১৫ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ৯:২৫

দেশের পরিস্থিতি স্বস্তিকর নয়

দেখা অদেখা

সালাহউদ্দিন বাবর


সংসদীয় গণতন্ত্রে একটি দল জনগণের শুভেচ্ছা ও সমর্থন নিয়ে কয়েক দফা ক্ষমতায় যেতে পারে। এটা কোনো দূষণীয় ব্যাপার নয়। কিন্তু সরকারি নেতারা এখন বারবার বলছেন, তারাই আগামীতে ক্ষমতায় যাবেন। জনগণের সমর্থন পেলেই তারা যেতে পারেন। সে কথা না বলে তারা যে ভাবভঙ্গিমা দেখাচ্ছেন, তাতে মনে হয় তারা অন্যদের নির্বাচনী ময়দানে আসতেই দিতে চান না এবং একতরফা ভোট করে ক্ষমতায় যেতে চান। গণতন্ত্র অর্থ কিন্তু জবরদস্তি ভোট করা নয়। সহিষ্ণুতা তথা পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো গণতন্ত্রের একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে এর মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন যেসব কথা চালাচালি হচ্ছেÑ বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের মুখ থেকে যেসব বক্তব্য আসছে, তা আসলে খুবই উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ও উসকানিমূলক। দেশে এখন সংসদীয় সরকার কায়েম রয়েছে। কিন্তু সংসদের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে সত্যিকার সংসদীয় রীতি-পদ্ধতির অনুশীলন হচ্ছে না। জাতীয় সংসদ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন কোনো আগ্রহ নেই, তেমনি এর কার্যক্রম ও তৎপরতাও উল্লেখ করার মতো নয়। সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় সংসদই হয়ে থাকে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু সে ভূমিকা এখন আমাদের সংসদের নেই। স্বাধীনতার আগে এই ভূখণ্ডে যে শাসনব্যবস্থা ছিল তাকে কোনোভাবে সংজ্ঞায়িত যাবে না। কেননা তার কোনো কাক্সিক্ষত স্বরূপ ছিল না। ব্যক্তিবিশেষের খেয়ালখুশি মতো রাষ্ট্রযন্ত্র চলত। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জনগণ খুব ভালো একটি সংবিধান পায়, প্রতিষ্ঠিত হয় একটি সাংবিধানিক সরকার। সে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বল্প সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচনের মাধ্যমে। এই শুভসূচনা দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়ায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, রাষ্ট্র পরিচালনার সেই ধারা স্থায়ী হতে পারেনি। যারা এ সূচনা করেছিলেন, তারাই অল্প দিনের মাথায় সব ওলটপালট করে দিয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধাঁচে বাংলাদেশে একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে যে দেশ পেছনে চলতে শুরু করল, তার সংশোধনে কিছু প্রয়াস অতীতে লক্ষ করা গেলেও সর্বাংশে সফলতা পায়নি। সেই অনিয়ম অব্যবস্থা এত বছরেও বাংলাদেশের পিছু ছাড়েনি। ভেতরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতপার্থক্য ও বিরোধ রেখে, মৌলিক জাতীয় প্রশ্নে ঐক্য প্রতিষ্ঠা না করে সামনে চলা জাতির জন্য কঠিন। স্রোতের বিপরীতে উজানে যাওয়া কখনোই সুবিধাজনক হয় না। সংসদীয়ব্যবস্থায় রাষ্ট্রে সরকারের পাশাপাশি বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সরকার সে ভূমিকা পালনের সুযোগ করে দেয়া দরকার। সরকার নিজের দায়িত্ব কর্তব্য পালনে সঠিক পথে থাকার জন্য সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকতে হয় বিরোধী দলকে। বিভিন্ন সংসদীয় কমিটিতে সংসদের বিরোধীদলীয় সদস্যরাও অন্তর্ভুক্ত থাকেন। সেই কমিটিতে সব সদস্যের কাজ করার সমান সুযোগ থাকাই রেওয়াজ। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান সংসদে প্রকৃত অর্থে কোনো বিরোধী দল নেই। ত্রুটিমুক্ত প্রশাসন পরিচালনার জন্য সরকারকে সাহায্য করতে পারে বিরোধী দল। কিন্তু সে ব্যবস্থা দেশে বজায় নেই।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন নিয়ে বহু আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। বস্তুত সেদিন নির্বাচনের নামে হয়েছে ‘ভিন্ন অনুশীলন’। সে কারণে হয়েছে যত আলোচনা-সমালোচনা। সেই থেকে দাবি ছিল, দেশে অবাধ নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে হবে। আর এমন নির্বাচন মানেই হচ্ছে, গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের মান নির্ভর করে নির্বাচন কতটা ভালো হয়েছে তার ওপর। আর নির্বাচনের মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয় গণমানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জনগণের সেই অভিমত দেয়ার সুযোগ ঘটেনি। এর পরই দাবি ওঠে নতুন নির্বাচনের। সে দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। আর এভাবে কেটে গেল প্রায় পাঁচটি বছর। এখন নতুন নির্বাচনের সময় এসে গেছে। এর আবহ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু পর্যবেক্ষকেরা আগামীতে এ নির্বাচনের স্বরূপ কী হবে, তা নিয়ে দুর্ভাবনায় রয়েছেন। ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অনেক শর্ত থাকে। এর মধ্যে নির্বাচনকালীন সময়ে দেশে সার্বিক পরিবেশটা কেমন হবে, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সব দলের এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সমান সুযোগ পাবেন কি না, জনগণ শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরাপদে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কি নাÑ এসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি কিন্তু স্বস্তিকর নয়। এখন যে রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে, তা এক কথায় বিপজ্জনক। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, ততই পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বলা কঠিন।
