক নৈতিকতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। চাচার সহযাত্রী হয়ে অখ- শামের উদ্দেশে বাণিজ্য যাত্রা তরুণ মুহাম্মদের সমাজ ও জীবন ঘনিষ্ঠতারই বহিঃপ্রকাশ। তিনি যখন দৃষ্টি দিলেন বিশাল ভুবনে, দেখলেন জীবন সংগ্রামের বিস্তৃত ময়দান। ব্যবসায়ী খাদিজা বিনতে খুওয়াইলদের বাণিজ্য কাফেলার ব্যবস্থাপক নিযুক্ত হয়ে গেলেন বাণিজ্যে। সুন্দর ব্যবস্থাপনা, সুদক্ষ পরিচালনা আর বিশ্বস্ততায় প্রচুর লাভ হলো বাণিজ্যে। বাণিজ্য কর্মীদের রিপোর্ট শুনে হজরত খাদিজা যুবক মুহাম্মদের সাথে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। মা খাদিজা হলেন নবুয়্যত পূর্বকালীন কর্মতৎপরতার একনিষ্ঠ সহায়িকা। নবী পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আরো ছিলেন ক্রীতদাস যায়েদ ইবনে হারিসা, যিনি নবীজীর পুত্র পরিচয় লাভ করেন, আর আদরের ছোট ভাই আলী (রা.)। চল্লিশ বছর বয়সে নবীজী নবুয়্যত লাভ করেন। যার আহ্বানে খাদিজা, আলী, যায়েদ প্রিয়নবীর প্রতি ঈমান এনে নতুন দীনের প্রথম মহিলা, কিশোর ও ক্রীতদাস সদস্যরূপে ইতিহাসে আসন লাভ করেন। আর বাইরের পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ঈমান আনয়নকারী হিসেবে মর্যাদা পান রাসূল (সা.)-এর ঘনিষ্ঠ সহচর, বন্ধু আবু বকর (রা.)। স্বাবলম্বী হওয়া, পরিবার গঠন, জীবিকার উপায় অবলম্বন, সামাজিক প্রতিষ্ঠার ভিত গড়া, পরিবার ও নিকটজনের আস্থা ও বিশ্বস্ততার  চমৎকার এই অবস্থান কি উত্তম কর্মকৌশলের সংজ্ঞার আওতায় পড়ে না?

রাসূল (সা.)-এর নবুয়্যত প্রাপ্তির পর সর্বপ্রথম তার নিকটাত্মীয়দের আল্লাহর উলুহিয়াত মেনে নেয়ার আহ্বান করেন। সত্যের দাওয়াত দানের সেই পদ্ধতি ছিল অসাধারণ। নবীজি নিজ গৃহে খানার দাওয়াত দিয়ে জমায়েত করলেন কুরাইশ হাশেমী নেতৃবৃন্দকে। আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা করলেন অতি বিনয় এবং আত্মবিশ্বাস ও বলিষ্ঠতার সাথে। কাজ হলো না তবে কম্পন সৃষ্টি হলো।

গোত্রবাসীর কাছে দাওয়াত পৌঁছালেন সেই সময়ের আরবের প্রচলিত নিয়মের আলোকেই। আবু কুবায়স পর্বতে আরোহণ করে ঘোষণা দিলেন তাওহীদের। ইসলামের প্রকাশ্য আহ্বান প্রচারের এ সূচনালগ্নে ব্যবহার করলেন ভাষা-বক্তৃতার এক নিটোল কৌশল। আমি যদি বলি এ পর্বতের পিছন থেকে এক দুর্ধর্ষ শত্রুদল ধেয়ে আসছে তোমাদের তছনছ করে দিতে, তোমরা কি বিশ্বাস করবে না? আরও বললেন, ‘এক জীবন কাটিয়েছি আমি তোমাদের হয়ে। আমাকে তো তোমরা সত্যবাদী ও বিশ্বাসীরূপেই দেখেছো।’ এভাবেই বিশ্বস্ততার একটি পরিবেশ তৈরি করে পৌঁছে দিলেন নতুন বার্তাটি।

রাসূল (সা.)-এর ভাষা, বক্তৃতা, অসাধারণ এক কর্মকৌশলের এক উত্তম উদাহরণ। তিনি ব্যাপক অর্থবোধক ও বিশ্লেষণ সাপেক্ষ বিষয়াদি অতি অল্প কথায় সহজে বোধগম্য ভাষায় ব্যক্ত করতেন। নবী করীম (সা.) জনগণের উদ্দেশে পথনির্দেশনামূলক ভাষণ দিয়েছেন। তার ভাষণ কখনো এতটা দীর্ঘ হয়নি যে শ্রোতাদের মনে বিরক্তি সৃষ্টি  করবে অথবা এমন সংক্ষিপ্তও হয়নি যে শ্রোতাদের সঠিক বিষয়টি বুঝাতে অক্ষম হবে। তার পবিত্র মুখ নিঃসৃত বাণিসমূহের প্রতিটি শব্দই ছিল দুষ্প্রাপ্য মণিমুক্তা সদৃশ। প্রতিটি বাক্যই ছিল ব্যাপক অর্থবোধক অথচ সহজবোধ্য। ভাষণে তিনি এমন হৃদয়গ্রাহী ভাষা উচ্চারণ করতেন যা শ্রোতাদের হৃদয় স্পর্শ করতো। বোঝার সুবিধার্থে গুরুত্বপূর্ণ বাক্যসমূহ তিনবার উচ্চারণ করতেন। রাসূল (সা.)-এর এমন কিছু উক্তি তুলে ধরা হলো:

‘মানুষের পাথেয়র মধ্যে সর্বোত্তম পাথেয় হচ্ছে আল্লাহভীতি।’

‘মনের গভীরে প্রতিষ্ঠিত করার শ্রেষ্ঠ বিষয় হচ্ছে বিশ্বাস।’

‘সৌভাগ্যবান হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে অন্যের কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ করে।’

‘আত্মার প্রাচুর্যতাই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাচুর্যতা।’

