১১ জানুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৭:৩৬

দুই সরকারি সংস্থা বিধি মানছে না

উপেক্ষিত বিএসসির জাহাজ

পণ্য আমদানিতে জাহাজ ভাড়া (চার্টারিং) করার বিধিমালা মানছে না সরকারি দুই সংস্থা। শিল্প মন্ত্রণালয়ভুক্ত বিসিআইসি (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন) ও কৃষি মন্ত্রণালয়ভুক্ত বিএডিসির (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন) বিরুদ্ধে এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। জানা গেছে, বিধিমালায় সরকারি পণ্য আমদানিতে জাহাজ ভাড়ার কাজটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়াধীন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) মধ্যস্থতায় করার উল্লেখ থাকলেও এ দুটি সংস্থা তা মানছে না। ১৯ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বিসিআইসি ও বিএডিসিতে এ বিধিমালার ব্যত্যয়ের ঘটনা আলোচিত হয়েছে। এ সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সভায় সরকারি খাতে পণ্য পরিবহনের নিমিত্তে ‘জাহাজ ভাড়াকরণ বিধিমালা-২০১৭’র খসড়া চূড়ান্ত করা নিয়েও আলোচনা হয়।

জানা গেছে, যে কোনো মন্ত্রণালয়ের আমদানি-রফতানি কর্মকাণ্ড সমুদ্রপথে পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিবহন বা জাহাজ ভাড়ার প্রয়োজন হয় (পরিবহন চার্টারিং)। আর এ কাজে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) সরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে জাহাজ চার্টারিং বা ভাড়ার বিষয়টিতে মধ্যস্থতা করে দেয়। ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির ১০ নম্বর আদেশবলে বিএসসি গঠিত হয়। এরপর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অফিস স্মারক অনুযায়ী ১৯৭৩ সালের ৩০ এপ্রিল চার্টারিং কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। এ স্মারক অনুযায়ী সরকারি সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধীনস্থ সংস্থাকে সমুদ্রপথে আমদানি-রফতানি কাজে জাহাজ ভাড়া করার জন্য বিএসসিকে এখতিয়ার দিয়ে লিখিত নির্দেশ দেয়া হয়। এর ভিত্তি আরও মজবুত করতে ১৯৮৫ সালের ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে একই গ্রাউন্ড রুলও তৈরি করা হয়। আর তা অনুসরণ করেই জাহাজ চার্টারিং কাজ পরিচালিত হয়ে আসছে।

নৌপরিবহনমন্ত্রী মো. শাজাহান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘জাহাজ ভাড়াকরণ বিধিমালা-২০১৭’র খসড়া চূড়ান্তকরণ সভায় বিএসসির সহকারী মহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, ২০১০ সাল পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চলছিল। তারপর থেকেই সমস্যার শুরু। তিনি বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয়াধীন বিসিআইসি সরকারি সার পরিবহনের জন্য জাহাজ ভাড়া করার কাজটি বিএসসিকে পাশ কাটিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে করে আসছে। নিয়ম অনুযায়ী আন্তঃমন্ত্রণালয়ের চার্টারিং কমিটির সেক্রেটারিয়েট হিসেবে জাহাজ ভাড়া করার কাজটি বিএসসির মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়ার কথা। শুধু বিসিআইসি নয়, সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বিএডিসিও একই পন্থা অবলম্বন করছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারি অন্যান্য সংস্থাও যাতে একই পথ অনুসরণ না করে, সে আশঙ্কায় তৎপর হয়ে বিএসসি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অনুরোধ জানায়। এ কারণেই জাহাজ চার্টারিং বিধিমালা নিয়ে আবারও আলোচনায় বসতে হয়েছে। সভায় অর্পিত দায়িত্ব বলতে কী বোঝায়, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয়, সরকারের কার্যবিধিমালা ‘রুলস অব বিজনেস-১৯৯৬ এর অধীন প্রণীত অ্যালোকেশন অব বিজনেস অ্যামং দ্য ডিফারেন্ট মিনিস্টারস অ্যান্ড ডিভিশন্স’র আওতায় বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন আইন-২০১৭’র ৪নং ধারায় বিএসসির ওপর অর্পিত দায়িত্বকেই বোঝানো হবে। এ বিষয়ে সভায় উল্লেখ করা হয়, জাতীয় সংকটকালে কোনো বেসরকারি শিপিং কোম্পানির ওপর নির্ভর করা যায় না। আপৎকালীন একমাত্র বিএসসিকেই নির্ভর করা যায়। কিছুদিন আগে শ্রীলংকায় চাল রফতানি খাতে আর্থিক লোকসান সত্ত্বেও বিএসসি সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী রফতানিযোগ্য সমুদয় চাল পরিবহন করেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে পণ্য খালাস ব্যবস্থাপনায়ও বিএসসির জাহাজ ব্যবহার করে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। বিএসসি একটি জাতীয় পতাকাবাহী সরকারি বাণিজ্যিক সংস্থা। তাই নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়, জাহাজ চার্টারিংয়ের কাজটি নিজেদের মতো না করে বিএসসির মাধ্যমেই চালু রাখুন।

এ প্রসঙ্গে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব আবদুস সামাদ বলেন, সরকারের রুলস অব বিজনেস মতে, জাহাজ ভাড়া সম্পর্কিত কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব বিএসসির ওপর ন্যস্ত। তাই আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের জন্য জাহাজ ভাড়ার কাজ বিশেষায়িত সংস্থা হিসেবে বিএসসির মাধ্যমে সম্পন্ন করার প্রয়োজন রয়েছে। তবে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন সূত্রের দাবি, বিসিআইসির কাজ হল সার উৎপাদন করা। কিন্তু সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সার উৎপাদনের পাশাপাশি প্রতিবছর ১২ থেকে ১৫ লাখ টন সার আমদানিও করতে হচ্ছে। সার অতি স্পর্শকাতর পণ্য। তাই সময়ের দিক বিবেচনায় রেখে দ্রুততার সঙ্গে জাহাজ ঠিক করে পরিবহন করতে হয়। কৃষকের চাহিদামাফিক সময় মতো সার সরবরাহ সম্ভব না হলে কৃষি খাতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। মূলত এ কারণেই বিসিআইসি সার আমদানির ক্ষেত্রে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জাহাজ চার্টারিং কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার শাখার উপপ্রধান শেখ বদিউল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, বিএডিসিও সার আমদানি করছে। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি করা সারের মধ্যে শুধু ডিএপি সার পরিবহনের জন্য জাহাজ ভাড়ার কার্যক্রম বিএডিসির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় করা হচ্ছে। কিন্তু টিএপি সার পরিবহনের দায়িত্ব এখনও বিএসসির মাধ্যমেই পরিচালিত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিএসসির নির্বাহী পরিচালক মো. সাঈদ উল্লাহ বলেন, সারের চেয়েও অধিকতর স্পর্শকাতর পণ্য জ্বালানি তেল। এ তেল আমদানিতে বিএসসির মধ্যস্থতাতেই জাহাজ ভাড়া হয়। বিএসসি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত নিজস্ব ও ভাড়া করা জাহাজের মাধ্যমে সরকারি সংস্থাগুলোর পণ্য পরিবহন বা লাইটারেজ করে আসছে। এতে এ পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। সরকারি সার পরিবহন ব্যবস্থায় বিএসসির ব্যর্থতার কোনো নজির নেই।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/5383