১৫ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ৯:২৮

নীরব চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ মালিক-শ্রমিক

* নতুন বাস নামাতে আগ্রহ হারাচ্ছে ব্যবসায়িরা

রাজধানীর গণপরিবহনে চলছে নিরব চাঁদাবাজি। ওয়েবিল কিংবা শ্রমিক কল্যাণের নামে চাঁদার টাকা যায় প্রশাসন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট মহলের পকেটে। বিআরটিএ’র হিসেবে রাজধানীর ১৬১ রুটে প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার বাস ও মিনিবাস চলে। প্রতিটি বাসের শেষ কিংবা শুরুর গন্তব্যে চলে ওয়েবিল কিংবা শ্রমিক উন্নয়নের নামে চাঁদাবাজি। তবে লেগুনা কিংবা প্রাইভেট সিএনজিতে চাঁদাবাজির কৌশলটা ভিন্ন। প্রতিদিন গাড়িপ্রতি চাঁদা দিতে হয় ৬শ’ থেকে ৮শ’ টাকা।

রাজধানীর প্রতিটি রুটেরই একই অবস্থা। এই চাঁদা দেয়ার কারণে কাউকেই তোয়াক্কা করে না বেশির ভাগ গণপরিবহন চালক। যেখানে সেখানে এলোপাথারি গাড়ি রেখে যানজট সৃষ্টি করে তারা। এ বিষয়ে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু লোকের কারণেই সৃষ্টি হচ্ছে এমন অনিয়ম এবং ক্ষুণ্ণ হচ্ছে ভাবমূর্তি। তবে বিশেষজ্ঞরা এমন অনিয়ম বন্ধে সরষের মধ্যে ভুত তাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, নিয়ম মেনে এসব ছোট গণপরিবহনের সংখ্যা আরো বাড়ালে সাধারণ জনগণের ভোগান্তি কিছুটা কমবে। এছাড়া তারা আরো মনে করেন এসব সমস্যা সমাধান করে রাজধানীর পরিবহন জগতের দ্রুত পরিবর্তন আনাও সম্ভব।
সূত্র বলছে রাজধানীতে মাসে প্রায় ১২ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে পরিবহন খাত থেকে। আর এই টাকা ভাগাভাগি করে নিচ্ছে সরকারি দল সমর্থিত বিভিন্ন মালিক-শ্রমিক সংগঠন, স্থানীয় রাজনৈতিক সংঘবদ্ধ শক্তি, পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা। বর্তমান বাংলাদেশে পরিবহনখাতই সম্ভবত সবচেয়ে বড় নৈরাজ্যের এলাকা। সংঘবদ্ধ শক্তি খাতটিকে যাচ্ছেতাইভাবে বিশৃংখলা ও অন্যায়-দুর্নীতির রাজত্ব বানিয়ে ফেলেছে।
সূত্র জানায়, পরিবহন খাতে ঘাটে ঘাটে গুণতে হচ্ছে টাকা। টার্মিনাল থেকে বাস ছাড়ার আগেই শুরু হয় চাঁদাবাজি। এই পর্বে ‘টার্মিনাল চাঁদা’ নামে পরিচিত খাতে দিতে হয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। এরপর সিটি কর্পোরেশনের ইজারাদার ও সিরিয়ালের জন্য শ’খানেক। তারপর শুরু হয় রাস্তার চাঁদাবাজি।
গুলিস্তান থেকে গাজীপুর রুটে রয়েছে চাঁদাবাজির ৬টি স্পট। এসব স্পটে দাঁড়িয়ে থাকে আদায়কারীরা, তাদের হাতে গুঁজে দিতে হয় টাকা। অর্থাৎ যে কোনো একটি বাসকে গুলিস্তান থেকে গাজীপুর পর্যস্ত যেতে হলে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা সেলামি দিতে হবে। এই হিসাবে দিন শেষে বাসটির মালিকের হাতে আসে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮০০ টাকা।