‘স্বল্পতম সম্পদ যা প্রয়োজন পূরণের জন্য যথেষ্ট তা ঐ বিশাল সম্পদের তুলনায় উত্তম যা মানুষকে আল্লাহর দাসত্ব থেকে অমনোযোগী করে দেয়।’

‘সুচিন্তিত ও দৃঢ় সংকল্পের কর্মই হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম কর্ম।’

‘সবচেয়ে বড় অন্ধ হলো সেই পথভ্রষ্টতা যা সত্য সঠিক পথ শেখার পরও মানুষ তা গ্রহণ করে।’

নবী করীম (সা.) মদীনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার পরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজা বাদশাহ, সম্রাট তথা শাসকবৃন্দের কাছে পবিত্র কুরআনের আহ্বান পৌঁছানোর লক্ষ্যে দূতের মাধ্যমে পত্র প্রেরণ করতেন। রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে তিনি যে পত্র প্রেরণ করেছিলেন সেখানে তিনি লিখেছিলেন ‘মুসলিম হও তাহলে শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারবে।’

এছাড়া রাসূল (সা.)-এর হাদীসের বিশাল ভা-ারের দিকে তাকালেও চমৎকৃত হতে হয় প্রাঞ্জল, সহজ, মাধুর্যমণ্ডিত বর্ণনা দেখে।

বিরোধিতা যখন চরম পর্যায়ে আরকাম (রা.) এফ ঘরে তখনও প্রিয়নবীর মিশন চলছেই। রাতের আঁধারে নতুন মুসলমানরা সমবেত হয় এই ঘরে, আবার ফর্সা হবার আগেই তাদের ফিরে যেতে হয় নিজ নিজ ঠিকানায়। রাসূল (সা.) দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! খাত্তাবের পুত্র ওমর অথবা আবুল হিকাম ওমর, এদের একজনকে ইসলামের জন্য কবুল করো।’

  প্রভাবশালী ব্যক্তির দুর্বিনীত উত্থান ছাড়া শান্ত, নিরীহ ও সরল মানুষের এ ছোট্ট কাফেলাটি অবরোধ ভাঙতে পারছে না। আঁচ করতে পেরেই নবীজি এ দোয়া করেছিলেন এবং খাত্তাব পুত্র ওমর ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামের অন্তর্নিহিত শক্তিতে ব্যক্তিগত প্রভাব মিশিয়ে দারুল আরকামের গোপন নামাজকে কায়েম করে দিলেন কাবা প্রাঙ্গণে।

জুলুম-নির্যাতন যখন মাত্রা ছাড়িয়ে গেল তখন রাসূল (সা.) সাহাবীদের আবিসিনিয়ায় হিজরতের নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেন, তোমরা যদি মক্কা ভূমি ত্যাগ করে হাবশায় চলে যেতে পারো সেখানে এমন একজন বাদশাহ আছেন যার ওখানে কারো ওপর জুলুম করতে দেয়া হয় না। ওটা একটা ভালো দেশ। তোমাদের বর্তমান বিপদ মুসিবত আল্লাহর পক্ষ থেকে দূর না হওয়া পর্যন্ত তোমরা সেখানেই অবস্থান করো।

হিজরতের জন্য দেশ হিসেবে হাবশাকে বাছাই করাটাও রাসূল (সা.)-এর কর্মকৌশলের অনেক বড় একটি নমুনা। শুধু তাই না তিনি এমন কিছু সাহাবীদেরই হিজরতের জন্য বাছাই করেছিলেন যারা একদিকে ছিলেন নির্যাতিত তেমনি অপরদিকে ছিল উন্নত নৈতিকতার অধিকারী, সাহসী এবং বিচক্ষণ। হিজরতের পর বাদশাহ নাজ্জাশীর দরবারে যখন সাহাবীদের ডাকা হয় তখন সাহাবীরা পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন যে তারা কাটছাট না করে কোনো কিছু না লুকিয়ে গোজামিলের আশ্রয় না নিয়ে স্পষ্টভাবে কুরআনের আয়াত ও ইসলামকে তুলে ধরবেন। এতে বাদশাহ যা সিদ্ধান্ত নেয় নেবে।

বাদশাহ বিভিন্ন প্রশ্নে জাফর বিন আবু তালিব জাহেলি যুগের সমাজ চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি আল্লাহর রাসূলের শিক্ষায় তাদের জীবন যে অর্থবহ  ও বাস্তবসম্মত পরিবর্তন এসেছে  তাও উপস্থাপন করেছেন অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ভাষায় যা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় বাদশাহ নাজ্জাশীর অন্তরে। আমর ইবনুল আসের মতো বিচক্ষণ ব্যক্তির কূটনৈতিক চালের মোকাবিলায় হজরত ঈসা (আ.)-এর নিখুঁত পরিচয় যেভাবে জাফর ইবনে আবু তালিব তুলে ধরেন তা একদিকে যেমন বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করে তেমনি খ্রিষ্টান জগতের কাছে ইসলামের দাওয়াত উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আজকের এই আধুনিক যুগেও একটি রোল মডেলের ভূমিকা রাখতে পারে। দাওয়াত প্রদানের ক্ষেত্রে হিকমত অবলম্বন করতে বলা হয়েছে তার সফল বাস্তবায়ন আমরা এখানেই দেখতে পাই।

রাসূলের প্রকাশ্য দাওয়াতের সূচনালগ্নেই বাতিল শক্তি অনুমান করে ফেলেছিল, আসছে হজের মৌসুমে মুহাম্মদ আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা হাজীদের মধ্যে কুরআন প্রচারের সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। তাই নেতৃস্থানীয় কুরাইশদের এক সম্মেলন ডাকা হয় এবং মুহাম্মদ (সা.) যেন কুরআনের বাণী প্রচার করার সুযোগ না পায় সেজন্য ঐক্যমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে মুহাম্মদকে জাদুকর হিসেবে উপস্থাপন করা হবে এবং সবাইকে এটাই বোঝানো হবে: এ লোকটি এমন ধরনের বাণী প্রচার করছে যে মানুষ তার বাপ, ভাই, বিবি, বাচ্চা এমনকি গোটা খান্দান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এই সিদ্ধান্তের আলোকে কুরাইশদের বিভিন্ন প্রতিনিধি দল হাজীদের মধ্যে প্রচার অভিযানে নামে পড়ে।

