১২ জানুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৮:৫৪

পরিকল্পিতভাবে অচল করে রাখা হয়েছে!

ডিএসসিসি ও ওরিয়নের যোগসাজশে চার বছরেও শেষ হয়নি রোড-ডিভাইডার তৈরিসহ সংস্কার কাজ -অভিযোগ ভুক্তভোগীদের * টোল দিয়ে ফ্লাইওভারে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছে পরিবহনগুলো


উদ্বোধনের চার বছর পরও শেষ হয়নি মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের সড়কের কাজ। নকশা অনুযায়ী প্রায় ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কের মধ্যখানে সবুজায়নসহ রোড-ডিভাইডার (সড়ক বিভাজক) হওয়ার কথা। কিন্তু রহস্যজনক কারণে অদ্যাবধি সেটি করা হচ্ছে না। উল্টো ‘পরিকল্পিতভাবে’ সড়কটি ব্যবহারের অনুপযোগী করে তোলা হয়েছে। সেখানে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও সিএনজি-টেম্পো-বাসস্ট্যান্ড। শুধু তাই নয়, সড়কের কোনো কোনো স্থানে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্তের, যেখানে ফেলে রাখা হয় ময়লা-আবর্জনা। একটু বৃষ্টিতেই পানি জমে কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে পুরো সড়ক।
এমন পরিস্থিতিতে প্রায় প্রতিদিনই সেখানে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। ফলে বাধ্য হয়েই ফ্লাইওভার দিয়ে যাতায়াত করছে বিভিন্ন ধরনের পরিবহন। টোল দিয়ে যাতায়াতের কারণে পরিবহন মালিকদের অহেতুক গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। ফলে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে লাভবান হচ্ছে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। যানজট নিরসনে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের সর্ববৃহৎ এ ফ্লাইওভার নির্মাণের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়েছে বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপ ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সড়কটি পরিকল্পিতভাবে অচল করে রাখা হয়েছে। এতে মোটা অঙ্কের অর্থের লেনদেন হয়েছে বলেও অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। যদিও দু’পক্ষই এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এ প্রসঙ্গে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপের গণমাধ্যম সমন্বয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খালিদ মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, ‘হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের সড়ক সংস্কারের দায়িত্ব ডিএসসিসির। কেন ওই সড়ক ডিএসসিসি সংস্কার বা সঠিক ব্যবস্থাপনা করে না, সে ব্যাপারে আমরা কোনো কথা বলতে পারি না।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ফ্লাইওভারের নিচের সড়ক খারাপ করে রাখতে ডিএসসিসিকে ম্যানেজ করার কোনো প্রশ্নই আসে না। আর টোলের পরিমাণ, ফ্লাইওভারের নকশাসহ সবকিছু সরকার অনুমোদিত। এসব বিষয়ে কেউ মনগড়া অভিযোগ তুললে, আমরা কিভাবে তা বন্ধ করব। যে কেউ এ সংক্রান্ত বিষয় যাচাই-বাছাই করে দেখলে প্রকৃত ঘটনা বুঝতে পারবেন।’
আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের সিংহভাগ সড়কের কাজ শেষ হয়েছে। যাত্রাবাড়ী থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত সড়কের দু’পাশের ড্রেনসহ সড়ক উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। এটি বড় কাজ হওয়ায় কিছুটা সময় লাগছে। আগামী জুন পর্যন্ত এ কাজের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করি নির্ধারিত সময়ের আগে এ সড়কের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে এই প্রকৌশলী বলেন, ‘চানখাঁরপুল থেকে যাত্রাবাড়ী বা কুতুবখালী পর্যন্ত ফ্লাইওভারের নিচের সড়কের বেশিরভাগ বেদখল হয়ে গেছে। এটা সত্য, এটা সবাই দেখছে। এসব অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করতে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। আমরা এসব সড়ক দখলমুক্ত করে জনগণের চলাচল নির্বিঘœ করতে বিশেষ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করব।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে এই প্রকৌশলী বলেন, ‘মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের সড়কের কাজ অসম্পূর্ণ রাখতে ওরিয়নের সঙ্গে ডিএসসিসির আঁতাতের অভিযোগ ভিত্তিহীন। এখানে কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ মুখরোচক গল্প। আর টোল সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে নির্ধারিত হয়েছে। এসব নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই।’

