মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম ৩৪ বছর বিনা বেতনে শিক্ষকতা করে অবসর নিয়েছেন। আর কামিলসহ মাস্টার্স পাস আবদুল কুদ্দুস ১০ বছর ধরে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করছেন ইবতেদায়ি মাদরাসায়
১৪ জানুয়ারি ২০১৮, রবিবার, ৮:৫৭

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি শিক্ষকদের কথা

মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিয়ে মাদরাসা চালাই

আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এই সুবাদে মাসে ১০ হাজার টাকা ভাতা পাই। আমার মাদরাসায় পাঁচজন শিক্ষক রয়েছেন। আমার ভাতা থেকে তাদের চার জনকে এক হাজার টাকা করে এবং একজনকে ১২ শ’ টাকা দেই। বাকি টাকা দিয়ে আমি সংসার চালাই। এভাবে ধরে রেখেছি মাদরাসাটি।

কথাগুলো বলেন, মো: রফিকুল ইসলাম। তিনি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার পূর্ব রুস্তমপুর রফিকিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৩৪ বছর ধরে বিনাবেতনে শিক্ষকতা করার পর অবসর নিয়েছেন সম্প্রতি। এখন মাদরাসার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার বয়স ৭০। গত বুধবার থেকে তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে একটানা অবস্থান করছেন জাতীয়করণের দাবিতে। বড় একটি ওষুধের বাক্স বের করে এ প্রেতিবেদককে দেখিয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি ডায়াবেটিসের রোগী। কিডনির সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে তিনিবার অপারেশন হয়েছে আমার। এই বৃদ্ধ বয়সে অসুস্থ শরীর নিয়ে ফুটপাথে পড়ে আছি সরকার যাতে আমাদের দাবি মেনে নেয় সে জন্য। শিক্ষকদের কষ্ট আমার আর সহ্য হয় না। তাই এসেছি। মুক্তিযুদ্ধের ভাতা পাওয়ার আগে আমিও শিক্ষক হিসেবে অনেক কষ্ট করে সংসার চালিয়েছি। বেতন ছাড়া এভাবে আর কতদিন মাদরাসা টিকিয়ে রাখতে পারব জানি না। জাতীয়করণ না হলে হাজার হাজার মাদরাসার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি যখন মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করি তখন আশপাশে কোনো শিক্ষিত লোক খুঁজে পাওয়া যেত না আমাদের এখানে। সে কারণে শিক্ষার আলো ছড়ানোর নিয়ত করে একটি দ্বীনি প্রতিষ্ঠান চালু করলাম। আমি অন্য কোনো চাকরিতে গেলাম না মাদরাসার কারণে। কিন্তু বেতনভাতার অভাবে অনেক মাদরাসা বন্ধ হয়ে গেছে। এখনো যদি জাতীয়করণ না হয় এভাবে বন্ধ হতেই থাকবে।
রফিকুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, জাতীয়করণ হবে এই আশায় কত শতবার যে ঢাকায় এসেছি এই দীর্ঘ শিক্ষকতার জীবনে তার কোনো ঠিক নেই। আমাদের এখন কবরে ডাকছে। মরার আগে দেখে যেতে চাই মাদরাসাটি ভালো চলছে।

তিনি বলেন, আমি এসেছি গত বুধবার কিন্তু আমি আমার মাদরাসার শিক্ষক হাফেজ আব্দুস সালামকে পাঠিয়েছি ১ জানুয়ারি থেকে কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার জন্য। এ সময় হাফেজ আব্দুস সালাম বসা ছিলেন তার পাশে।
মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার পূর্ব ইন্দ্রপাশা নেছারিয়া কাদেরিয়া তৈয়বিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রধান শিক্ষক। মাদরাসা থেকে কামিল পাসের পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষায় ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্স করেছেন বরিশাল বিএম কলেজ থেকে। ১০ বছর ধরে তিনি বিনাবেতনে শিক্ষকতা করে আসছেন। উচ্চশিক্ষা নিয়ে কেন প্রাইমারি মাদরাসায় বিনাবেতনে চাকির করছেন জানতে চাইলে আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ১৯৭৫ সালে মাদরাসাটি আমার বাবা মৌলভি আব্দুস সাত্তার প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাবাও সারা জীবন বিনাবেতনে এ মাদরাসায় শিক্ষকতা করতে করতেই মারা গেছেন। প্রতি বছর বাজেট আসার আগে বাবা আমাদের বলতেন এ বছরই সরকার জাতীয়করণ করবে মাদরাসা। এভাবে আশায় আশায় থাকতে থাকতে মারা গেলেন আমার বাবা। বাবা মারা যাওয়ার পর আমি মাদরাসার দায়িত্ব নিই। মারা যাওয়ার আগে বাবা আমাকে বলেছেন মাদরাসাটি যেন টিকে থাকে।