বাতিল শক্তির কৌশলের প্রধান দিক সব সময়েই ছিল অপপ্রচার ও মিথ্যা প্রোপাগা-া যা আজকের দিনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কারণে নতুন মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু সত্যের নিজস্ব একটা শক্তি আছে। আপন মহিমায় মিথ্যা প্রোপাগা-ায় সকল ধুম্রজাল ছিন্ন করে সত্য তার স্থান নিতে সক্ষম। আর আল্লাহর বিধান হলো :

‘তারা পরিকল্পনা আটে তাদের সকল সামর্থ্য উজাড় করে আর তাদের মোকাবিলায় আল্লাহও একটা পরিকল্পনা করে থাকে তার শান অনুযায়ী।’ (সূরা আন নামল : ৫০)।

সূরা আত তাওবার ৩২ নং আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন:

‘তারা আল্লাহর নূরকে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিতে চায় কিন্তু আল্লাহ তার নূরকে পূর্ণ করবেনই। কাফেরদের কাছে তা যতই অপছন্দনীয় হোক না কেন।’

উপরোক্ত এই ঘোষণারই বাস্তব প্রতিফলন ঘটে হজের সময়টাতে। কুরাইশদের মিথ্যা প্রচার প্রপাগা-ায় সবাইকে মুহাম্মদ (সা.)-এর কথা শুনতে, কাছে যেতে আগ্রহী করে তোলে। আল্লাহর রাসূল (সা.) এই সুবর্ণ সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগালেন। যার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে আকাবার শপথ অনুষ্ঠিত হয়। এটা ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক চেতনায় উজ্জীবিত চুক্তি।

এতে রাসূল (সা.)-এর হিজরত করে মদীনায় চলে যাওয়া স্থির হয় এবং এমন সর্বাত্মক ত্যাগের মনোভাব প্রতিফলিত হয় যে, মদীনার আনসারগণ রাসূল (সা.)-এর জন্য সমগ্র দুনিয়ার সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত থাকার ঘোষণা করেন।

হিজরতের সময় হজরত আলী (রা.)কে বিছানায় শুইয়ে রেখে যান: এর উদ্দেশ ছিল যে কেউ বলতে না পারে যে, মুহাম্মদ আমাদের গচ্ছিত আমানত, টাকা পয়সা গহনাগাটি সাথে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। কঠিন বিপদের এই মুহূর্তেও আমানতদারিতার এই দৃষ্টান্ত  যুগে যুগে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে।

হিজরতের পথে মদীনায় যাওয়ার পরিচিত পথটি মক্কা থেকে উত্তরের দিকে চলে গেলেও রাসূল (সা.) গিরি গুহায় দক্ষিণের রাস্তাকে বেছে নেন। মজার বিষয় হলো সওর গিরি গুহায় আশ্রয় নেয়ার লক্ষ্যে নবিজী বেছে নিয়েছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী এই রাস্তাটি। যেন মনে হয় তিনি ইয়ামিন বা হাদরামাউত যাবেন বলে মক্কা ছাড়ছেন। কি চমৎকার কর্মকৌশল প্রয়োগ করলে নবী মোহাম্মদ (সা.)।

মদীনার পথে একলোক হজরত আবু বকর (রা.)কে ডেকে বললেন: ‘আপনার সাথী লোকটিকে তো চিনতে পারলাম না?’

খুবই সতর্কভাবে সাবধানী জবাব দিলেন, ইনি? ইনি আমার রাহবার। পথ দেখানো তার কাজ। শঙ্কা কেটে গেলে নবীজি মৃদু হাসলেন এবং এই রহস্যময় উত্তরে হর্ষ প্রকাশ করলেন। লোকটি বুঝতে পারলো যে, নবীজি বোধ হয় আবু বকরের মরু ভ্রমণে পেশাদার কোনো পথ প্রদর্শক।

সত্যিই তো তিনি রাহবার। সত্য পথের দিশারী। বাচনিক কৌশলের এ ঘটনার প্রতি ব্যক্ত সমর্থন থেকে আমরা রাসূল (সা.) এর আদর্শের প্রাণময়তার সন্ধান পাই।

মদীনায় হিজরতের পূর্বেই মুসআব ইবনে উমায়েরকে (রা.) ইসলামী আদর্শ প্রচারের লক্ষ্যে প্রেরণ করা হয় এবং হজ মৌসুমে মদীনা থেকে আগত ব্যক্তিবর্গের সাথে চুক্তির মাধমে মদীনায় প্রিয় নবী (সা.)-এর পূর্ণ পরিচিতি ও তার আনুগত্যের প্রস্তুতিপর্ব সমাপ্ত হয় তখনই আল্লাহর নির্দেশে তিনি মুসলিম জনগোষ্ঠীসহ সে নগরীতে হিজরত করেন। মদীনার প্রত্যেক পরিবারের আকুল ইচ্ছা ছিল নবীজি তার ঘরেই আবাস গ্রহণ করবেন। সবার এই জোরদার আবেদন একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিলে তিনি উটের সাহায্য নেন। তিনি বললেন, এর পথ ছেড়ে দাও, উটনীটিই আল্লাহর আদেশক্রমে সঠিক স্থানে গিয়ে থামবে। হজরত আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) যখন রাসূল (সা.)-এর বসবাসের জন্য নিজেদের বেতন হিসেবে দ্বিতল গৃহটি ছেড়ে দিচ্ছিলেন নবীজি বললেন, আমার জন্য উপরের নয়, নীচের অংশটি খালি কর। লোকজন আসবে, বৈঠক হবে, তুমি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে ওপরের কোঠায় থাকো। মসজিদে নববীর জন্য যে জায়গাটিকে ক্রয় করা হয়, এটি সাহল ও সোহায়েল ভ্রাতৃদয় বিনা পয়সায় রাসূল (সা.) দিতে চাইলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। পিতৃহীনদের দান নিয়ে ইসলামের প্রথম কেন্দ্রীয় মসজিদ নয়, টাকা দিয়ে এটা কিনতে হবে। সাহল ও সোহায়েল বিনিময় গ্রহণ করলো। গোত্রীয় অসন্তোষ নিরসনে উটের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়া, বসবাসের জন্য গৃহের নিচের অংশ নির্ধারণ এবং মসজিদ নববী নির্মাণে অনাথদের ভূমি নগদ মূল্যে ক্রয় ইত্যাদি কর্মকৌশল নিঃসন্দেহে নিপুণ ও তাৎপর্যপূর্ণ।

