১৩ জানুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ৯:১৬

অভিভাবক পেটানো কি শিক্ষকের কাজ?

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : কোনও কোনও শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের মারপিট করাকে এখনও তাঁদের ‘গুরুদায়িত্ব’ ভাবেন। তবে পৃথিবীর অনেক দেশে ছাত্রপেটানোকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। কোনও শিক্ষক ভুলক্রমে এমন কাজ করলে তাঁর শিক্ষকতার যোগ্যতা বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের শিক্ষকদের কেউ কেউ ছাত্রের অভিভাবককেও পেটানোর মতো দুঃসাহস পর্যন্ত দেখাচ্ছেন।
শিশুর শিক্ষা নিয়ে অভিভাবক উদ্বিগ্ন থাকতেই পারেন। শিশু যদি রেজাল্ট খারাপ করে কিংবা স্কুলে যেতে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে তাহলে যে কোনও সচেতন অভিভাবকের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়বে এটাইতো স্বাভাবিক। এ বিষয়ে কোনও অভিভাবক যদি স্কুলে গিয়ে শিক্ষকের কাছে জানতে চান তাহলে তাঁকে স্বাগত জানানো উচিত সংশ্লিষ্ট শিক্ষক অথবা স্কুল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু তা না করে কক্সবাজারের কয়েক জন শিক্ষক এক অভিভাবককে দড়ি দিয়ে বেঁধে নির্মমভাবে মার-ধর করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু অভিযোগ নয়, ভিডিওচিত্রে অভিভাবককে বেঁধেছেদে মারপিটের নির্মম দৃশ্যও দেখা গেছে। কাজেই ঘটনা লুকোবার অবকাশ নেই।
ঘটনাস্থল থেকে সিবিএন জানায়: কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা খরুলিয়া এলাকার অভিভাবক আয়াতউল্লাহ তাঁর ছেলের রেজাল্ট খারাপ হওয়া এবং স্কুলের কিছু অনিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁর ওপর পাশবিক কায়দায় নির্যাতন চালানো হয়। তাঁকে মারপিট করা হয় পশুর মতো হাত-পা বেঁধে। এ ঘটনার জন্য এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ। তাঁরা সংশ্লিষ্টদের শাস্তি দাবি করেন।
গত ৭ জানুয়ারি সকাল ১০টায় খরুলিয়া উচ্চবিদ্যালয় মাঠে ন্যক্কারজনক এ ঘটনা ঘটান স্কুলের শিক্ষকরা। এতে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে এলাকাজুড়ে। তোলপাড় চলছে কয়েকদিন থেকে। অভিভাবক পেটানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা পালিয়ে আছেন বলে জানা গেছে।

ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ঘটনার শিকার আয়াতউল্লাহর ছেলে শাহরিয়ার নাফিস আবির খরুলিয়া কেজি এন্ড প্রি-ক্যাডেট স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। সে প্রথম শ্রেণিতে জিপিএ-৫ না পাবার বিষয়ে প্রধানশিক্ষক বোরহান উদ্দিনের কাছে জানতে সকালে স্কুলে যান আয়াতউল্লাহ। একই সময় পূর্বঘোষণা ছাড়াই ভর্তি ফি ও মাসিক বেতন কেন বাড়ানো হয় তাও জিজ্ঞেস করেন। এ নিয়ে প্রধানশিক্ষক বোরহান উদ্দিনের সঙ্গে আয়াতউল্লাহর বাদানুবাদ হয়। এ সময়ে পাশের খরুলিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক জহিরুল হককে ডাক দেন বোরহান সাহেব। শুরু হয় ত্রি-মুখি তর্কবিতর্ক। ঘটনাটি হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায়। এ সময় আয়াতউল্লাহ ছিলেন একা। মাস্টার জহিরুল হক “কেন এসব জানতে চাচ্ছ” বলে প্রশ্ন করেন এবং ধাক্কা মারেন আয়াতকে। বোরহান উদ্দিনও মারেন আরেক ধাক্কা। মাটিতে পড়ে যান অসহায় অভিভাবক আয়াতউল্লাহ। এরপর দড়ি দিয়ে আয়াতের হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। মারধর করতে থাকেন দুই শিক্ষকসহ তাদের লেলিয়ে দেয়া বাহিনী। আয়াতউল্লাহকে লাথি ও থুথু মারেন শিক্ষক জহিরুল হক এবং বোরহান উদ্দিন। এ সময় উপস্থিত কেউ ঘটনার প্রতিবাদ করতে সাহস পাননি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অমানবিকভাবে আয়াতকে নির্যাতন করা হলেও কোনও শিক্ষক বা শিক্ষার্থী তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে যাননি। পরে আয়াতেরর চিৎকার ও গোঙানি শুনে স্কুলের আঙ্গিনায় গিয়ে পৌঁছেন কয়েকজন পথচারী। শিক্ষক-ছাত্রদের পায়ের নিচ থেকে হাত-পা বাঁধা আহত আয়াতকে উদ্ধার করেন তাঁরা। ঘটনা জানাজানি হলে শিক্ষক নামক মাস্তানদের বর্বরতায় ফুঁসে ওঠেন এলাকাবাসী।
আয়াতের কাছে ঘটনার কথা জানতে চাইলে বলেন, “আমার ছেলের কাক্সিক্ষত ফল কেন হয়নি? কোন যুক্তিতে ভর্তি ফি ও মাসিক বেতন বাড়ানো হয়েছে? এসব জানতে চাইলে শিক্ষকরা আমার ওপর নির্যাতন চালান।”
কেন এমন ঘটনা ঘটলো? জানতে চইলে খরুলিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক জহিরুল হক বলেন, “আয়াতউল্লাহ আমাদের স্কুলের ছাত্র ছিল। বেয়াদবি করায় তাকে এমন শাস্তি দেয়া হয়েছে। এমন বেয়াদবি করবে না মর্মে মুচলেকা দেবার পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।

