একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাহিয়ান ফারাহ। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করছেন। তাই রোজ তাকে পাবলিক বাসে চড়তে হচ্ছে। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি স্বীকার করেন, নিতান্ত বাধ্য হয়েই তারা বাসে উঠে যাতায়াত করেন। তার ভাষায়, যদিও এখন পুরুষ ও নারী যাত্রীর সংখ্যা সব জায়গায় সমান, তবুও মেয়েদের জন্য বাসে সিট থাকে গুটিকয়েক। তার ওপর সেই সিটগুলো সব সময় পুরুষের দখলে থাকে। অনেক সময় বাসের হেল্পার-চালক বলার পরও সেসব পুরুষ যাত্রীরা সিট ছাড়ে না। পুরুষ যাত্রীদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে দাঁড়ানোর মতো পরিবেশ আমাদের দেশে এখনো সৃষ্টি হয়নি। কারণ অনেক পুরুষ যাত্রী ইচ্ছাকৃতভাবেই গায়ে পড়ে অশোভন আচরণ করার সুযোগ খুঁজে।
কিছুদিন ধরে মেয়েদের জামার পিছন দিকে ব্লেড দিয়ে কেটে দেওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়টিও সম্প্রতি ফারহ’র মত অনেক তরুণীর ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ফৌজিয়া হাসনাত জানালেন, ভিড়ের মধ্যে বাসে উঠতে বেগ পেতে হয়। কারণ একই দরজা দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করে ওঠা কষ্টকর। এক্ষেত্রে কিছু পুরুষ যাত্রী পেশীর জোর দেখায়, নয়তো গায়ে হাত দিয়ে অশোভন আচরণ করে। তাছাড়া সাধারণত সিটে বসলে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ যাত্রী ইচ্ছা করেই মেয়েদের গা ঘেষে কূরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করে।
উপরের অভিযোগগুলোর পুনরাবৃত্তি করেই নতুন সমস্যার কথা জানালেন স্কুল শিক্ষিকা নুসরাত হেনা। তিনি বলেন, বাসে ওঠার সময় দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা হেল্পার গায়ে হাত দিবেই। বিনা প্রয়োজনে পিঠে হাত দেয়া হেল্পারদের বদ অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি আরো জানালেন, টেম্পুতে জায়গা সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে অনেক পুরুষ যাত্রী হাঁটুর সঙ্গে হাঁটু লাগিয়ে অশোভন আচরণ করে বা কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত দেয়।
হেনা, ফৌজিয়া বা ফারাহদের এসব অভিযোগ নতুন নয়। মানুষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারী যাত্রীর সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু বাসে নারীদের জন্য সিট সংখ্যা বাড়ছে না। নারী যাত্রীর জন্য বিআরটিসি কিছুদিন আগেও আটটি বাস চালু রেখেছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত নারী যাত্রী নেই, তাই লস দিতে হচ্ছে- এমন অজুহাতে বাসগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যদিও ওই আটটি বাসও নারীদের জন্য রাজধানীতে অপর্যাপ্ত ছিল। রাজধানীর ৭৩টি মোড়ে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় ভিড় থাকে। এ ভিড়ের মধ্যে নারী যাত্রীদের পোহাতে হয় এসব সমস্যা। অপরাধী অপরিচিত হওয়ায় এবং আমাদের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি না পাওয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীদের এসব ভোগান্তি মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া উপায় থাকে না।
শুধু পুরুষ যাত্রী নয়, বাসের চালক ও হেল্পারদের আচরণও নারীদের জন্য বিব্রতকর। এমনটাই মনে করেন, ফিমেল এডুকেশন ফাউন্ডেশন-এর চেয়ারম্যান জিনাত রেহানা ইলোরা। তিনি বলেন, নারীদের অসম্মান বা বিব্রত করার সস্তা একটা ধরণ হল, তাদের উদ্দেশ্য করে বা তাদের সামনে অশ্লীল শব্দ, বাক্য ও অঙ্গভঙ্গি করা। এ বিষয়ে লোকাল বাসের ড্রাইভার ও হেল্পাররা বেশ পারদর্শী।