গত বুধবার সরেজমিন দেখা গেছে, যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত দু’পাশের সড়কেরও বেহাল দশা। প্রায় এক বছর আগে ওই সড়কের সংস্কার কাজ শুরু করলেও চলছে ঢিমেতালে। এতে ব্যস্ততম এ সড়কে চলাচলে মানুষকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এর দু’পাশে রাস্তার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রাখা হয়নি। ফ্লাইওভারের উত্তরে সড়ক ও জনপদ বিভাগের জায়গা থাকায় সেখানে রাস্তাটি কিছুটা বাড়ানো গেছে। কিন্তু দক্ষিণ পাশে যানবাহন চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রাখা হয়নি। মাত্র ১৫-২০ ফুট প্রশ্বস্ত সড়কে পরিবহন চলাচল করছে। এর মধ্যে আবার সড়কের একাংশে ড্রেন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে রাস্তাটি এখন এতটাই সরু হয়েছে যে, সকাল থেকেই যানজট লেগে থাকছে। এ অবস্থায় যেসব গাড়ি ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করতে চায়, সেগুলো মারাত্মক বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। তবে বিপুলসংখ্যক গাড়ি এ ঝক্কি এড়াতে ফ্লাইওভার দিয়ে চলাচল করছে। আর ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথেরও বেহাল দশা। এ অংশে ড্রেন ও সড়ক সংস্কার কাজ করা হচ্ছে। সড়কের পিচ ঢালাই, ইট, খোয়া উঠে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে এ সড়কে যান চলাচল করছে। একটু অসতর্ক হলে যানবাহন গর্তে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটছে।

যাত্রাবাড়ী এলাকার কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় এলাকার বাসিন্দারা জানতেন ওই সময়কার রাস্তার ওপর দিয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে। দু’পাশে পর্যাপ্ত জায়গা থাকবে। আর নতুন করে সড়ক আরও প্রশ্বস্ত করা হবে। কিন্তু বাস্তবে সেরকম হয়নি।
যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা ও মুদি দোকানদার মনিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘নির্মাণ কাজের সময় যেভাবে ফ্লাইওভার নির্মাণের কথা বলা হয়েছিল, সেভাবে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলেও অনেক ভালো হতো। সেসব না করে ফ্লাইওভারের কুতুবখালী এলাকার পূর্ব দিকের মাথায় টোলঘরের আগ থেকে ইচ্ছেমতো জায়গা নেয়া হয়েছে। এতে দুটি টোলঘরের জন্য ফ্লাইওভারের প্রায় চার গুণ জায়গা নিয়ে দু’পাশে যানবাহন চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রাখা হয়নি। ফলে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে চলতে গিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। সীমাহীন ভোগান্তি নিত্যদিনের সঙ্গী এলাকাবাসীর।’

যাত্রাবাড়ী আড়তের ব্যবসায়ী আবদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম ৮ লেন মহাসড়ক এসে মিলেছে কুতুবখালীতে। ফ্লাইওভার বাদ দিলে দক্ষিণ দিক দিয়ে ঢাকায় প্রবেশের জন্য রাস্তাটির প্রস্থ মাত্র ১৪ ফুট। এই ১৪ ফুট রাস্তাই রাজধানীতে প্রবেশের একমাত্র পথ। এটা কিভাবে হল? সরকার কেন এদিকে নজর দিল না, তা আমাদের বোধগম্য নয়। একটা ফ্লাইওভারের জন্য রাজধানীতে প্রবেশের পথ থাকবে না, এটা কি মানা যায়?’
সরেজমিন কুতুবখালী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কুতুবখালীর দিকে রাস্তার দক্ষিণে ড্রেন নির্মাণের কাজ চলছে। এ জন্য রাস্তাটির কিছু অংশ খুঁড়ে মাটি ফেলা হয়েছে রাস্তার উপরেই। এতে সরু ওই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এর জের হিসেবে পেছনে শত শত গাড়ি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সেখানে প্রায় দুই ঘণ্টা অবস্থানের পর দেখা গেছে প্রায় একই চিত্র। সকাল ৮টার পর থেকে এ যানজট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে রায়েরবাগ পর্যন্ত লেগে থাকে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের বাসচালক আবদুল মজিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে যে সময়ে কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত আসা যায়, কাঁচপুর থেকে সায়েদাবাদ যেতে এখন মাসের অনেক দিনই প্রায় একই সময় লাগে।’ তার অভিযোগ, ‘ফ্লাইওভার কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করেই টোল বুথের জন্য বেশি জায়গা নিয়েছে। কিন্তু পরিবহন চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রাখা হয়নি। এটা তাদের ব্যবসার কৌশল। কিন্তু সরকার কেন সেই ফাঁদে পা দিল সেটাই আমাদের প্রশ্ন? ড্রেন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে আরও প্রায় এক বছর আগে। এটা করতে বড়জোর দুই মাস সময় লাগার কথা। কিন্তু এতদিনেও কেন হচ্ছে না।’ চালক আবদুল মজিদের আরও অভিযোগ, ‘এমন পরিস্থিতিতে ফ্লাইওভার দিয়েই টোল দিয়ে চলাচল করতে বাধ্য হই। আবার টোলের টাকা অপেক্ষাকৃত বেশি রাখা হচ্ছে।’ মজিদের মতো একই ধরনের অভিযোগ করেছেন একাধিক গাড়ি চালকা। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কালাম অনু যুগান্তরকে বলেন, ‘শুরু থেকেই এ কাজের গতি কম ছিল। বিষয়টি আমরা মেয়রকেও অবহিত করেছি। ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকনও কয়েকবার এ এলাকা পরিদর্শন করে গেছেন। তিনি তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করার তাগিদও দিয়েছেন। কিন্তু তারপরেও ঠিকাদাররা কাজে গতি আনতে পারছে না।’