হিজরত উত্তরকালে মদীনায় ইসলামী সমাজ কায়েমের সূচনাপূর্ব মুহাজিরের পুনর্বাসন মদীনাবাসী আনসারের একজনকে একজন মুহাজিরের দায়িত্বভার দেয়ার সুন্দর ও সহজ নিয়মে যে চিরন্তন ধর্মীয় ও সামাজিক বন্ধন রচিত হয় তার প্রভাবে গোটা ইসলামী যুগেই তার সুফল অব্যাহত রাখে। এতে করে মদীনায় শরণার্থী শিবির গড়ে ওঠেনি যা পৃথিবীর ইতিহাসে অদ্বিতীয় এক ঘটনা।

মদীনার প্রাচীন গোত্রগুলো নানা ধর্মাবলম্বী নাগরিক, বিভিন্ন পেশার অধিববাসী নিয়ে রাসূল (সা.) একটি ঐতিহাসিক সমঝোতা স্মারক রচনা করেন যা ‘মদীনা সনদ’ নামে পরিচিত। এই সামাজিক সংবিধান ছিল দল-গোত্র-ধর্ম স্বার্থে পেশা ও নীতি নির্বিশেষে সকল মদীনাবাসীর উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দলিল।

এই কাজটি বিশ্বনবীর কর্ম পরিকল্পনা ও কৌশলের প্রকৃষ্টততম প্রমাণ রূপে আমার উল্লেখ করতে পারি।

মদীনার নগরকর্তা হলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তার সাথে ইহুদি, অগ্নিপূজক ও মুশরিকদের ও সুন্দর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থেকে ইসলামের সার্বজনীন আদর্শ ও বিশ্বশান্তির ধারণা পাওয়া খুব সহজে হয়ে ওঠে। প্রতিরক্ষা, সামাজিক সুবিচার, পেশাগত স্বাধীনতা, নৈতিক স্বকীয়তা, ধর্মীয় স্বাধিকার ও নাগরিক আনুগত্য বা শৃঙ্খলার মূলমন্ত্র নিয়ে রচিত হয় এই বহুজাতিক বহুমাত্রিক দলিল। এর মাধমেই সম্ভব হয়েছিল ইসলামের ধর্মীয় জিহাদে অমুসলিম নাগরিকদের সামাজিক অংশগ্রহণ। অমুসলিম মুনাফিকদের দল নিয়ে প্রিয় নবী যাত্রা করেছিলেন হক ও বাতিলের লড়াইয়ে। ওহুদ প্রান্তরে পৌঁছার পথে দুর্বলচেতা মুনাফিকরা কেটে পড়ে, তথাপিও রাসূল (সা.) প্রকাশ্যে এদের সমালোচনা, বহিষ্কার বা বিচার করেননি কেননা ঐক্য, সংহতি ও সামাজিক শৃঙ্খলা একজন শাসকের ইমেজকে শত্রুশক্তির সামনে উজ্জ্বল ও প্রভাবশালী রূপে তুলে ধরে।

অন্তর্দ্বন্দ্ব ও আত্মঘাতী তৎপরতায় সংবাদ শত্রুদের মধ্যে সাহস ও শক্তির বৃদ্ধি করে। মক্কার মুশরিকরা মদীনা আক্রমণ পরিচালনা করে প্রিয় নবীর নব অংকুরিত সুখী সমাজের ভিত তছনছ করে দেবার পরিকল্পনা আঁটে। অর্থ রসদ ও অস্ত্রের যোগান দেয়ার জন্য তারা যৌথ বাণিজ্যের কাফেলাসহ আবু সুফিয়ানকে অক্রমণ চালানোর মাধ্যমে শত্রুর সমর শক্তি বিনাশ এবং নিজেদের ফেলে আসা সম্পদ ও অধিকার আদায়ের যৌক্তিকতা নিয়ে মদীনার প্রতিরক্ষাবাহিনী ঘুরে বেড়ায় মক্কা, সিরিয়া মহাসড়কে। গোপনে গোপনে খবর পেয়ে আবু সুফিয়ান সমুদ্রে তীর বেয়ে মক্কায় পৌঁছে যায়। কিন্তু আক্রমণের নেশা তাকে আবারো টেনে আনে নিরীহ মদীনার পানে। বদর প্রান্তরে যুদ্ধ বাঁধে। এরপর ওহুদ যুদ্ধ। যুদ্ধে রাসূল (সা.)-এর তাঁবু স্থাপন এবং জায়গা নির্ধারণ, সৈন্য বণ্টন, কাতারবন্দি, নেতৃত্ব ও দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেন।

