৪২৩টি হাওর নিয়ে গঠিত হাওরাঞ্চলের ১২২টি হাওর কিশোরগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। জেলার সম্পূর্ণ হাওর অধ্যুষিত উপজেলাগুলো হচ্ছে- ইটনা, অষ্টগ্রাম, মিঠামইন ও নিকলী। এছাড়া করিমগঞ্জ, কটিয়াদী, বাজিতপুর, তাড়াইল, ভৈরব ও কুলিয়ারচর উপজেলার অংশবিশেষ হাওর এলাকায় অবস্থিত। এখানকার সব জমি এক ফসলি হলেও খুবই উর্বর। ফলে প্রতিবারই হাওরে বাম্পার বোরো উৎপাদিত হয়। হাওর অধ্যুষিত এই জেলায় গড়ে প্রতিবছর ১ লক্ষ ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়।
আবাদি এই জমি থেকে প্রায় ৭ লক্ষ টন চাল উৎপন্ন হয়। অথচ কিশোরগঞ্জ জেলার মোট খাদ্য চাহিদা পাঁচ লাখ টন চাল। ফলে আউশ, আমন ছাড়া কেবল বোরো থেকেই জেলার মোট খাদ্য চাহিদার থেকে প্রায় ২ লাখ টন বেশি চাল আসে। এছাড়া এখানকার হাওর-বিলে পাওয়া যায় অন্তত ১৫০ প্রজাতির দেশী জাত। মাছ ধরাটা পূর্বে একটি সমপ্রদায়ভুক্ত পেশা থাকলেও এলাকার সাধারণ কৃষকও বর্ষার বেকার সময়ে মাছ ধরা পেশায় যুক্ত হয়। ঘোলা মাছের খনি হিসেবে পরিচিত এখানকার হাওর ও জলাভূমিগুলোর মাছ দেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও দেশের বাইরে রপ্তানি হয়। এভাবে কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে উৎপাদিত বোরো ধান ও মাছ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রেখে আসছে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা কাঠানোয় এই এলাকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে হাওরের এমন গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকার পরও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, কৃষি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার, ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের দূষণ, অবাধে মৎস্য নিধন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রভৃতি নানা কারণে হাওরের পরিবেশ ও প্রতিবেশ এখন বিপন্ন। ফলে নাব্যতা হারাচ্ছে হাওরাঞ্চলের নদ-নদী। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে হাওরের জলজ প্রাণি ও উদ্ভিদের আবাসস্থল। এতে হাওরের জীববৈচিত্র্যও পড়েছে হুমকির মুখে। এরপরও এখানকার হাওর ও জলাভূমিগুলোর বিপণ্নপ্রায় পরিবেশ এবং প্রতিবেশের উন্নয়নে দীর্ঘদিনেও কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে প্রায় প্রতি বছর আগাম বন্যা কিংবা সেচের মৌসুমে পানির অভাব হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। একফসলি এই এলাকার একমাত্র ফসলটি ঠিকভাবে ঘরে তুলতে না পারায় এবং উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় হাওরের কৃষককে প্রতি বছরই লোকসান গুণতে হয়। এ পরিস্থিতিতে গত বোরো মৌসুমে চৈত্রের আগাম বন্যায় ফসলহানি কৃষকের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। একমাত্র বোরো ফসল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন হাওরের কৃষক। অথচ সংসারের খোরাকি, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া, হাট-বাজার এমনকি বিয়েশাদিসহ উৎসব-পার্বণের সব খরচ নির্বাহ করা হতো এই বোরো ধান বিক্রির টাকা দিয়ে। খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন বোরো ধান হারিয়ে কৃষকের মাঝে এখনো বিষাদের ছায়া। জেলা প্রশাসনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কিশোরগঞ্জের ১১টি উপজেলায় মোট ১ লাখ ৫০ হাজার ৫৩৬ হেক্টর জমিতে গত মৌসুমে বোরো আবাদ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৬১ হাজার ২০৭ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই কারণে প্রায় ২ লাখ ১৬ হাজার ৬১ চাল উৎপাদনে ক্ষতি হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য ৮৬৪ কোটি ২৪ লাখ ২৮ হাজার ৪শ’ টাকা। জেলায় মোট ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৮১ জন। তবে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার সবকটিই হাওরের ফসলই আগাম বন্যায় আক্রান্ত হয়। সর্বনাশা এই আগাম বন্যায় অন্তত দুই লাখ কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন। ধান হারিয়ে সংকটাপন্ন হাওরবাসী বর্ষার পানিতে মাছ ধরে কোন রকমে জীবিকা নির্বাহ করতে চেয়েছিলেন। এ জন্যে তারা বিভিন্ন মাধ্যমে ভাসান পানিতে মাছ ধরার সুযোগ দেয়ার দাবিও জানিয়েছিলেন। কিন্তু ইজারাদার নামে ওয়াটারলর্ডদের চোখ রাঙানি আর অত্যাচার নির্যাতনের মুখে জালও ছাড়তে হয়েছে তাদের। এছাড়া হাওর এলাকায় গড়ে ওঠেনি কোন শিল্প-কারখানা। ফলে হাওরাঞ্চলে প্রকট দারিদ্রের মধ্য দিয়ে মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করলেও জীবনধারণের জন্য মিলেনি কোন কাজ। বাধ্য হয়ে তাদের প্রিয় গৃহকোণ ছেড়ে শ্রম বিক্রি করতে নিজেকে পণ্য হিসেবে দাঁড় করাতে হয়েছে রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গার শ্রমিকের হাটে।
অকাল বন্যা, বর্ষার ভাঙন, মৌসুমী বেকারত্ব এবং দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত হাওরবাসীর জীবন। অন্যতম খাদ্য উৎপাদক হয়েও হাওরবাসীর খাদ্য নিরাপত্তা রয়েছে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে হাওরের মানুষ দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছেন। কাজের খোঁজে রাজধানী ঢাকা শহরের নূরের চালা, কচুক্ষেত, ধামালকোট, ইব্রাহীমপুর, কাফরুল, মীরপুর, গাজীপুরের সালনা, বোর্ডবাজার, কোনাবাড়ী, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, পাগলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, আশুগঞ্জ, সিলেটের ভোলাগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ দেশের নানা প্রান্তের উদ্বাস্তু মানুষের মিছিলে তারাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। বেসরকারি একটি সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগাম বন্যা, ভাঙনসহ নানা প্রতিকূলতার কারণে গত ২০ বছরে হাওরের নিজগ্রাম ছেড়ে দেশের বিভিন্ন জায়গার বাসিন্দা হয়েছেন অন্তত ২ লাখ মানুষ।