এবার ৫ জানুয়ারি ঢাকায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের স্মরণে বিএনপি দিনটিতে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে এবং আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র রক্ষা দিবস হিসেবে পাল্টাপাল্টি সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ যথারীতি এদিন রাজধানীতে বিরাট র্যালি করেছে। কিন্তু বিএনপিকে কিছু করার অনুমতি দেয়া হয়নি। ঢাকায় বিএনপি কর্মীরা ঝটিকা মিছিল করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি কি কোনো নিষিদ্ধ দল যে, তাদের কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেয়া যাবে না? একইভাবে ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এক জনসংযোগ কর্মসূচি উপলক্ষে জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল সম্প্রতি; কিন্তু সে সমাবেশও করতে বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। বিএনপির সমাবেশস্থলে একই দিন একই সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ পাল্টা সমাবেশের ঘোষণা দেয়। এর পরিণতিতে প্রশাসন সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করেছিল। নির্বাচনের আগে এখন থেকে যদি বিরোধী দলের প্রতি এমন বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু হয়, তবে ভবিষ্যতে অবস্থা কী দাঁড়াবে? লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ডের পরিবর্তে পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এমন দমনমূলক ও বৈষম্যপূর্ণ আচরণ যদি অব্যাহত থাকে তবে নির্বাচনে যাওয়া বিরোধী দলের জন্য অর্থহীন হবে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা তিরোহিত হবে। সে ক্ষেত্রে জাতি কি আবারো ২০১৪ সালের মতো একটি নির্বাচন দেখবে? ভয় হয়, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব। এভাবেই ভোটের ছদ্মাবরণে আবারো কি একটি বেসামরিক প্রশাসন ক্ষমতায় গিয়ে বসবে? এর পরিণতি কিন্তু কারো জন্যই মঙ্গলজনক হবে না। আর এই পরিপ্রেক্ষিতে একান্তই যদি নির্বাচন হতে না পারে তবে ভয়াবহ শূন্যতা দেখা দেবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে।
নির্বাচনের নামে যদি অনির্বাচিত কোনো দল ক্ষমতায় যাওয়া অথবা নির্বাচন না হওয়া দু’টিই দেশের জন্য ভয়াবহ হবে। তাই সব রাজনৈতিক শক্তির একমত হওয়া উচিত যাতে কোনোভাবেই এমন বিপর্যয় না আসতে পারে। আজ দেশে যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য, তার মূল কারণটি নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ করার জন্য উপায় বের করা। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রশ্নে বাধা এটাই। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের মধ্যে বিরাট মতপার্থক্য রয়েছে। ২০ দল মনে করে, নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা চলবে না। এ সময় স্বল্পসময়ের জন্য ‘নির্বাচন সহায়ক সরকার’ প্রশাসন পরিচালনা করবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে সম্পূর্ণ নারাজ। তার জোরালো মত হচ্ছে, তারাই ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করাবেন। এটাই ‘সংবিধানের নির্দেশনা’। এর বাইরে তারা যেতে চান না। কিন্তু নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হওয়ার ক্ষেত্রে অতীতে এদেশের যে অভিজ্ঞতা তা সন্তোষজনক নয় মোটেও। এ কথাটাই ২০ দল বলে আসছে। এখানে একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও প্রশ্নমুক্ত করার জন্য যদি প্রস্তাব দেয়া হয় তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আলোচনার সাফল্যের জন্য দুই পক্ষের সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করা উচিত। এখানে যদি সংবিধানের প্রশ্ন আসে, তাকে উপেক্ষা না করে আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতের ভিত্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা হতে পারে। তা ছাড়া নির্বাচন ভালো করার ব্যাপারে সবারই সম্মত হওয়া উচিত। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি পদ্ধতি দেশে ছিল। আওয়ামী লীগের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন বিএনপি সরকার সংবিধানে সে বিধান সন্নিবেশিত করেছিল। কিন্তু পরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিভক্ত সিদ্ধান্তে তা রহিত হয়ে যায়। ওই ব্যবস্থা বলবৎ থাকা অবস্থায় দেশে যতগুলো সাধারণ নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো অবাধ নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের পর কোনো বিরোধিতা বা বিতর্ক হয়নি। এ দিকে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে অতীত থেকে তথা স্বাধীনতার পর থেকে অসন্তোষ হতাশা লেগেই আছে।

