১১ জানুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৭:৩৫

কাপাসিয়ায় সরকারি গাছ লুটের মহোৎসব

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় পল্লী বিদ্যুতের তার ও খুঁটির আশপাশের সরকারি গাছ কেটে নেয়ার মহোৎসব চলছে। পল্লী বিদ্যুতের ‘রাইট অব ওয়ে কিয়ারিং’ কাজের আওতায় গাছের ডালপালা কেটে ফেলার পর সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন জাতের কয়েক হাজার ফলদ ও কাঠের গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর ও সড়ক বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন এসব গাছ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় কেটে নিয়ে বিক্রি করে নিজেদের মধ্যে টাকা ভাগাভাগি করে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগও বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা।

গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ-২ এর কাপাসিয়া অফিসের এজিএম (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেনেন্স) প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল হাদী জানান, যেসব এলাকার মধ্য দিয়ে পল্লী বিদ্যুতের লাইন গেছে, সেসব এলাকার বিদ্যুতের তারের পাশের গাছ কেটে পরিষ্কার করার বিধান রয়েছে। ঝড়ের সময় বাতাসে গাছের ডালপালা ভেঙে যাতে বিদ্যুতের তারের কোনো ক্ষতি না হয়, সেজন্য প্রতি বছরের মতো এ বছরও বৈদ্যুতিক তার থেকে নির্ধারিত দূরত্ব বজায় রেখে কাপাসিয়ায় গাছ ও গাছের ডালপালা কাটা হচ্ছে। গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যেই এ কার্যক্রম চলছে। তবে এ কার্যক্রম শুরুর আগে এলাকায় মাইকিং করে গাছ কাটার বিষয়টি জানানো হয়। এ ছাড়াও স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউনিয়র পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের চিঠি দিয়ে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।

তিনি জানান, কাপাসিয়া উপজেলায় ১২ কিলোমিটারের বেশি বিদ্যুৎ লাইন রয়েছে। ওই এলাকায় কাঁঠাল, তাল, আম, জাম, লিচু, গজারি, মেহগনি, আকাশি, শিশুসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৩৬ হাজার বড় গাছ রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই কাঁঠাল গাছ। নিয়মানুযায়ী, বিদ্যুতের লাইনের তার থেকে ডানে ১০ ফিট এবং বামে ১০ ফিট এলাকার গাছ কাটতে হবে। পরে ৪৫ ডিগ্রি কৌণিকভাবে গাছের ডালপালা কেটে ছেঁটে দিতে হবে, যাতে বাতাস বা ঝড়ের সময় ডালপালা ভেঙে বিদ্যুতের তারের ওপর না পড়তে পারে। এ লক্ষ্যে পল্লী বিদ্যুতের পক্ষ থেকে দৈনিক ভিত্তিতে শ্রমিকদের দিয়ে শুধু মেইন লাইন-সংলগ্ন গাছগুলোর ডালপালা কেটে ছেঁটে পরিষ্কার করানো হচ্ছে। কোনো গাছের গুঁড়ি (কাণ্ড) কাটা হচ্ছে না। কারণ এখানকার বেশির ভাগ গাছই ফলদ বৃক্ষ। গাছের গুঁড়ি কেটে ফেলা হলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেÑ বিষয়টি মাথায় রেখেই কাজ করা হচ্ছে। শ্রমিকেরা ডালপালা কেটে দেয়ার পর গাছের মালিকেরা তা নিয়ে যায়। তবে পল্লী বিদ্যুতের শ্রমিকেরা গাছের ডালপালা কেটে ফেলার পর কিছু লোকজন নির্ধারিত দূরত্বের চেয়ে বেশি দূরের এমনকি সরকারি সড়কের অন্য পাশ থেকেও সরকারি গাছগুলো গোড়া থেকে কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এসব গাছ কাটার সাথে পল্লী বিদ্যুতের লোকজন জড়িত নয়। বিষয়টি নিয়ে আমরা বিব্রত অবস্থায় আছি।