একই অবস্থা দেখা গেল বাড্ডার নতুনবাজার, খিলক্ষেত, এয়ারপোর্ট এবং আজমপুরে। প্রতিটি স্পটেই এক থেকে দুই যুবক হাত উঁচিয়ে বাস থামার নির্দেশ দিলে কন্ডাক্টর তাদের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিতে দেখা যায়। পরিচয় পেয়ে প্রথমে কথাবলতে রাজি না হলেও পীড়াপীড়ির এক পর্যায়ে বাসটির কন্ডাক্টর মারুফ জানান, লাইনম্যানের নামে ক্ষমতাসীন দলের শ্রমিক সংগঠন এ টাকা নেয়।
একই চিত্র পাওয়া গেছে মতিঝিল-মিরপুর রুটেও। এই রুটে শিকড়, সময় নিয়ন্ত্রণ ও দিশারীসহ কয়েকটি পরিবহনের প্রায় এক হাজার বাস চলাচল করে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতি ট্রিপে একটি বাসের মালিককে কমপক্ষে সাড়ে ৮০০ টাকাগুণতে হয়। এর মধ্যে টার্মিনাল চাঁদা ৪৫০ টাকা এবং সিরিয়াল ও সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে দিতে হয় ৩৩০ টাকা।

এ হিসাবে এই রুটে প্রতি মাসে গড়ে চাঁদা ওঠে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। অর্থাৎ ঢাকা-গাজীপুর ও মতিঝিল-মিরপুর রুটে মাসে গড়ে চাঁদা ওঠে ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, উলি¬খিত গুলিস্তান ও মতিঝিলসহ রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী এ পাঁচ টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন ছেড়ে যায় প্রায় সাড়ে ৭ হাজার বাস। প্রতিটি বাস থেকে প্রতিদিন গড়ে ৫৫০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এ হিসাবে মাসে ১২ কোটি টাকার বেশি চাঁদা ওঠে।
এছাড়া রাজধানীতে চলা সিটিং সার্ভিসের প্রতিটি কোম্পানি থেকে মালিক সমিতির নামে
প্রতি মাসে ৩ হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে। এ টাকার ক্ষুদ্র একটি অংশ সমিতির নামে ব্যাংক হিসাবে জমা হচ্ছে। আর বড় অংশই চলেযাচ্ছে সমিতির নামধারী নেতাদের পকেটে। এর বাইরে পুলিশ খরচা বাবদ গাড়ি প্রতি ৫শ’ থেকে সাড়ে ৫শ’ টাকা দিতে হয়। এ টাকা যখন-তখন পুলিশের রিকু্যৃজিশন বন্ধ করার জন্য নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মালিক সমিতির সংশ্লিষ্টরা।
সাধারণ বাস মালিক ও শ্রমিকদের অনেকে গণপরিবহনে নৈরাজ্যের পেছনে ক্ষমতাসীনদের বেপরোয়া চাঁদাবাজির কথা উল্লেখ করেছেন। তারা বলেছেন, যখন যে দল সরকারে আসে চাঁদার নিয়ন্ত্রণ সেই দলের পরিবহন সংশ্লিষ্ট সংগঠন ও তাদেরক্যাডারদের হাতেই থাকে।

তাদের ভাষায়, ‘পরিবহনের টাকা বাতাসে ওড়ে, আর যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা এ টাকা হাতিয়ে নেন।’ সাধারণ ব্যবসায়ীরা বলেছেন, পরিবহন চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ ও ভাগবাটোয়ারা নিয়ে রাজধানীতে খুনোখুনির ঘটনাও কম হয়নি। কিন্তু পরিবহন চাঁদাবাজি কখনও থেমে থাকেনি।
সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে অনেকেই পরিবহন ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। আর এ কারণে গত ৫ বছরে নগরীতে জনসংখ্যা বাড়লেও কমেছে গণপরিবহনের সংখ্যা।
ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাবেক এক নেতা বলেন, ‘গত তিন বছরে রাজধানীতে প্রায় দেড় ডজন নতুন রুটে বাস নেমেছে। এসব রুটের নিয়ন্ত্রণ ও পরিবহনগুলোর মালিকানা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের হাতে। দলীয় পরিচয় ছাড়া নতুন কোনো ব্যবসায়ী এসব রুটে বাস নামাতে চাইলে প্রথমেই তাদেরকে সংশ্লিষ্ট রুট মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ধার্য করে দেয়া হয় মোটা অংকের টাকা। আর প্রথম ধাক্কায় মোটা অংকের টাকার কথা শুনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন নতুন বাস ব্যবসায়ীরা।’

