১২ জানুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৯:০২

ঐতিহ্য সংরক্ষণের আড়ালে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি

ঢাকার শতাধিক ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ধ্বংস, ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকায় মিলছে সংস্কার অনুমতি, আদালতের নির্দেশও উপেক্ষিত


ঢাকার ঐতিহ্য রক্ষার নামে চলছে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি। একদিকে অযত্ন, অবহেলা আর তদারকির অভাব অন্যদিকে লাগামহীন দুর্নীতি এবং অনিয়মের কারণে গত ৮ বছরে রাজধানীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে ১৮টি সরকারি তালিকাভুক্ত ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। এসব স্থাপনা ধ্বংস করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবন। সব মিলিয়ে গত চার দশকে ধ্বংস হয়েছে শতাধিক স্থাপনা। রাজউক, গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

২০০৪ সালে আরবান স্টাডি গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা শহরে অবস্থিত আড়াই হাজার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার একটি তালিকা তৈরি করে তা সংরক্ষণের জন্য রাজউক, সিটি করপোরেশন, ডিসি অফিস, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে জমা দেয়। কিন্তু সেই তালিকাটি উপেক্ষিত হয়। ২০১২ সালে হেরিটেজ সংরক্ষণের দাবিতে উচ্চ আদালতে একটি রিট করা হলে আদালত ঐতিহ্যবাহী ভবনের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা সংশ্লিষ্টদের জমা দিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু দীর্ঘ ৫ বছরেও সেই তালিকা আদালতে জমা দেওয়া হয়নি। বরং ২০০৯ সালে ৯৩টি ঐতিহ্যবাহী ভবনের তালিকা নিয়ে একটি গেজেট প্রকাশ করা হলেও ২০১৮ সালে এসে হেরিটেজের সংখ্যা কমিয়ে ৭৫টি করা হয়েছে। রহস্যজনক কারণে এই সংখ্যা ক্রমাগতভাবে শুধুই কমছে। এদিকে হেরিটেজ রক্ষার নামে গঠিত নগর উন্নয়ন কমিটির বিরুদ্ধে নানা অসঙ্গতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীরা জানান, ব্যক্তিমালিকানাধীন যেসব বাড়িগুলো হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে তা গত কয়েক বছর ধরে সংস্কারের অনুমতি দিচ্ছে না নগর উন্নয়ন কমিটি। সমপ্রতি মোটা অংকের উেকাচ নিয়ে গোপনে কয়েকটি বাড়ি সংস্কারের অনুমতি দিয়েছে কমিটি। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ১৮টি ঐতিহ্যবাহী বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে বহুতল আলিশান ভবন।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব ও হেরিটেজ রক্ষায় গঠিত নগর উন্নয়ন কমিটির চেয়ারম্যান শহীদ উল্লা খন্দকার ইত্তেফাককে বলেন, নীতিগতভাবেই কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ হেরিটেজ ভবনের সংস্কারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে কি-না তা আমার জানা নেই। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ভাঙার মচ্ছব

এদিকে গত মঙ্গলবার থেকে ৬৭ নম্বর পাটুয়াটুলী লেনের একটি ঐতিহ্যবাহী বাড়ি ভাঙার কাজ চলছে। এ ব্যাপারে রাজউক ও স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করা হলেও কাজ থামেনি। বরং এ ক্ষেত্রে নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন রয়েছে বলে জানা গেছে। একইভাবে কমিটির কাছ থেকে সংস্কারের অনুমোদন নিয়ে শাঁখারি বাজারের ১৪ নম্বর ঐতিহ্যবাহী ভবনটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে দখলদাররা। সেখানে এখন বহুতল ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বিকিকিনি চলছে। শাঁখারি বাজারের ৬৫ নম্বর ভবনটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানেও হচ্ছে আলিশান ভবন। শাঁখারি বাজারের শম্ভুনাথ সাহা বলেন, মোটা অংকের উেকাচের বিনিময়ে নগর উন্নয়ন কমিটি থেকে ভবন সংস্কারের অনুমোদন এনে পুরনো ভবন সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হচ্ছে। একইভাবে ৩৮ নম্বর টিপু সুলতান রোডের শঙ্খনিধি হাউজের ঐতিহ্য, পুরান ঢাকার উত্তর মৈশুন্ডির ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯ ও ৪০ নম্বর হোল্ডিং জুড়ে ২৫ কাঠা জমির ওপর অবস্থিত হেরিটেজভুক্ত হিন্দু জমিদার বাড়ি ও মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। ভেঙে ফেলা অন্য হেরিটেজভুক্ত স্থাপনার মধ্যে রয়েছে ২০৭ লালমোহন সাহা স্ট্রিটের একটি ভবন, লালবাগ ২৫৫ ও ২৫৬নং হোল্ডিংস্থ জমিদার কেদার নাথের বাড়ি ও নাট মন্দির, ২৬ বিকেদাস ও ৩৩ প্যারিদাস রোডে অবস্থিত তিনটি ঐতিহ্যবাহী বাড়ি, আরমানিটোলা নিকি সাহেবের বাড়ি, রাজারাম মোহন রায় লাইব্রেরী, খামার বাড়ি ভবন, পুরনো জেলা পরিষদ ভবন।

