১৫ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ৯:২৪

মানুষের দুর্বিষহ জীবনযাত্রা

বাঙ্গাল আবদুল কুদ্দুস : গত কয়েক বছর ধরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল ও সন্তোষজনক বলে জোর প্রচার-প্রচারণা চালানো হলেও সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে বেশিরভাগ মানুষের জীবন ধারণের ব্যয় অস্বাভাবিকহারে বেড়ে গেছে। দ্রব্যমূল্য আকাশ ছোঁয়ার কারণে দেশে অর্থনৈতিক নজিরবিহীন বৈষম্য ও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু জরিপে উঠে এসেছে। বিশেষত শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের আয় না বাড়লেও বিভিন্নভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে শহুরে মানুষের দারিদ্র্য বেড়েছে বলে পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বাড়ার কারণে বেসরকারি চাকরিজীবীসহ স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষকে তাদের আয়ের বেশিরভাগ অর্থ প্রতিদিন খাদ্যের পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে। এর ফলে সুষম খাদ্য তথা পুষ্টির চাহিদা পূরণ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও বাসস্থানের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করতে পারছে না কোটি কোটি সাধারণ মানুষ। দেশে পুঁজি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে চলছে দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতা, অস্বাভাবিকহারে ও অযৌক্তিক প্রক্রিয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে মূল্য বৃদ্ধিতে দেশের কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রাকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। ক্ষমতাসীন সরকার একদিকে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য স্থিতিশীল ও দরিদ্র জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে, অপরদিকে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির মূল্য দফায় দফায় বাড়িয়ে নিজেই পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে।

চলতি অর্থবছরে ৭ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা করছে সরকার। যদিও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যেই দেশে দারিদ্র্য ও আয় বৈষম্য দু’টিই বাড়াচ্ছে বলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। চলতি অর্থবছরে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় সাড়ে ৮ শতাংশ বা আরো বেশিই বেড়েছে। ভোক্তা অধিকার সংস্থা-কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)’র বার্ষিক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। গত বছর (২০১৭) দেশে খাদ্যসহ পণ্যমূল্য বৃদ্ধির হার আগের বছরের মূল্যস্ফীতির হারের শতকরা ৩২ ভাগ বেশি বলে জানা গেছে। এমন অস্বাভাবিকহারে মূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল একচেটিয়াভাবে প্রভাবশালী বেনিয়া বিত্তশালীদের পকেটে চলে যাচ্ছে। এই বৃত্তের বাইরে থাকা স্বল্প আয়ের ১২ কোটি সাধারণ মানুষ মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির সুফল পাচ্ছে না। খাদ্যসহ পণ্যমূল্যের স্ফীতি দেশে অন্তত ২ কোটি নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় সরাসরি বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করছে বলে ক্যাবের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সরকারের চরম ব্যর্থতা নয় কী? কোনো গণতান্ত্রিক ও জনবান্ধব সরকারের শাসনে নিত্যপণ্যের মূল্যে এমন নিয়ন্ত্রণহীন অরাজক অবস্থা চলতে পারে কী? জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে কোটি কোটি মানুষকে অর্থনৈতিক চাপে ফেলে শোষণ করে দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়া অথবা দারিদ্র্য নিরসন কীভাবে সম্ভব?
বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানি তেলের মূল্য অব্যাহত হারে কমেছে বাংলাদেশে সরকার তখন জ্বালানির মূল্য বাড়িয়েছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য বাড়ানোর আগে গণশুনানির নিয়ম রয়েছে, প্রতিটি গণশুনানিতে অংশগ্রহণকারী সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির মূল্য না বাড়িয়ে বরং মূল্য কমিয়ে এনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার দাবি জানালেও এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন মূল্য সমন্বয়ের কথা বলে প্রতিবারই মূল্য বাড়িয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে পণ্যমূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যায়। সরকার যখন গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য দূরীকরণে নানা পরিকল্পনার কথা বলছে, উদ্যোগ নেয়ার আভাস দিচ্ছে, তখন বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহন ব্যয়বৃদ্ধি এবং সিন্ডিকেটেড কারসাজি ও মুনাফাবাজির কারণে শহরের নিম্ন ও মধ্য আয়ের কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। বেশ কয়েক বছর থেকেই আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এটা সরাসরি অশনি সংকেত। সরকার খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং ভোক্তা ও কৃষকের স্বার্থরক্ষার বদলে আমদানিকারক ও মুনাফাবাজ লুটেরা চক্রকে সরাসরি লুটপাট চালিয়ে অবৈধ সম্পদ গড়ার সুযেগা দেয়ার মাধ্যমে দেশকে সামাজিক ও অর্থনৈতিভাবে ও লুটপাটের সাথে জড়িতদের নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো নজরদারি বলতে নেই। তাই তো লুটেরাদের বিরুদ্ধে সরকার আইনগত কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। তবে দেশটাকে লুটপাট করে দেউলিয়া করার আরো কী কিছু বাকি আছে?

 

http://www.dailysangram.com/post/315350