সকল বিরোধী শক্তির সমন্বিত অভিযান, আহযাবের যুদ্ধে নবীজি তার অনুচর ইরানের সালমান ফারসির (রা.) পরামর্শ গ্রহণ করেন আরব বিশের অভিনব সমর পদ্ধতি। পরিখা খননের মাধ্যমে অরক্ষিত সীমান্তে ব্যারিকেড সৃষ্টির প্রয়াস। যা আরবীয় যোদ্ধাদের জন্য ছিল বিস্ময়কর। এছাড়াও প্রতিটি কাজে সাধনায় সংগ্রামে সাধারণ সৈনিকদের সাথে মহানবীর উদার অংশগ্রহণ, কাজের স্পৃহা গতি ও উৎকর্ষকে করে তুলতো বহুগুণে তেজী ও সাহসী। খন্দক বা পরিখা খননের সময় সাহাবীরা ক্ষুধাও তৃষ্ণার অবস্থাকে নবীজিকে অবহিত করলে তিনি নিজের পেটের দুখানা পাথর বেধে নিলেন পিঠকে সোজা রাখার জন্য যা ক্ষুধা কাতর সব সাহাবীরা অনুসরণ করল এবং সব সাহাবীদের ডেকে ঘোষণা করেন ‘পরিখা খননে কোদাল চালনায় ছিটকে পড়া পাথর খন্ডের ওপর থেকে বিচ্ছ্যুরিত অগ্নিস্ফূলিঙ্গ আমি পারস্যে রাজকীয় প্রসাদ দেখতে পাই। এ সবই তোমাদের করতলগত হচ্ছে অচিরেই।’

শত্রুর অর্থনৈতিক উৎস সমৃদ্ধির মূলে আঘাত, আক্রমণাত্মক, দুশমনদের বিরুদ্ধে লড়াই, সহচরদের পরামর্শ ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো, ভিনদেশী প্রযুক্তি ব্যবহার, কর্মতৎপরতায় নিজের অংশগ্রহণ ইত্যাদি থেকেও উত্তম কর্মকৌশল ও সুন্দর পরিকল্পনার দিকনির্দেশনাই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বদরের বন্দীদের মধ্যে যারা মুক্তিপণ পরিশোধে অক্ষম, তাদের জন্য নবীজি শর্ত জুড়ে দেন- এরা প্রত্যেকে যেন মদীনার দশজনকে সাক্ষর ও শিক্ষিত করে তোলে। এই তাদের মুক্তিপণ। এ কেমন কর্মনৈপুণ্য। কত সুন্দর সমাধান!

নবুয়্যতের দশম বছর ছিল নবীজির জন্য শোকের বছর। এই বছরই তিনি তার অভিভাবক চাচা আবু তালিব এবং সুখ-দুঃখের বিশ্বস্ত সাথী বিবি খাদীজা (রা.)-কে হারান। বৈষয়িক ও মানসিক দুই দিক দিয়েই যারা ছিলেন রাসূলের (সা.) বড় অবলম্বন একদিকে মানসিক চাপ ও অপর দিকে কাফিরদের বেপরোয়া আচরণ মাত্রাতিরিক্ত জুলুমের অতীষ্ঠ হয়ে রাসূল (সা.) তাই যে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন দিনে দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য। কিন্তু সেখানেও তায়েফের নেতৃবৃন্দের নির্দেশে গুণ্ডা ও দুষ্টু প্রকৃতির যুবকরা এমনভাবে আহত করে যে তা বর্ণনাতীত। পাথরের পর পাথর মেরে রাসূল (সা.)-এর শরীরকে অসাড় করে দেয় এবং কিছু সময়ের জন্য রাসূল (সা.) বেহুঁশ হয়ে যান। আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত নবী মুহাম্মদ (সা.) ওতবা ও শায়বার আঙ্গুর বাগানের প্রাচীরের গা ঘেঁষে আঙ্গুর লতার ছায়ায় বসে পড়েন এবং খুবই চমৎকার মর্মস্পর্শী ভাষায় দোয়া করলেন। সাথে তায়েফবাসীর জন্য দোয়া করলেন তাদেরকে আল্লাহ যেন মাফ করে দেন। সেই মহানুভবতা, ক্ষমাশীলতা ইতিহাসের পাতায় যুগে যুগে অম্লান হয়ে থাকবে ।

রাসূল (সা.) এই মহানুভবতা ও কষ্টকর অবস্থা এবং সেই অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত শুনে মুগ্ধ হয়ে জ্বীন জাতির একটি অংশ রাসূল (সা.)-এর  কাছে এসে তাওহীদের ঘোষণা দেন। এবং নিজেদের কওমের কাছে দাওয়াত দেয়া শুরু করলেন ।

রাসূল (সা.) যখন আঙ্গুর বাগানে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পড়ে ছিলেন তখন ওতবা বিন রাবিয়া এবং শায়রা একটি বড় পাত্রে কয়েক গোছা আঙ্গুর পাঠালেন এক ইসায়ী গোলামের মাধ্যমে। রাসূল (সা.) গোলামের নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর দেন তার নাম আদ্দাস, ঈসায়ী এবং মিনওয়ার অধিবাসী। এরপর রাসূল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন তুমি কি মর্দে সালেহ ইউনুস বিন  মাত্তাব বস্তির লোক? আদ্দাস জানতে চাইলে আপনি কিভাবে তাকে চেনেন? রাসূল উত্তর দিলেন, তিনি তো আমার ভাই, তিনিও নবী আর আমিও নবী। এই কথা শোনামাত্র আদ্দাস নবী (সা.)-এর দিকে ঝুঁকে পড়ল এবং কালেমায়ে শাহাদাত উচ্চারণ করে ঈমানের ঘোষণা দিল। এবার রাসূল (সা.) মক্কার দিকে যাবার কৌশল নির্ধারণের চিন্তা করতে লাগলেন এবং হেরায় পৌঁছার পর বনি আবদে মানাফের একটি শাখা বনি নওফেলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি মুতইম বিন আদির নিকট আব্দুল্লাহ বিন উবাইকেও পাঠালেন। কুরাইশদের  যে পাঁচজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে আবু তালিবের বন্দী জীবনের অবসান ঘটানোর ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন মুতইম বিন আদী তাদের একজন। তিনি এ কঠিন বিপদের মুহূর্তে রাসূল (সা.)কে আশ্রয় দানের ঘোষণা করেন।

 রাসূল (সা.) এর সফর ক্ষমাশীলতা, মর্মস্পর্শী দোয়া, গোলামের সাথে কথোপকথন, এবং মক্কায় ফিরে আসার যে কৌশলী ভূমিকা অবলম্বন করলেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং বাস্তবসম্মত।