‘টাকা না দিলে সংস্কারের অনুমোদন মিলে না’

বিভিন্ন এলাকার স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, অর্থ দিয়ে ভবন সংস্কারের অনুমোদন নিয়ে অনেকে পরে সেটি ভেঙে ফেলে কিংবা বিকৃত করে নতুন ভবন নির্মাণ করছে। আবার যাদের প্রকৃতপক্ষে ভবন সংস্কারের প্রয়োজন তাদের অনেককেই অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না উেকাচ না দেওয়ায়।

পুরান ঢাকার শাখারী বাজার এলাকায় হেরিটেজভুক্ত একটি বাড়ির মালিক সৈলেন সেন বলেন, নিজের বাড়িতে পরবাসীর জীবন-যাপন করছি। পৈত্রিক বাড়িতে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সম্পূর্ণ বাড়ি নিয়ন্ত্রণ করছে রাজউক।

আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান স্থপতি তাইমুর ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, রাজউক ও নগর উন্নয়ন কমিটির এক প্রকার মৌন সম্মতিতেই এসব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা প্রকাশ্যে ধ্বংস করা হয়েছে। বিনিময়ে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। ভবন ধ্বংসের প্রতিটি ঘটনা সংশ্লিষ্টদের জানানোর পরও তারা এগিয়ে আসেনি। ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চর্চা প্রতিষ্ঠান ঢাকা কেন্দ্রের পরিচালক মো.আজিম বকস ইত্তেফাককে বলেন, সংস্কারহীন হেরিটেজের নিচে চাপা পড়ে মরার উপক্রম হয়েছে ঢাকাবাসীর। কারণ অধিকাংশ স্থাপনাই ঝুঁকিপূর্ণ। ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংরক্ষণের নামে একটি কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি কমপক্ষে ১০ লাখ করে টাকা উেকাচ নিয়ে তবেই হেরিটেজ সংক্রান্ত বাড়ি সংস্কারের অনুমতি দিচ্ছে। আর যারা টাকা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের ভাগ্যে অনুমোদন মিলছে না।

স্থপতি ইকবাল হাবিব ইত্তেফাককে বলেন, সুষ্ঠু নীতিমালার অভাবে এই অমূল্য সম্পদ রক্ষা করা যাচ্ছে না। তিনি এই অমূল্য সম্পদ রক্ষা করে ইতিহাস ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান। রাজউকের চেয়ারম্যান ও নগর উন্নয়ন কমিটির সদস্য সচিব প্রকৌশলী মো. আব্দুর রহমান বলেন, নতুন গেজেটে পুরান ঢাকার কয়েকটি সংরক্ষিত সড়ককে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। হেরিটেজ ঘোষিত স্থাপনার মালিকদের দাবির ভিত্তিতেই এই নতুন গেজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংস্কারের অনুমতির নামে অর্থ আদায়ের বিষয়টি তিনিও অস্বীকার করেন।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এ সম্পর্কে ইত্তেফাককে বলেন, একটি জাতির আত্ম পরিচয় হচ্ছে তার ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি। এই ধারাবাহিকতা রক্ষায় সরকার ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। শীঘ্রই এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হবে।

 

http://www.ittefaq.com.bd/capital/2018/01/12/143127.html