আমরা যেমন নির্বাচন নিয়ে হতাশা, ঠিক তেমনি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বে নিযুক্ত যে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, তার কর্তব্য পালন নিয়েও অদক্ষতার অভিযোগ রয়েছে। দেশের সংবিধান ও অন্য যেসব আইন-কানুন রয়েছে তাতে নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু ও স্বাধীনভাবে কাজ করার যথেষ্ট ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তারা এসব ক্ষমতা ও শক্তি প্রয়োগ করে বলতে গেলে কখনোই ভালো নির্বাচন করতে সমর্থ হননি। বরং সরকারের প্রভাববলয়ের মধ্যে কমিশন ঢুকে পড়েছে। তাদের নিজস্ব সত্ত্বার বিকাশ ঘটেনি। ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার কাছে তারা বারবার নতিস্বীকার করেছেন। এর আগে নির্বাচন কমিশনের যারা কর্তাব্যক্তি ছিলেন তারা গোটা প্রতিষ্ঠানটির ভাবমর্যাদা একেবারে গুলিয়ে দিয়ে গেছেন। কমিশনের স্বাধীনতা রক্ষা করেননি। তাদের কাজের পরিণতি ছিল গোটা নির্বাচনীব্যবস্থাকে ভণ্ডুল করে দেয়া। এসব কর্মকাণ্ডের ফলে কোনো বিশেষ দল ক্ষমতা পেয়ে প্রতিপত্তি দেখাতে পেরেছে বটে; কিন্তু গণতন্ত্র ও দেশের কোনো কল্যাণ হয়নি। এর জের আজ দেশ টেনে চলেছে। একই কারণে, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুগঠিত হতে পারেনি।