শিক্ষক হিসেবে অভিভাবকের হাত-পা বেঁধে মারধর করা উচিত হয়েছে কিনা? জানতে চাইলে তিনি ঘটনার সঙ্গে নিজে জড়িত নন বলে দাবি করেন। এরপর তিনি বলেন, ঘটনাটি এলাকার ক্ষুব্ধ লোকজন ঘটিয়েছে।
অভিযুক্ত অন্য শিক্ষক বোরহানউদ্দিনের সেল ফোনে কল করলে তিনি নিজেকে বোরহান উদ্দিন নন বলে দাবি করেন এবং বলেন, “ভর্তি ফি, মাসিক ফি ইত্যাদি স্কুল পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক নেয়া হয়। আমাদের কাছে জানতে চাওয়ায় আয়াতউল্লাহকে কমিটির কাছে যেতে বলা হয়। এতে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে যান।” এতটুকু বলে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। কিছুক্ষণ পর একই ব্যক্তি অন্য একটি নম্বর থেকে কল করে বলেন, এটা বোরহান স্যারের নম্বর। কল দিলে বিস্তারিত জানতে পারবেন। কিন্তু ওই নম্বরে কল দিলে কোনও সাড়া মেলেনি।

ঘটনা প্রসঙ্গে কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নোমান হোসেন বলেন, শিক্ষকসমাজের পক্ষ থেকে এমন আচরণ আশা করা যায় না। খুনের আসামী কিংবা বড়মাপের অপরাধীকেও এভাবে শাস্তি দেবার বিধান নেই। এটি চরমভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা দরকার।
কেউ অপরাধ করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবার অধিকার আছে। কিন্তু গরু-ছাগলের মতো কাউকে পেটানো আইন হাতে তুলে নেবার শামিল। শিক্ষকরা সম্মানিত ও দায়িত্বশীল। তাঁরা অভিভাবককে বেধড়ক পেটাবেন এটা সভ্য সমাজের কাম্য হতে পারে না। একজন অভিভাবক তাঁর সন্তান অথবা পোষ্যদের লেখাপড়া কেমন হচ্ছে, রেজাল্ট ভালো হলো না কেন, এসবের খোঁজখবর নিতেই পারেন। এটা তাঁদের দায়িত্ব।
প্রথমে অনলাইন মিডিয়া, পরে টেলিভিশন ও খবরের কাগজে উল্লিখিত শিক্ষকদের হাতে নির্যাতিত হবার সচিত্র খবরে সত্যই আমরা যারপর নেই লজ্জিত ও মর্মাহত। স্তম্ভিতও বলা যায়। শিক্ষকের কাজ এমন হতে পারে না। আমরা ঘটনার সঠিক তদন্ত ও দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি প্রত্যাশা করি।

পরে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হয়েছে ১১ জনের বিরুদ্ধে। অভিযুক্তরা নিশ্চয়ই উপযুক্ত শাস্তি পাবেন। এ না হলে শিক্ষকদের প্রতি মানুষের বাজে ধারণা বেড়ে যাবে। শিক্ষা নিয়ে যে অরাজকতা চলছে, তা মহামারি রূপ নেবে।
আসলে শিক্ষকরা জাতির গৌরব। গুরুজন। গুরুজনের কাছ থেকে গুরুর মতোই আচরণ প্রত্যাশা করে সমাজ ও জাতি। গুরুই যদি গরুতে পরিণত হন, তাহলে গরুকে মানুষ করবে কে? জাতিকে অধঃপতন থেকে কে বাঁচাবে?

http://www.dailysangram.com/post/315099