১২ জানুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৯:০১

প্রচন্ড শীতে মায়ের সাথে ফুটপাথে শিশুরাও

অনশনে ইবতেদায়ীর ৬৬ শিক্ষক অসুস্থ

গাইবান্ধার দূর্গাপুর মাদরাসার শিক্ষিকা কোহিনূর আক্তার। দিনে মাদরাসায় পাঠদান এবং রাতে স্বামী-সন্তান নিয়ে বাসায় থাকার কথা তার। কিন্তু তিন বছর বয়সী কন্যা তৃষ্ণাকে নিয়ে এখন এই শিক্ষিকার দিনরাত কাটছে জাতীয় প্রেসক্লাবের ফুটপাথে। এই প্রচÐ শীতে মায়ের সঙ্গে তৃষ্ণাকে ঘুমাতে হচ্ছে রাস্তায়, ঘুম ভাঙছে যানবাহনের বিরক্তিকর শব্দে। কোহিনূর আক্তার বলেন, কখনো চিন্তা করেননি তার মেয়ে রাস্তায় ঘুমাবে। আর ছোট্ট শিশু তৃষ্ণাও বুঝতে পারছে না কেন হিমশীতে সে রাস্তায় রাত কাটাচ্ছে। কেনই বা দিনে যানবাহনের বিরক্তিকর শব্দ, মানুষের কোলাহল আর ধুলাবালির সঙ্গে থাকতে হচ্ছে তাকে। তবুও তৃষ্ণার তৃপ্তি এক জায়গায়, সে তো মায়ের সঙ্গেই আছে। আর মা কোহিনূর বলেন, যখন আন্দোলনের জন্য ঢাকায় আসেন তখন তিন বছরের মেয়ে তৃষ্ণাকে ফেলে আসতে পারেননি। শুধু কোহিনূর আক্তরই নয়, শিশু সন্তান নিয়ে এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন আরো বেশ কয়েকজন শিক্ষিকা। তারা বলছিলেন প্রচÐ শীতে মানুষ যখন তাদের শিশুদের উষ্ণতায় রাখার চেষ্টা করেন তখন তাদের শিশুদের জন্য মাতৃকোলের উষ্ণতাই হয়ে উঠেছে একমাত্র ভরসা। এর পরও তাদের প্রত্যাশা, এবারের আন্দোলনে তাদের আর শূণ্য আকাশের দিকে তাকিয়ে হাহাকার করতে হবে না। সরকার তাদের অবশ্যই স্বীকৃতি দেবে।

সরকার স্বীকৃত স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের দাবিতে আজ চতুর্থ দিনের মতো আমরণ অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা। কন কনে শীতে টানা আট দিন অবস্থান ধর্মঘটের পর গত মঙ্গলবার সকাল ১১টা থেকে আমরণ অনশন শুরু করেছেন শিক্ষকরা। তাদের এই ন্যায্য দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চলবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন শিক্ষকরা। এদিকে, তৃতীয় দিন পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৬ জন শিক্ষক। তবে এতোদিন ধরে লাগাতার অবস্থান ও অনশন কর্মসূচি পালন করে আসলেও এখনো সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষকরা কোনো সাড়া পাননি। আর সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কোন ঘোষণা না আসা পর্যন্ত কর্মসূচি থেকে পিছপা হবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষকরা। শিক্ষকরা বলছেন, তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বেন না। অনশন চালিয়ে যাবেন। মাদরাসা শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচি স্থলে গিয়ে দেখা যায়, জাতীয় প্রেসক্লাবের মূল গেইটের পাশের ফুটপাত ও রাস্তার পাশে অবস্থান নিয়েছেন কয়েকশ আন্দোলনকারী শিক্ষক। বেতন দাও নইলে ভাত দে, বেতন নইলে বিষ, বেতনবঞ্চিত ৩২ বছর, হামরা খুব কষ্টে আছি, চাকরি আছে বেতন নাই, এমন কোনো দেশ নাই, এ ধরনের নানা ¯েøাগানের প্যাকার্ড হাতে দাবি পূরণের পক্ষে অনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন সারাদেশ থেকে আসা মাদরাসা শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
চার বছরের ছেলে মাহিমকে নিয়ে ভোলা থেকে আসা শিক্ষিকা কামরুন নাহার বলেন, অন্তত আমাদের সন্তানদের কথা বিবেচনা করে আমাদের স্বীকৃতি দিন। এতদিন ধরে আমরা অভুক্ত থেকে আসছি। আমাদের দিকে একটু মুখ তুলে তাকান। তিনি বলেন, সরকার যদি আমাদের দাবি না মানে তাহলে আমরা এখানেই মরব, কিন্তু অনশন ভাঙব না। আমার বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দাবি মেনে নেবেন। তিনি যদি আমাদের দাবি না মানেন তাহলে রাস্তায় মরব, কিন্তু বাড়ি ফিরে যাব না।

আরিফুল ইসলাম বলেন, ২৪ বছর ধরে শিক্ষকতা করছি। কিন্তু এখনো আমরা অবহেলিত। এতোদিন ধরে শিক্ষকতা করলেও আজ পর্যন্ত কোনো দিন কোনো বেতন-ভাতা পাইনি। একপ্রকার মানবেতর জীবন পার করছি।
বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষক সমিতির মহাসচিব কাজী মখলেছুর রহমান বলেন, তৃতীয় দিনের মতো আজ (গতকাল) আমরা অনশন চালিয়ে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন শিক্ষক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আরো অনেকেই অসুস্থ। তবে আমাদের এই ন্যায্য দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত আমাদের এই অনশন কর্মসূচি চলবে। তিনি আরো বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা সরকারের কোনো পক্ষের কাছ থেকে কোনো ধরনের আশ্বাস পাইনি। প্রধানমন্ত্রী আপনি কাউকে পাঠিয়ে আমাদের খোঁজ নিয়ে দেখেন, আমরা কী কষ্টে আছি। বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি রুহুল আমিন বলেন, আমরা শিক্ষামন্ত্রীর কোনো কথায় আর আশ্বস্ত না। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে ঘোষণা শুনতে চাই। অন্যথায় আমরা অনশন চালিয়ে যাব।

আন্দোলনরত শিক্ষকরা জানান, একই পরিপত্রে ১৯৯৪ সালে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণ করা হয় ৫০০ টাকা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি ৫ম শ্রেণির কার্যক্রম একই হলেও ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে সরকার। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি মাসে ২২ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতন হলেও ১ হাজার ৫১৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকরা সরকারের থেকে কোনো বেতন পান না।

https://www.dailyinqilab.com/article/112328