হুদায়বিয়ার সন্ধিতে সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল কৌশলগুলো ইতিহাস সংরক্ষণ করেছে। রাসূল (সা.) সহস্রাধিক সাহাবীকে নিয়ে মক্কা সীমান্তে হুদাইবিয়ায় গিয়ে পৌঁছালেন। হজরত উসমান (রা.) গেলেন মক্কা নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে । প্রস্তাব : এবছর মোহাম্মদ (সা.) তার সহচরদের  নিয়ে আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করবেন । আত্ম রক্ষার তরবারি তাদের কোষবদ্ধ থাকবে । সমরসজ্জা থাকবে না । কিন্তু না, কাফের এতে রাজি হলো না। হুদাইবিয়ার নেতা সোহায়েল এলো সন্ধি চুক্তি সই করতে।

শর্ত: এ বছর নয় আগামী বছর ওমরা করবেন তারা । কোন ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণ করে মদীনা থেকে পালিয়ে গেলে তাকে মক্কাবাসীর হাতে তুলে দিতে হবে তবে কেউ মদিনা থেকে মুরতাদ হয়ে মক্কা পালিয়ে এলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে না ইত্যাদি। উমরা ও মাতৃভূমি ভ্রমণের উদ্বেলিত উৎসাহে বিপত্তি আর বিনীত সন্ধি চুক্তির শোকে সাহাবীরা ক্ষুব্ধ এবং শোকাহত। হজরত ওমর উচ্ছ্বসিত আবেগে আপ্লুত হয়ে নবীজি কে জড়িয়ে ধরে অবোধ শিশুর মতো বলে উঠলেন, ‘ও নবী! আমাদের মিশন কি সত্যনিষ্ঠ নয়? আপনি কি সত্য নবী নন ? তবে কেন এত অবমাননা, এত গ্লানি স্বেচ্ছায় মেনে নিতে হবে আমাদের?”  অব্যক্ত উচ্চারণের সাথে সব সাহাবী সোচ্চার-” মর্যাদার লড়াইয়ে আমরা জীবন দিতে প্রস্তুত।’

 অপূর্ব ধৈর্য ও অফুরন্ত স্থিরতা। শান্ত সৌম্য অবয়বে আনত-নয়নে প্রিয় নবী (সা.) কেবলই অন্তর্মুখী। এতেই রয়েছে আমাদের সুস্পষ্ট বিজয়। মহাপ্রাপ্তি। এখানে শক্তি নয় যুক্তির হবে জয়। আবেগের নয় ত্যাগের। প্রাবল্যের নয় বিনম্রতার, সদাচারের।

তিনি সাহাবীদের মাথা মুড়িয়ে পশু কোরবানির নির্দেশ দিলেন। শোক ও অবদমিত উদ্বেলতায় সব অনড় ও নিশ্চল। নবীজি তাঁবুতে গিয়ে বিবি উম্মে সালমা বললেন ওরা যে আমার নির্দেশনা শুনছে না। উম্মে সালমা বললেন, আপনি মৌখিক নির্দেশনা আর দেবেন না। নিজে গিয়ে এ আমলগুলো শুরু করে দিন দেখবেন জানবাজ সাহাবীরা কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে নিমিষেই। আর ঘটলো তাই। দুই বছর পার হয়ে গেল। এর মধ্যেই সন্ধি চুক্তির সর্বপ্লাবী সুফল ইসলামকে বহুদূর এগিয়ে নিয়েছে। দুই হাজারের কম সাথী নিয়ে হুদায়ইবিয়ার অভিযাত্রী এবার দশ সহস্র সঙ্গী নিয়ে চলল মক্কা জয়ে। আল্লাহ কতই শক্তিমান, কত মহান।

রাসূল (সা.) বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে যখন  মাজরুয রাহবান বানিয়েতে পৌঁছলেন এবং সেনা শিবির স্থাপন করলেন তখন প্রত্যেক সৈন্যকে নির্দেশ দিলেন প্রত্যেকে যেন আলাদা আলাদা চুলো জ্বালায় । কুরাইশদের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ যখন সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে আসলো তখন পাহাড় থেকে দশ হাজার চুলো জ্বলতে দেখে তারা স্তম্ভিত হয়ে গেল। ভাবলো, কি সর্বনাশ এত বড় সেনাবাহিনী চলে এসেছে মক্কার দোরগোড়ায়? ভয়ে তাদের কণ্ঠ স্তব্ধ হয়েই গেল। রাসূল(সা.)-এর এই কৌশল কুরাইশদের প্রচ- ভড়কে দিল এবং তা দেখে হতাশ করে দিল।

শত্রুর সাথে সংঘাতের চেয়ে কৌশলগত সমঝোতা ভালো। নীতিহীন প্রতিপক্ষের সাথে চুক্তিই উত্তম কেননা এটা তারা সহজেই ভঙ্গ করে এবং বিরোধী পক্ষকে অ্যাকশনে যাওয়ার বৈধতা এনে দেয়। পীড়িত হয়ে জনসমর্থন পাওয়া সহজ, আক্রমণের চেয়ে বিনম্র প্রত্যাবর্তন এ ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে সংগঠনকে গণমুখী করে। এসব কর্মকৌশলের ফলে হুদায়বিয়ার আপাত নতজানু সন্ধি বৃহত্তর ও চূড়ান্ত বিজয়ের ভূমিকা রূপে প্রতিষ্ঠিত হলো। সহকর্মীদের উচ্ছ্বসিত আবেগ নিরুত্তরে স্তিমিত করে সময়ে এর সঠিক ব্যবহার প্রকৃত নেতার জন্য অবশ্য অপরিহার্য। কৌশলগত প্রয়োগ এ আদর্শও কম গুরুত্ববহ নয়।

মক্কা বিজয়ের পর সাধারণ ক্ষমা, আল্লাহর ঘরে আশ্রয় লাভকারীদের সুরক্ষা, অস্ত্র-সংবরণকারী স্বগৃহে অবস্থানকারীদের নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশি এককালে চরম দুশমন আবু সুফিয়ানের বাড়িকেও নিরাপদ বলে ঘোষণা করা কত বড় কৌশল ছিল তা বলে বুঝানোর প্রয়োজন নেই। তাবুক অভিযান ইসলামের ইতিহাসে বিরাট তাৎপর্যের তাদের দাবি রাখে এবং এই অভিযানে রাসূল (সা.)-এর কর্মনীতি ও কর্মকৌশলও ছিল অসাধারণ।

