১৪ জানুয়ারি ২০১৮, রবিবার, ৮:৫৮

গ্যাসের অভাবে চুলা জ্বলছে না ঢাকার বাসাবাড়িতে

অনেক সিএনজি স্টেশন বন্ধের উপক্রম * শিল্প উৎপাদন কমেছে * শীতে চাহিদা বেড়েছে ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। কয়েক দিন ধরে এ সংকট চললেও সমাধানের উদ্যোগ নেই। গ্যাস না থাকায় ঢাকার অধিকাংশ বাসাবাড়িতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চুলা জ্বলছে না। ফলে রান্না প্রায় বন্ধ। খাবারের জন্য বাড়ির লোকজনকে আশপাশের হোটেলের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। হোটেলগুলো সুযোগ বুঝে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষের সংকট বেড়েছে। আবাসিকের পাশাপাশি গ্যাস সংকটের কারণে অনেক সিএনজি স্টেশন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প উৎপাদন এরই মধ্যে তিন ভাগের একভাগ কমে গেছে।
তিতাস গ্যাস সূত্র জানিয়েছে, আগে তাদের গ্যাসের ঘাটতি ছিল ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তীব্র শীতের কারণে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, শনিবার গ্যাস উৎপাদন হয়েছে ২৬৪৯ মিলিয়ন ঘুনফুট। কিন্তু এই দিন সরকারি ছুটি থাকলেও চাহিদা ছিল ৩৩৯৯ মিলিয়ন ঘুনফুট। শীতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সার কারখানাগুলো চালু থাকায় সমস্যা হচ্ছে। তবে সংকট তীব্র হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে অবৈধ সংযোগ।

তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মসিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, শীতের কারণে রাজধানীর বেশিরভাগ বাসাবাড়িতে ২৪ ঘণ্টা চুলা জ্বালিয়ে রাখে। সে কারণে ২৫০ মিলিয়ন ঘুনফুট গ্যাসের চাহিদা বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, এমনিতে ৫০০ মিলিয়ন সরবরাহ কম থাকায় তাদের হিমশিম খেতে হয়। তার ওপর এখন চাহিদা দাঁড়িয়েছে ৭৫০ মিলিয়ন ঘুনফুট। কাজেই এ অবস্থায় তাদের পক্ষে কিছুই করার নেই। গ্যাসভিত্তিক একাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সার কারখানা বন্ধ না করলে রাজধানীর এ সংকট কমানো সম্ভব হবে না।
শিল্প মালিকরা জানান, গ্যাস সংকটের কারণে তাদের চলমান শিল্প উৎপাদন এরই মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগ কমে গেছে। তবে গ্যাসের উৎপাদন স্বাভাবিক রয়েছে বলে দাবি করছেন পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা। তাদের মতে, শীতকালে এমনিতেই গ্যাসের পাইপলাইনে প্রেসার কম থাকে। ফলে হঠাৎ করেই গ্যাসের মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। তাছাড়া শীতের তীব্রতা থেকে রক্ষা পেতে এবং ঘর গরম রাখার জন্য অধিকাংশ বাড়ির মালিক চুলা বন্ধ করছেন না। এ কারণেও অতিরিক্ত কমপক্ষে ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা বেড়ে গেছে।
জানা গেছে বর্তমানে রাজধানীর কিছু এলাকায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বেশিরভাগ সময় গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। এসব এলাকায় সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১টা, কোথাও বিকাল ৩টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। আবার কোথাও সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত গ্যাসের চুলাই জ্বলে না। এসব এলাকার অধিবাসীরা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জরুরি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে দৈনিক গড়ে ৫০০’র বেশি অভিযোগ করছেন। কিন্তু গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় অভিযোগের কোনো সুরাহা করতে পারছেন না কর্তৃপক্ষ।
এদিকে আবাসিকের পাশাপাশি গ্যাস সংকটের কারণে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে অনেক সিএনজি স্টেশন। তেজগাঁও, শ্যামপুর, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকার সিএনজি স্টেশনেও গ্যাসের চাপ ঠিক থাকছে না। গাজীপুর, কোনাবাড়ী, শফিপুরসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্প কারখানাগুলোয়ও দিনে গ্যাসের চাপ থাকে না। এ কারণে শনিবারও সিএনজি স্টেশনগুলোয় ছিল লম্বা লাইন। সিএনজিচালাক আবদুর রাজ্জাক জানান, শনিবার বেশ কয়েকটি স্টেশন ঘুরে তাকে গ্যাস নিতে হয়েছে। তবে এ ধরনের গ্যাস সমস্যা কতদিন চলবে, কেউ জানেন না। গ্যাসের তীব্র সংকট রয়েছে সেগুনবাগিচা এলাকা, জাতীয় প্রেস ক্লাব, উত্তর শ্যামলী, পশ্চিম আগারগাঁও, শেখেরটেক, পীরেরবাগ, পুরান ঢাকার নাজিরা বাজার, সিক্কাটুলী, মাজেদ সরদার রোড, কসাইটুলী, রামপুরা, খিলগাঁও, গোড়ান, শঙ্কর, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, রায়েরবাজার, টেনারি মোড়, টালি অফিস, ধানমণ্ডি, মধুবাজার, ঝিগাতলা, রূপনগর, শেওড়াপাড়া, সেনপাড়া পর্বতা, উত্তর ইব্রাহিমপুর, মাদারটেক, কল্যাণপুর, উত্তরখানসহ বিভিন্ন এলাকায়। উত্তরখানের বড়বাগ এলাকার বাসিন্দা ইয়াসমিন মাহমুদা অভিযোগ করেন, দিনে আধা ঘণ্টার মতো গ্যাস পাওয়া যায়। সেটাও পুরোপুরি নয়। তিনি জানান, ফায়দাবাদ, কাঁঠালতলা, মাস্টারপাড়া- এসব এলাকায় একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এই গৃহিণী জানান, বর্তমানে বিদ্যুৎ ও সিলিন্ডার দিয়ে রান্নার কাজ করতে হয় তাদের। একই অভিযোগ গোড়ানের বাসিন্দা নাজমুন নাহান সুমির। তিনি বলেন, গ্যাসের অভাবে তারা সিলিন্ডার ব্যবহার করে রান্নার কাজ চালাচ্ছেন। প্রতিমাসে তাদের ৪টি সিলিন্ডার লাগছে। তিনি জানান, বাচ্চা নিয়ে চরম আতঙ্কের মধ্যে তারা সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন।