তবে এ ব্যাপারে শিক্ষা ও সামাজিক-সচেতনতার বিকল্প নেই, এমনটাই বোঝা যায়, কবি ঋতুপর্ণা আজাদ অর্চির কথায়। তিনি বলেন, গণপরিবহনে বেশি সমস্যা তৈরি করে মধ্যবয়স্ক লোকজন। তারা গায়ে পড়ে বিভিন্ন ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্ন শুরু করে, যা কোনোভাবেই অপরিচিত লোকের কাছে কাম্য নয়। এখনকার শিক্ষিত সচেতেন তরুণরা এ ব্যাপারে বেশ ভদ্র। তবে শ্রমিক শ্রেণির লোকেরা গায়ে পড়ে নোংরামী করে। এটাকে যৌন হয়রানি ছাড়া অন্য কোনোভাবেই অভিযুক্ত করা যায় না।
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে বসবাসকারী ৫৬ শতাংশ নারী বলেছেন, ভালো পরিবহনব্যবস্থা না থাকায় ইচ্ছা থাকলেও তাঁরা ঘরের বাইরে যেতে চান না। ২৬ শতাংশ নারী বলেছেন, নিরাপত্তার অভাবে পরিবার তাঁদের ঘর থেকে বের হতে দেয় না।
অ্যকশনএইড বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি ফারাহ্ কবির বলেন, ‘নগরের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী হলেও নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়নে নারীর চাহিদা ও আকাক্সক্ষার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় আসে না। নগর উন্নয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রকল্পের নকশা ও বাস্তবায়ন বেশির ভাগ কাজে নারীর সংখ্যা কম থাকায় নারী ব্যবহারবান্ধব নগর কাঠামো তৈরি হয় না। ফলে রাস্তাঘাট, ফুটপাত, মার্কেট, শপিং মল, পরিবহনব্যবস্থা, পাবলিক টয়লেট, পার্ক, উন্মুক্ত স্থানসহ সকল গণপরিসরে নারীদের ব্যবহার উপযোগিতা সীমিত ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আক্তার মাহমুদ বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীর গণপরিবহন সম্পর্কে ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতা যানজট নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। ৭৮.৫ শতাংশ নারী বলেছেন, বাসের সংখ্যা অপ্রতুল। ২২.৫ শতাংশ নারী বাস সহকারী, চালক ও সহযাত্রীর কাছ থেকে যৌন হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ তুলেছেন।
গবেষণায় বলা হয়েছে, গণপরিবহন, রাস্তাঘাট, ফুটপাত, পাবলিক টয়লেট, পার্কের মতো গণপরিসরে নারীদের ব্যবহার উপযোগিতা সীমিত। নগরের কাঠামোগুলো নারীবান্ধব না হওয়ায় এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। ফলে শঙ্কা, নিরাপত্তাহীনতা ও সহিংসতার ভয়ে গণপরিসর এড়িয়ে চলতে হয় নারীদের।
প্রতিনিয়ত নারী যাত্রীরা এভাবে হয়রানির শিকার হলেও নীরব প্রশাসন। নেই বিকল্প কোনো উদ্যোগ। কেন? এ ব্যাপারে আইন কী বলে?
এব্যাপারে ব্যারিস্টার মিতি সানজানার বলেন, এ জাতীয় অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীকে শনাক্ত করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে মানবিক সচেতনতা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। পেনালকোড, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ আইন- এ ধরনের হয়রানিমূলক আচরণের জন্য শাস্তির বিধান রেখেছে। কিন্তু খুন ও ধর্ষণের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীকে যেভাবে চিহ্নিত করা যায়, গণপরিবহনে নারীকে হয়রানির ক্ষেত্রে সেভাবে শনাক্ত করা যায় না। পুরো ব্যাপারটিতে নারীদের ঝামেলা পোহাতে হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে নারী মুখ খোলার বা বিচার চাওয়ার ঝামেলায় যান না। এ ব্যাপারে হাইকোর্টের ২০০৮ সালের দিক নির্দেশনা আছে। যতক্ষণ কোনো আইন নেই, ততোক্ষণ এ দিক নির্দেশনা আইন হিসেবে গণ্য হবে। তবে সামাজিক প্রতিরোধ ও সচেতনতা গড়ে তোলার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই। সামাজিকভাবে আমরা এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে সক্ষম হবো, জনসচেতনতা গড়ে উঠবে- এটাই প্রত্যাশা।