ভুক্তভোগীদের মতে- শুধু যাত্রী নয়, ফ্লাইওভারের দু’দিকের রাস্তার বেহাল দশায় ওই এলাকার কয়েক লাখ বাসিন্দা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষকে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হবে। অনেকের মতে, সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ যদি মানুষের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে ঠিকাদারকে কাজের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিত তাহলে আর এমন পরিস্থিতি হতো না। এ বিষয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকনের কাছে একাধিকবার আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। সরেজমিন আরও দেখা গেছে, চানখাঁরপুল থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের সড়কের ৬০ ভাগ হকারদের দখলে চলে গেছে। এছাড়া অবৈধভাবে সড়কে গাড়ি পার্কিং করে রাখা হচ্ছে। রোড ডিভাইডারের সবুজায়ন করার কথা থাকলেও সেখানে দখলদাররা হোটেল, দোকানপাট গড়ে বাণিজ্য করছেন। ডিএসসিসি হেডকোয়ার্টার সংলগ্ন অংশের এ বেহাল দশা হলেও সেদিকে কারও কোনো দৃষ্টি নেই। ফ্লাইওভারের চানখাঁরপুল অংশে সড়কে ঘোড়া বেঁধে রাখতেও দেখা গেছে। গুলিস্তান এলাকার হকার দখলমুক্ত করার জন্য ডিএসসিসি বাহবা নিলেও সেসব হকাররা পুনরায় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের সড়কসহ আশপাশের সড়ক দখল করে নিয়েছে। এসব দেখেও না দেখার ভান করে চলেছে কর্তৃপক্ষ।

স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফ্লাইওভারের নিচের অংশটি নোংরা পরিবেশের জন্য দায়ী একটি স্বার্থন্বেষী মহল। তারা নিচের সড়কটি নোংরা করে রাখে যাতে গাড়ি ফ্লাইওভার দিয়ে চলে এতে করে তারা বেশি করে টোল আদায় করতে পারে। সরকারি বিপুল অর্থ ব্যয়ে নির্মিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছিল যাত্রাবাড়ী ও সায়েদাবাদসহ রাজধানীর একটি অংশের যানজট নিরসনের লক্ষ্যে। এরপর থেকে ফ্লাইওভার ব্যবহারকারী যানবাহন খুব স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারছে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে এর নিচের সড়টি কয়েক বছর ধরে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ার কারণে।

বুধবার দুপুরে সরেজমিন দেখা গেছে, ফ্লাইওভার যেখান থেকে শুরু হয়েছে সেই চানখাঁরপুল থেকেই বিশৃঙ্খলা। চানখাঁরপুলের মোড়েই একটি নামেমাত্র যাত্রী ছাউনি রয়েছে। যেখানে এক নেশাখোর নেশার ঘোরে ঘুমাচ্ছে। আর দুই পাশে সিটি কর্পোরেশনের অনুমোদন নিয়ে দুটি দোকান বসানো হয়েছে। ফুটপাত নেই বললেই চলে। যেটুকু রয়েছে তাতে বসানো হয়েছে চা-সিগারেটের দোকান। অবাক করার বিষয় হল, নগর ভবনের গেট ঘেঁষেই অসংখ্য দোকানপাট রয়েছে। এ কারণে পথচারীদের মূল সড়ক দিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। এতে ঘটছে নানা দুর্ঘটনা।
সরেজমিন আরও দেখা গেছে, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের কাপ্তান বাজার, রাজধানী সুপার মার্কেট, দয়াগঞ্জ, সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত এলাকার সড়কের দু’পাশের নিচের অংশ টেম্পো স্ট্যান্ড, বাস স্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন দোকানপাট, নানাবিধ অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। সড়কের এ অংশের রোড ডিভাইডারও বিভিন্ন ভাবে বেদখল হয়ে রয়েছে। ভবঘুরে মানুষকে রোড ডিভাইডারে বসে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেও দেখা গেছে।
এ বিষয়ে দনিয়া এলাকার বাসিন্দা ইমরান হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘ডিএসসিসির চরম উদাসীনতা আর অবহেলায় অভিশপ্ত সড়কে পরিণত হয়েছে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার নিচের সড়কটি। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার কাজ না করায় চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। যে যার মতো করে সড়কটিতে দোকানপাট বসিয়ে দখল নিয়েছে। মনে হয় এসব দেখার কেউ নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শুনছি, ওরিয়ন-ডিএসসিসি যোগসাজশ করে সড়কটি সংস্কার না করে ফেলে রেখেছে। মাত্রাতিরিক্ত টোল নির্ধারণ করায় যানবাহনগুলো ফ্লাইওভার দিয়ে যেতে চায় না। কিন্তু নিচের সড়কের বেহালদশার কারণে ফ্লাইওভার ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।’
পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের বাসিন্দা মো. সাফায়েত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘চানখাঁরপুল থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ফ্লাইওভারের নিচের সড়কে এলোমেলোভাবে যানবাহন রাখা, খাবার হোটেল, ঘোড়ার গাড়ি, ওয়ার্কশপ, দোকান, নেশাখোরদের আড্ডা এবং বিভিন্ন দোকানের বর্জ্যরে কারণে এ সড়কে চলাচলে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমরা এ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি চাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফ্লাইওভারের অতিরিক্ত টোল নির্ধারণ করায় উপর দিয়ে চলাচল করা খুবই ব্যয়বহুল। আমার মতো স্থানীয়দের দিনে কয়েকবার গাড়ি নিয়ে ফ্লাইওভারে উঠতে হচ্ছে। নিচের সড়ক ভালো থাকলে অহেতুক এ টাকা আমি খরচ করতাম না।’

মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল নির্ধারণের ব্যাপারেও জনগণের ক্ষোভ রয়েছে। প্রথমে যে টোল ছিল পরে ডিএসসিসির অনুমোদন ছাড়াই চুক্তির দোহাই দেখিয়ে টোল বৃদ্ধি করেছে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়টি কোর্ট পর্যন্ত গড়ালেও কোনো সুরাহা হয়নি। মোটরসাইকেলের টোল ৫ টাকার স্থলে ১০ টাকা, অটোরিকশার টোল ১০ টাকা থেকে ১৮ টাকা, মিনিবাস, বাস ও চার চাকার ট্রাকের টোল ১০০ টাকার স্থলে ১৭০ টাকা, পিকআপের টোল ৭৫ টাকার স্থলে ১৩৫ টাকা, বাস ও ছয় চাকার ট্রাকের টোল ১৫০ টাকার স্থলে ২৭০ টাকা, মাইক্রোবাসের টোল ৫০ টাকার স্থলে ৮৫ টাকা, কারের টোল ৩৫ টাকার স্থলে ৬০ টাকা করা হয়েছে।
মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের আগে-পরে রাজধানীতে উদ্বোধন করা হয়েছে কুড়িল, মিরপুর-এয়ারপোর্ট রোড ফ্লাইওভার ও মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার ব্যতীত অন্য সড়ক ফ্লাইওভারের নিচের সড়ক শুরু থেকে ঝকঝকে তকতকে। কিন্তু মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের সড়ক উদ্বোধনের ৪ বছর পরও ঠিকঠাক করতে পারেনি ডিএসসিসি।

২০১০ সালের ২২ জুন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার প্রকল্পের কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০১৩ সালের ১১ অক্টোবর তিনিই ১১ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের সর্ববৃহৎ এ ফ্লাইওভারের উদ্বোধন করেন। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে (পিপিপি) নির্মিত দেশের সবচেয়ে বড় এ ফ্লাইওভারের সঙ্গে আশপাশের প্রধান প্রধান সড়ক ও বাস টার্মিনালের সংযোগ রাখা হয়েছে। চার লেনের এ ফ্লাইওভারের সড়কে প্রবেশের জন্য ছয়টি এবং বের হওয়ার জন্য সাতটি পথ রয়েছে। ১৯৯৮ সালে গুলিস্তান থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলেও দফায় দফায় দৈর্ঘ্য ও খরচ বেড়ে দীর্ঘ ১৫ বছর পর এ ফ্লাইওভার প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওরিয়ন গ্রুপ ফ্লাইওভারের ব্যবস্থাপনা, টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। চালু হওয়ার পর থেকে ২৪ বছরে পাওয়া টোলের ভিত্তিতে নির্মাণ ব্যয় তুলে নেবে তারা। প্রতিদিনের আদায় করা টোলের ৫ শতাংশ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তহবিলে জমা হবে। ২৪ বছর পর এর দায়িত্ব নেবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। হানিফ ফ্লাইওভারের আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে ১০০ বছর। চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৩০টি জেলার যানবাহন ঢাকার প্রবেশপথের যানজট এড়িয়ে এ ফ্লাইওভার দিয়ে কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারা এ ফ্লাইওভার নির্মাণের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/5748