রাষ্ট্রপতি সম্প্রতি নতুন বছরের সংসদের অধিবেশনে উদ্বোধনী বক্তৃতায় বলেছেন, জাতীয় আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে সরকার ও বিরোধী দলকে সম্মিলিতভাবে কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির এই আহ্বান কি সবাই গ্রহণ করবেন? রাষ্ট্রপতি এমন এক সংসদের সরকারি ও বিরোধী দলকে সম্মিলিতভাবে কাজ করার তাগিদ দিয়েছেন যা সত্যিকার জনপ্রতিনিধি দিয়ে গঠিত। দুঃখ হচ্ছে, বর্তমান সংসদ সেভাবে গঠিত নয়। সংসদ গঠিত হতে হবে একটি নির্ভেজাল নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু সেই সংসদ এখন নেই। এখনকার সংসদের সদস্যরা সবাই বিতর্কিত এক নির্বাচনের মাধ্যমে এসেছেন। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সদস্যদের মিলিয়ে মন্ত্রিসভা গঠিত। জাতীয় পার্টি প্রধান এরশাদ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় ‘প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত।’ অর্থাৎ দেশে এখন এক অদ্ভুত অবস্থা বিরাজ করছে। বাংলাদেশে বিদ্যমান সরকারপদ্ধতিকে এখন কোন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যাবে? সেটা অবশ্যই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ভাবনার বিষয়। আর এ অবস্থায় দেশ বস্তুত বিরোধী দলহীন অবস্থায় চলছে। এই সরকারকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। রাষ্ট্র যে বিরোধী দলের কথা বলেছে, তেমন বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই। দেশের একটি প্রধান বিরোধী দল বহুদিন সংসদের বাইরে। তাদের বাইরে থাকার কারণ কিন্তু অযৌক্তিক নয়। তারা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে লড়াই করছেন এবং এর আগের নির্বাচন তারা বর্জন করেছেন। রাষ্ট্রপতি এক সাথে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন সরকারি ও বিরোধী দলকে। সংসদের বাইরে বৃহত্তম বিরোধী দলের সাথে সরকার যদি এক হয়ে কাজ করে তবেই তা সফল হবে। সেই বিরোধী দলের সাথে তারা এখন সাধারণ সৌজন্যমূলক আচরণও করেন না। ফলে দুই পক্ষের এক সাথে কাজ করার কোনো সুযোগ আপাতত আশা করা যায় না।
সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের চার বছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, ২০১৮ সালের শেষ দিকে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন হবে এবং সে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। সে সরকার সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা দেবে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে কথা বলেছেন বটে; কিন্তু তার স্বরূপ কী হবে সে সম্পর্কে কিছু বলেননি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলে আসছে দীর্ঘ দিন থেকে। এটা মনে করার কোনো কারণে নেই যে, দুই পক্ষের নির্বাচনকালীন সরকারের স্বরূপ অভিন্ন। অবশ্যই পার্থক্য রয়েছে। দুই পক্ষের এই প্রশ্নে যদি দ্বিমত থাকে, তবে এ নিয়ে সমঝোতার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এজন্য দুই পক্ষকেই যৌক্তিক হতে হবে। আর সেজন্য সরকার ও বিরোধী দলকে এ প্রশ্নসহ অন্যান্য যেসব বিষয়ে মতদ্বৈধতা রয়েছে তা নিরসনে সংলাপে বসা উচিত অবিলম্বে। সংলাপ হলে অবশ্যই উভয় পক্ষ বিভিন্ন বিষয়ে কাছাকাছি আসতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী তার উল্লিখিত ভাষণে বলেছেন, দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে রয়েছে। এ সড়ক ধরে এগিয়ে যেতে হলে একটা অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকা একান্ত আবশ্যক।’ তাই দেশে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, তাদের জন্য এই পরিবেশটা প্রয়োজন জরুরি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই এই পরিবেশ আসবে। তাই নির্বাচন করার লক্ষ্যে সরকারের উচিত, সংলাপ করে একটা ইতিবাচক অবস্থা সৃষ্টি করা।

আমাদের পূর্বসূরিরা অনেক পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীন এই ভূখণ্ড দিয়ে গেছেন। বর্তমান জাতীয় নেতৃত্বের দায়িত্ব হলো, উত্তরসূরিদের জন্য এই ভূখণ্ড সুখী সমৃদ্ধ করে একে বাসযোগ্য করে তোলা। এজন্য তাদের শ্রম ও মেধার প্রয়োজন। পৃথিবীটা প্রতিদিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। জনসংখ্যা বাড়ছে, সেই বিশাল গোষ্ঠীর চাহিদা বাড়ছে। এসব প্রয়োজন পূরণ করতে গিয়ে যদি আয়োজনের ঘাটতি থাকে তবে দিন দিন সেটা অসাধ্য হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক নেতারা দেশবাসীকে আশার বাণী শোনাচ্ছেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে সমৃদ্ধি আসবে। কিন্তু এই আশার বাণী শোনানোর পাশাপাশি লক্ষ্যে পৌঁছার যথেষ্ট উদ্যোগ আয়োজন দৃশ্যমান হচ্ছে না। এই আশা যদি হতাশায় পরিণত হয়, তবে বিশৃঙ্খলায় দেশ ছেয়ে যাবে। সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনার দায়িত্বে যারা থাকবেন, দেশের মানুষ তাদের যোগ্যতা সততা কর্তব্যনিষ্ঠার আলোকে বেছে দেবে। কিন্তু বেছে দেয়ার যে যথাযথ পদ্ধতি, সেটাই এখন অনুসরণ হচ্ছে না। নানা দোষে ভরে আছে; আর বিবাদ বিসংবাদে ভরে উঠেছে সমাজ ও রাষ্ট্রীয়জীবন। এখন যারা ক্ষমতায় আছেন তারা মনে করেন, কেবল তারাই যোগ্য জনবান্ধব। তারা রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার অধিকারী। এ ধরনের মনোভাব আসলে কোনো স্বস্তি ও শান্তি আনবে না। এই দাবি যাচাইয়ের জন্য তাদের সাধারণ মানুষের কাছে যেতে হবে। তারাই যোগ্যতরকে বেছে নেবে।

 

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/285006