তাবুক অভিযান এর সিদ্ধান্তটাও ছিল ব্যাপক অর্থবহ। রাসূল (সা.)-এর যুদ্ধনীতি ছিল তিনি কোন দিকে যাবেন এবং কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ হবে এটা শেষ পর্যন্ত কাউকে বলতেন না কিন্তু এবার তিনি এ গোপনীয়তাটুকু রাখলেন না। পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিলেন রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে এবং সিরিয়ার দিকে যেতে হবে। তাঁবুক অভিযানটা ছিল ভাগ্যের চূড়ান্ত ফায়সালা। এ সময় সাহস দেখাবার অর্থ দাঁড়ায় সারা দুনিয়ার ওপর এ আন্দোলনের বিজয়ের দরজা খুলে যাবে। অন্যদিকে এ সময় দুর্বলতা দেখাবার অর্থ হলো চিরদিনের জন্য সত্য লুটিয়ে পড়া। এমন একটা  প্রতিকূল সময়ে তাবুক যুদ্ধের সিদ্ধান্ত হয় যখন দুর্ভিক্ষ চলছিল। আবহাওয়া যখন প্রচ- গরম, ফসল পাকা সময় এসে গেছে ,সওয়ারী ও সাজ-সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা যখন বড়ই কঠিন ব্যাপার।

অর্থের অভাব ছিল প্রকট এবং দুনিয়ার দুইটি বৃহৎ শক্তির একটির মোকাবেলা করতে হচ্ছে তবুও আল্লাহর নবী এটাকে সত্যের দাওয়াতের জন্য জীবন-মৃত্যুর ফয়সালা করার সময় মনে করে এ অবস্থাতেই যুদ্ধ প্রস্তুতির সাধারণ ঘোষণা জারি করে দেন এবং খুব চমৎকার একটা বক্তব্যের মাধ্যমে সাহাবীদের উজ্জীবিত করেন। তাবুক যুদ্ধে তিন সাহাবী, নারী, শিশু ও মুনাফিকরা ছাড়া সবাই অংশগ্রহণ করেন। রাসূল (সা.) দানের ব্যাপারে উৎসাহিত করার ফলে প্রত্যেকে প্রত্যেকের সামর্থের সবটুকু উজাড় করে দেয়। মুসলমানদের এই আত্মত্যাগ, মানসিক ও শারীরিক কষ্ট, পেরেশানী, পরিবেশের প্রতিকূলতা সব মিলিয়ে যে নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়, সেই সময়ে মুসলমানরা যে সাচ্চা ও দৃঢ় সংকল্পের পরিচয় দেন তার ফল তারা  তাবুকে হাতে হাতে পেয়ে যান।

কায়সার যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার আগেই মুসলমানরা মোকাবিলার সীমান্তে পৌঁছে যায়। যার কারণে ভয় পেয়ে কায়সার তার সৈন্যবাহিনীর সরিয়ে নেয় । কায়সারের এভাবে পিছু হটে যাওয়ার ফলে নৈতিক বিজয় সূচিত হল এবং রাসূল (সা.) এ বিজয় থেকে রাজনৈতিক ও সামরিক ফায়দা হাসিলকে অগ্রাধিকার দেন। সেজন্যেই তিনি তাবুকে ২০ দিন অবস্থান করে রোম সাম্রাজ্য ও দারুল ইসলামের মধ্যবর্তী এলাকায় যে বহু সংখ্যক  ছোট ছোট  রাজ্য এতদিন রোমানদের প্রভাবাধীনে ছিল, সামরিক চাপ সৃষ্টি করে তাদেরকে ইসলামী সাম্রাজ্যের অনুগত করেন। এর ফলে ইসলামী সাম্রাজ্যের সীমানা সরাসরি রোম পর্যন্ত বিস্তৃত হলো। এভাবে রোম সাম্রাজ্যের সাথে একটি দীর্ঘমেয়াদী সংঘর্ষে লিপ্ত হবার আগেই ইসলাম সমগ্র আরবের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও বাঁধন মজবুত করে নেবার পূর্ণ সুযোগ পেয়ে যায়। এটাই ছিল সবচেয়ে বড় লাভ।

মুতার যুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে সেনাপতি বাছাই এর প্রক্রিয়া ও যুদ্ধ কৌশল শেখানো, হুনায়েনের যুদ্ধে গনিমতের মাল বন্টনে নও মুসলিম, মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও অতীব প্রতিপক্ষ পরিবারের ‘নব বন্ধু’ সদস্যদের অগ্রাধিকার প্রদান কৌশল ও প্রজ্ঞার সর্বোৎকৃষ্ট পর্যায়ে পড়ে।

কাজের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি বাছাই  রাসূল (সা.) এর কর্মকৌশল অতি উত্তম এক দৃষ্টান্ত।

সাহাবীদের মধ্যে তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা আলোকে কাজ বন্টন করতেন। যেমন, খালিদ বিন ওয়ালিদকে, তিনি উপাধি দেন ‘আল্লাহর তরবারী’। তার যুদ্ধ কৌশল, শক্তি, সাহস, বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতার আলোকে তিনি ময়দানের জন্য খালেদকেই বাছাই করে নেন। আরবের সেই সময় ছিল কাব্যচর্চার সোনালী যুগ। বাতিলপন্থী, মুশরিকরা যখন ইসলামকে  ঘায়েল করার জন্য কবিতার বান ছুঁড়ে মারতো রাসূল (সা.) তখন রাসূল হাসসান বিন সাবিত, আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহাকে দায়িত্ব দিলেন চমৎকার কাব্যচর্চার মাধ্যমে বাতিলপন্থীকে উপযুক্ত জবাব এবং ঘায়েল করতে।

দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞান, নৈতিকতার ধারক-বাহক ছোট্ট ওসামা বিন জায়েদকেও একটি যুদ্ধের সেনাপতি নির্বাচিত করেন যা রাসূল (সা.) দূরদৃষ্টির পরিচয় তুলে ধরে।

অহি লেখক হিসেবে নিযুক্ত করতেন উবাই ইবনে কাব (রা.), মুয়ায বিন জাবাল (রা.), যায়েদ বিন সাবিত (রা.), হজরত আমির ইবনুল আস (রা.) প্রমুখ সাহাবিকে যারা প্রচ- মেধা ও দৃঢ় শক্তির অধিকারী।

একটি জাতিকে উন্নত করতে হলে সামগ্রিকভাবে জাতিটিকে জ্ঞান সমৃদ্ধ করে তুলতে হয়। সত্যিকার অর্থে একটি জাতিকে উন্নত করতে হলে সেই জাতির বৈষয়িক ও নৈতিক উন্নতি নিশ্চিত করতে হবে। আর পৃথিবীতে নীতি জ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যারা আবির্ভূত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে সবার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ছিলেন রাসূল (সা.)।

অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণ জ্ঞান চর্চার গুরুত্ব প্রদান, জ্ঞানী ব্যক্তির মর্যাদা জ্ঞান বিতরণকারীর সমুহান কর্তব্য এবং বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে তার দিক নিদেশনা অতুলনীয় বৈশিষ্ট্যম-িত। বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাদান পদ্ধতিও রাসূল (সা.) কর্মকৌশলের অন্যতম একটি দিক।

তদানীন্তন বিশ্বের পরাশক্তি, পার্শ্ববর্তী রাজ্যের শাসকগণ প্রাদেশিক গভর্নরদের প্রতি পত্র দেয়ার মাধ্যমে তাদের সাথে ইসলামের প্রথম লেনদেন, শান্তি চুক্তি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূত্রপাত করতে গিয়ে তিনি তার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার খলীফাগণের কর্মপন্থা নির্দেশ করে গেছেন।

আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের রাজধানী মদীনায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে প্রদেশভিত্তিক শাসক, বিচারক, রাজস্ব আদায়কারী, শিক্ষা ও সংস্কৃতি কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিযুক্ত করে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে দিয়ে তিনি ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে এগিয়ে যাওয়ার পথ ও প্রেরণা দিয়ে যান । শিক্ষা, স্বরাষ্ট্র , আন্তর্জাতিক বিষয়দি বিচার, কৃষি, বাণিজ্য, কর্মসংস্থান ও সমর বিষয়ক দপ্তর প্রতিষ্ঠা করে তিনি তার সকল দায়িত্ব সমাপ্ত করে হজরত আবু বকর (রা.) কে জাতির ইমাম নিযুক্ত করে যান। খোলাফায়ে রাশিদীনকে দিয়ে যান অনুসরণীয় আদর্শ প্রবক্তার স্বীকৃতি। বলে যান: দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি তোমাদের জন্য। এই দু’টি শক্ত করে আঁকড়ে থাকো পদচ্যুত হবে না।

এক. আল্লাহর কিতাব

দুই. আমার সুন্নাহ।

বিদায় হজে দিয়ে গেলেন তিনি পূর্ণতার ঘোষণা। শেষ ভাষণ পরিণত হল মানবতার মুক্তির চূড়ান্ত সনদ রূপে।

রাসূল (সা.)-এর পুরো জীবন সমস্ত কর্মতৎপরতাই ছিল হেকমতপূর্ণ, চমৎকার কর্মকৌশলে পরিপূর্ণ। যার মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলন একটা সুসংগঠিত ও সংঘবদ্ধ শক্তিতে পরিণত হয় । যার দলীয় শৃঙ্খলা ছিল অটুট এবং চারিত্রিক মান হয়ে উঠে উন্নত থেকে উন্নততর। এর যুক্তি খুবই ধারালো এবং আবেদন অসাধারণ রকমের চিত্তাকর্ষক। মক্কার সেই ছোট্ট চারা গাছটি পরিণত হয় বিশাল মহীরুহ।

রাসূল (সা.)-এর এই বিপ্লব শুধু বাইরের পরিবেশকেই বদলাইনি বরং ভেতর থেকে মানুষের মন মগজকেও পাল্টে দিয়েছেন এবং গড়ে তুলেছে এক একটা নতুন  চরিত্র। প্রতিষ্ঠিত করেছে একটি পূর্ণাঙ্গ সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। ধর্মের সীমিত ও সংকীর্ণ ধারণার গ-ি মাড়িয়ে  তিনি পরিচালনা করেছিলেন একটি সর্বাত্মক আন্দোলন। কায়েম করেছিলেন দ্বীন তথা পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানকে ।

রাসূল (সা.)-এর জীবন পরিপূর্ণ অনুসরণ, তার আদর্শ ও কর্মপদ্ধতি, কর্মকৌশল সঠিকভাবে মেনে চলা, ধারণ করার মাধ্যমেই আমরাও পৃথিবী তৈরির চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারি। সত্যের মশাল হাতে প্রতিটি অন্তরকে আলোকিত করে নতুন সম্ভাবনার একটি সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় সবাই। বাতিলের সমস্ত ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে তাগুতি শক্তিকে উৎখাত করে দৃঢ়তার সাথে জ্ঞান মেধা প্রজ্ঞা, হিকমত ও হিম্মতের সাথে এগিয়ে চলা আজ সময়ের দাবি।

‘হে ঈমানদারগণ! সবরের পথ অবলম্বন করো, বাতিলপন্থীদের মোকাবিলায় দৃঢ়তা দেখাও, হকের খেদমত করার জন্য উঠে পড়ে লাগো এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। আশা করা যায়, তোমরা সফলকাম হবে।’

(সূরা আলে ইমরান : ২০০)

আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী সফল হবে ইনশাআল্লাহ।

লেখক : নারী অধিকার আদায়ে আন্দোলনের নেত্রী।