আব্দুল কুদ্দুস বলেন, বাবা যেমন কষ্ট করে সংসার করেছেন তেমনি আমিও কষ্ট করে সংসার করছি। তাদের মাদরাসা থেকে সর্বশেষ সমাপনী পরীক্ষায় ১৬ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে সবাই পাস করেছে বলে জানান তিনি।
ইসমাইল হোসেন ভোলার দৌলতখান উপজেলার মধ্যচারপাতা সিদ্দিকীয়া স্বতন্ত্র ইবদেতদায়ি মাদরাসার শিক্ষক। তরুণ শিক্ষক ইসমাইল হোসেন আজান এবং কিরাত প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রাম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন ২০০৭ সালে। কামিল পাস ইসমাইল ২০১৫ সাল থেকে বিনাবেতনে শিক্ষকতা করে আসছেন। শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসেবে মনে করে ইসমাইল। সে কারণে বিনাবেতনে চাকরি করছেন জানিয়ে ইসমাইল বলেন ছোট ব্যবসা করে সংসার চালাই কোনো মতে। জাতীয়করণ হলে মাদরাসাগুলো আরো অনেক ভালো চলবে। আমরাও বাঁচতে পারব।
মাওলানা শাহজাহান ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার দাইরপাড়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসায় ১৯৯৪ সাল থেকে শিক্ষকতা করে আসছেন। তিনি প্রধান শিক্ষক। মাদরাসাটি ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত। সাধারণ শিক্ষায় বিএ এবং মাদরাসা থেকে কামিল পাস শাহজাহান জানান, আমার বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। মা বৃদ্ধা। কিন্তু তাদের চিকিৎসা করাতে পারছি না, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারছি না অর্থের অভাবে। ইমামতি করে যে টাকা পাই তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চালাই।

জাতীয়করণের দাবি আদায়ের ব্যাপারে শাহজাহান বলেন, প্রয়োজনে কাফনের কাপড় পরে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে অনশন চালিয়ে যাবো। কিন্তু এবার আর খালি হাতে ফিরব না।
আব্দুর রহমান লালমনিরহাট জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বাবুরডাঙ্গা রহমানিয়া স্বতত্র ইবতেদায়ি মাদরাসায় ২০১১ সাল থেকে শিক্ষকতা করছেন। মাদরাসাটি ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জাতীয়করণের দাবিতে আমরণ অনশন করছেন তিনিও অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে। জিয়াউল হক বরিশাল জেলার হিজলা উপজেলার পশ্চিম ডাইরা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক। তিনি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষক সমিতির অর্থসচিব।
মাওলানা শরিফউদ্দীন সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার গ্রামাপাঙ্গাসী ইসলামিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রধানশিক্ষক। ১৯৯৫ সাল থেকে বিনাবেতনে শিক্ষকতা করে আসছেন। পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত জমি বিক্রি করে ছেলেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। নিজে জমি চাষ আর প্রাইভেট পড়িয়ে সংসার চালান বলে জানান শরিফউদ্দীন।
আব্দুল খালেক সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার রূপসী খোরশেদিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসায় গত ৩১ বছর ধরে বিনাবেতনে শিক্ষকতা করে আসছেন।
মো: আনিছুর রহমান গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ছোটঅভিরামপুর স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসায় গত ১৮ বছর ধরে বিনাবেতনে শিক্ষকতা করে আসছেন।

ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার লক্ষণপুর নয়াপাড়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার মোশারফ হোসেন শিক্ষক ও লালমনিরহাট জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বৈরাতি আফজালিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক ফজলুল করিম বলেন, দাবি আদায় না করে অনশন ভাঙ্গব না।
গত ১ জানুয়ারি থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচিতে গত ৯ জানুয়ারি থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন তারা। অনশনে প্রতিদিন বাড়ছে শিক্ষকদের সংখ্যা। তীব্র শীত, লাগাতার অবস্থান শেষে আমরণ অনশনের গতকাল পঞ্চম দিন পর্যন্ত শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষিকা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
এ দিকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সভাপতি আ স ম আব্দুর রব গতকাল অনশন স্থলে এসে তাদের দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানান।
শিক্ষকেরা জানান, ১৯৯৪ সালে একই পরিপত্রে রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুল ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা ভাতার আওতায় আনার ঘোষণা দেয়ার পর সব রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ করা হয় কিন্তু স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণ করা হয়নি। জাতীয়করণ তো দূরের কথা মাত্র এক হাজার ৫১৯টি মাদরাসা ভাতার আওতায় আনার পর এ সংক্রান্ত কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। অপর দিকে রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলের ভাতা ধাপে ধাপে বাড়ার পর ২০১৩ সালে সব স্কুল জাতীয়করণ করা হয়।
১৯৮৪ সালে মাদরাসা বোর্ড ১৮ হাজার ১৯৪টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা রেজিস্ট্রেশন দেয়। বেতনভাতার অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক মাদরাসা।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/284810