এ দিকে সরেজমিনে এলাকায় গিয়ে জানা গেছে, কাপাসিয়া উপজেলার আমরাইদ, বড়হর, হাইলজোরসহ কয়েকটি এলাকায় কয়েকদিন ধরে পল্লী বিদ্যুতের লোকজন গাছের শুধু ডালপালা কেটে বিদ্যুতের লাইন পরিষ্কার করছে। তবে তারা গাছের কাণ্ড কাটছে না। ডালপালা কাটার এ সুযোগে কোনো ধরনের অনুমতি না নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের নাম ভাঙিয়ে স্থানীয় একাধিক মহল স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর ও সড়ক বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন এসব গাছের অবশিষ্টাংশ (কাণ্ড) কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এসব প্রভাবশালীরা বিদ্যুতের মেইন লাইনের নির্ধারিত দূরত্বের চেয়ে বেশি দূরের সরকারি গাছগুলো গোড়া থেকে কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি সরকারি সড়কের একপাশে বিদ্যুতের লাইন থাকলেও অন্য পাশ থেকেও তারা নির্বিচারে অবৈধভাবে গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয়রা প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না। এসব গাছ স্থানীয় বিভিন্ন স’মিল বা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে নিজেদের মধ্যে অবৈধভাবে টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে। এ যেন চলছে সরকারি গাছ লুটপাটের মহোৎসব।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, কাপাসিয়ার বড়হড় নতুন বাজার থেকে আড়ালজুড়ি ব্রিজ পর্যন্ত ১ কিলোমিটার জায়গার গাছ কেটে নিয়েছে বাবুল মুন্সি নামে সরকারদলীয় স্থানীয় এক নেতা। অবৈধভাবে সরকারি গাছ কাটতে বাধা দেয়ায় পল্লী বিদ্যুতের স্থানীয় লোকজনসহ স্থানীয় কয়েক ব্যক্তিকে হুমকি দেয় বাবুল মুন্সী। এ ছাড়া বানরখোলা, দেওড়া, গিয়াসপুর মোড় থেকে দুলালপুর বাজার পর্যন্ত এলাকার গাছ কেটে নিয়েছে স্থানীয় বারিষাব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবলু ও ইউপি সদস্য সেলিম মেম্বার। অন্য দিকে আমরাইদ বাজারের পশ্চিম অংশের বড় বড় শিশু গাছ ও আমরাইদ বাজার থেকে নরসিংহপুর ব্রিজ পর্যন্ত ছয়টি মেহগনি গাছ নিয়েছে স্থানীয় রায়েদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও আমরাইদ বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোস্তফা কামাল বাদল। স্থানীয়দের অভিযোগ, তিনি স্থানীয় এমপির লোক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে নানাভাবে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে তার নিজস্ব লোকজন দিয়ে এসব গাছ নিয়ে যাচ্ছে। ফলে অন্য বছরের চেয়ে এ বছর এ এলাকার মওসুমি ফল কাঁঠাল ও লিচুর উৎপাদন অনেক কম হবে। অথচ দেশে মোট উৎপাদিত মওসুমি ফল কাঁঠাল ও লিচুর একটি বড় অংশ এখানে উৎপাদন হয়।

সরকারি এসব গাছ লুটপাটের বিষয়ে পল্লী বিদ্যুতের আমরাইদ অফিসের ইনচার্জ জামালউদ্দিন জানান, আমি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
গাছ লুটের বিষয়টি জানতে চাইলে স্থানীয় রায়েদ ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোশারফ হোসেন সরকার টিটু জানান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিসের কথা বলে গাছ কেটে নিয়েছে মোস্তফা কামাল বাদল। তবে তিনি পার্টি অফিসে তা দিয়েছেন কি নাÑ আমি বলতে পারব না।
এ ব্যাপারে জানতে মোস্তফা কামাল বাদলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমি কোনো গাছ নেইনি। তবে পল্লী বিদ্যুতের লোকজন আমার কাছে সহযোগিতা চেয়েছিল, এ কারণে আমি কয়েকবার কয়েকটি স্পটে গিয়েছি। স্থানীয় লোকজন আমার নামে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করছে। তবে এবার নয়, বেশ কিছুদিন আগে আমি একটি সরকারি গাছ নিয়ে পার্টি অফিসের জন্য পাঁচটি চেয়ার বানিয়েছি। অন্য দিকে বারিষাব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবলুর মোবাইল ফোনে বারবার ফোন দিলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
গাজীপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী কে বি এম সাদ্দাম হোসেন জানান, বিষয়টি আমার জানা নেই। সরকারি সম্পদ এভাবে কেউ লুট করতে পারে না। আমি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

এ দিকে গাছ কাটার বিষয়টি জানতে পেরে গাজীপুর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেনের নির্দেশে গত রোববার কাপাসিয়া থানায় একটি জিডি করা হয়েছে। এ বিষয়ে কাপাসিয়া উপজেলা প্রকৌশলী আহম্মেদ আবদুল্লাহ জানান, গাছ চুরি করে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমরা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছি। আরো তদন্ত করে এর সাথে যারা জড়িত রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে শিগগিরই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/283931