সড়ক পরিবহনের সাবেক ওই নেতার দাবি রাজধানীতে নতুন নতুন রুটে বাস যুক্ত হলেও প্রকৃতপক্ষে কমেছে গাড়ির সংখ্যা। তার দাবি, আগে নগরীতে বড়-ছোট মিলিয়ে ৯ হাজারেরও বেশি বাস চলত। এখন বাস কমে সাড়ে সাত হাজারের দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে কয়েকশ’ বাস আবার মেরামতের জন্য মাসের বেশিরভাগ সময় থাকে ওয়ার্কশপে।
ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির শীর্ষ কর্মকর্তা খন্দকার এনায়েতুল্লাহ একটি গণমাধ্যমকে জানান, ‘পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি একেবারে হয় না, এ কথা বলা যাবে না। কোথাওকোথাও অভিযোগ যখন ওঠে তখন আমরা অ্যাকশনে যাই। সমিতির জন্য প্রতি গাড়িতে চাঁদা নির্ধারণ করা আছে। ওই নির্ধারিতে চাঁদার বাইরে সমিতি কোনো টাকা নেয় না।’

বিআরটিসিটির সাবেক চেয়ারম্যান ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অ্যাড. তৈমূর আলম খন্দকার জানান, সরকার আসে, সরকার যায় কিন্তু গণপরিবহনের দাপট আর কমে না। কারণ তারা সবসময়ই সরকারি দল। যখন যে দলক্ষমতায় সে দলের নেতাদের সামনে রেখেই পরিবহন মালিকেরা তান্ডব চালায়।
তিনি বলেন, পরিবহন থেকে প্রতিদিন যে চাঁদা ওঠে তার একটি অংশ বাটোয়ারা হয়। প্রতি টার্মিনাল, এক জেলা থেকে আরেক জেলায় অতিক্রম করার চাঁদাবাজি ছাড়াও গণপরিবহনের নেতারা নিয়মিত চাঁদা পেয়ে থাকে। যে সকল প্রাইভেট মাইক্রোবাস যাত্রীদের জন্য ভাড়ায় খাটে তাদেরকেও একটি নির্দিষ্ট চাঁদা পুলিশ ও নেতাদের পরিশোধ করতে হয়। বিআরটিএ রুট পারমিট দিলেও পরিবহন নেতাদের মোটাঅংকের টাকা না দিলে সে রুটে বাস চালানো যাবে না এটা ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের মতো যেন একটি অলিখিত আইন যাহা বাধ্যতামূলক
গণপরিবহনে অবৈধ চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগ সাধারণ সম্পাদক মো. ইনসুর আলী সম্প্রতি এক সমাবেশে বলেছেন, পরিবহন খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সরকারের দুই মন্ত্রী। এটা করে মন্ত্রিত্বের শপথ ভঙ্গ করেছেন। তিনি দাবি করেন, প্রতিদিন গণপরিবহন থেকে ৭০ টাকা হারে ২০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে।
সারাদেশের সড়ক পরিবহন সেক্টরে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে মন্তব্য করে বিশিষ্ট লেখক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাসহ সরকারের সংশ্লিষ্টসংস্থাগুলোর প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণেই আজ পরিবহন সেক্টরে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’

সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘রাজধানীতে গণপরিবহনে যে নৈরাজ্য চলছে তা ঠেকাতে প্রশাসন কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এক শ্রেণির মালিক ও শ্রমিক সড়ক পরিবহন খাতকে জিম্মি করে রেখেছে। এরাই রাজধানীতে সিটিং, গেটলক, সময় নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি নামে নগরবাসীর কাছ থেকে মাত্রাতিরিক্ত বাসভাড়া আদায় করছে। অথচ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ এই ভাড়া সন্ত্রাস ঠেকাতে পারছে না।

 

http://www.dailysangram.com/post/315283