টালি অফিসের বাসিন্দা আলমগীর হোসেন বলেন, সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পুরো এলাকায় কোনো বাসাবাড়িতে গ্যাসের চুলা জ্বলে না। হারিকেন জ্বালিয়ে ঘর আলোকিত করছেন। আর হোটেল থেকে কিনে এনে খাবার খাচ্ছেন। আলমগীর আরও বলেন, রাজধানীর বাসিন্দা হয়েও এ এলাকার অনেক বাড়িতে এখনও মাটির চুলায় রান্না হচ্ছে। হাজারীবাগ বাড্ডানগর পানির ট্যাংকি এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী লিজা আক্তার বলেন, গ্যাস নিয়ে এখন আমাদের সঙ্গে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ তামাশা করছে। রাত জেগে রান্না করে, দিনের বেলায় কেরোসিন তেল দিয়ে স্টোভ জ্বালিয়ে কখনোবা সিলিন্ডারের চুলায় তা গরম করে খেতে হয়। সকাল ৭টার আগেই গ্যাস চলে যায়। মিরপুর দুই নম্বর সেকশনের এইচ ব্লকের বাসিন্দা তুলি আক্তার জানান, সকালে কোনো রকম গ্যাস থাকলেও বেলা ১১টার পর থেকে কমতে থাকে। তখন চুলা জ্বলে মিটমিট করে। দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকে না। ফলে রান্নাবান্নার কাজ আগেই শেষ করে রাখতে হয়। বেইলী রোডের মৌসুমী আক্তার জানান, তাদের লাইনে রাত ৮টার আগে গ্যাস আসে না। পুরান ঢাকার গণকটুলী এলাকার গৃহিণী মাম্মি বলেন, গ্যাসের সমস্যার কথা বলে লাভ নেই। সকালে কোনো রকম রান্নাবান্না করতে পারলেও দুপুরের পর থেকেই করুণ অবস্থা তৈরি হয়।
রাজধানীর শাহীনবাগের বাসিন্দা সানজিদা খানম জানান, গ্যাসের সমস্যার কারণে তিনি ঠিকমতো রান্না করতে পারছেন না। অনেক সময়ই পরিবারের সদস্যদের জন্য নাশতা বাইরে থেকে আনতে হচ্ছে। অতিথি এলে ঘটছে বিপত্তি।

তেজকুনিপাড়ার বাসিন্দা বিউটি আকতার বলেন, মধ্যরাতে গ্যাস আসে। রাতেও রান্না করা যাচ্ছে না। ভোর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না বললেই চলে। মাঝখানে টিমটিম করে জ্বললেও সে আগুনে রান্না করা যায় না।
বাসাবো কদমতলার হীরাঝিল গলির গৃহিণী অনামিকা মাহবুব সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত গ্যাসের চুলা ব্যবহার করতে পারেন না। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘শীতের মধ্যে গভীর রাতে পরদিনের রান্না করে রাখতে হয়। এটা অসহনীয়।’ কাঁঠালবাগানের বাসিন্দা আমির হোসেন সুমন আলাদা সিলিন্ডার কিনেছেন বলে জানালেন। পুরান ঢাকার রাজার দেউড়ীর সুদেব ঘোষকে রান্নার জন্য কেরোসিন চুলার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। দনিয়ার কবিরাজবাগ এলাকায় গ্যাসের অভাব প্রকট হওয়ায় সায়েদাবাদে বাসা ভাড়া নিয়েছেন চাকরিজীবী সাইফুল ইসলাম। সেখানে বড় পাইপলাইন ও অবৈধ গ্যাস সংযোগ থাকায় আপাতত সংকট নেই বলে জানান। এছাড়া গোপীবাগ, আরকে মিশন রোড, স্বামীবাগ, মানিকনগর, গোলাপবাগ, ওয়ারী, উত্তর মৈশুণ্ডি, দয়াগঞ্জ, গেণ্ডারিয়া, বকশিবাজার, দক্ষিণ কমলাপুর, বনশ্রী এলাকার মানুষও চরম গ্যাস সংকটের অভিযোগ করেছেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/6502